‘খেলা এখনো শেষ হয়নি, অর্ধেক বাকি।’
ন্যু ক্যাম্পে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় লেগের ম্যাচটির আগে হুংকার দিয়ে বলেছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তারকা পল পগবা। ঘরের মাঠ ওল্ড ট্রাফোর্ডে প্রথম লেগের ১-০ গোলে হারা ম্যাচকে প্রথমার্ধ ধরেছিলেন আর দ্বিতীয় লেগের ম্যাচটিকে বাকি দ্বিতীয়ার্ধ হিসেবে ট্যাগ দিয়েছিলেন ফরাসি তারকা। পগবার হিসেব অনুযায়ী দ্বিতীয়ার্ধে বার্সেলোনার বিপক্ষে তাদের পরাজয় ৩-০ গোলে। আর দুই পর্ব মিলিয়ে ৪-০ গোলের অগ্রগামিতায় চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে লিওনেল মেসির বার্সেলোনা। মেসি নিজে করেছেন জোড়া গোল, অন্য গোলটি করিয়েছেন ফিলিপ কুতিনহোকে দিয়ে।
পগবার হুমকি টা কি মেসির কানে গিয়েছিল? এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া গেল না। তবে ইন্টারনেটের এই যুগে কোনো খবরই তো কানে না পৌঁছে থাকতে পারে না। ন্যু ক্যাম্পে মেসি যা করেছেন, এর আগে তা অনেকবার-ই করে দেখিয়েছেন। তবে আজকের মেসিকে একটু এগিয়ে রাখতেই হবে। কেন? বারবার পেছন থেকে তেড়েফুঁড়ে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার জন্য। এভাবেই তো দুইটি গোল করলেন। আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকরের এই আগ্রাসী মনোভাবের কাছেই প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছে ইংলিশ ক্লাব।
বার্সেলোনা বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। পাসিং সৌন্দর্যময় ফুটবল বনাম কিছুটা শারীরিক শক্তি নির্ভর ডাইরেক্ট ফুটবল। বল ধরলেই দু’-তিনজন মিলে ঘিরে ধরে ছন্দ নষ্ট করে দেওয়া। সঙ্গে কড়া ট্যাকল সামলানোর ঝুঁকি তো আছেই। প্রথম পর্বের ম্যাচে মেসির রক্তাক্তের দৃশ্যটা তো এখনো তাজা। কিন্তু মেসিকে আটকানোর জন্য ম্যান টু ম্যান টাইট মার্কিং বা জোনাল মার্কিং কোনোটাই যথেষ্ট নয়। আর যদি মেসি থাকেন তছনছে মুডে, তাহলে তো কথায় নেই।
কিন্তু মেসি টপ গিয়ারে ওঠার আগে কিক অফ বাঁশির শুরুর ১০ মিনিট কেমন ছিল, ভাবেন তো! সকাল দেখে যদি দিনের আভাস সব সময় মিলত, তাহলে আজ ঘরের মাঠে বার্সার কপাল খারাপ-ই ছিল। প্রথম মিনিটেই মার্কোস র্যাশফোর্ড চলে গিয়েছিলেন গোলের কাছাকাছি। ইংলিশ স্ট্রাইকারের শট ক্রসবার চুমু খেয়ে বাইরে। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই ফাঁকায় বল পেয়ে গিয়েছিলেন স্কট ম্যাক টমিনেও। কিছু না হলেও শুরুতেই বার্সা রক্ষণভাগে ঝাঁকুনি তো। শুরুর দশ মিনিট অল রেডদের চাপে পিষ্টই থাকল জেরার্ড পিকের নেতৃত্বের রক্ষণভাগ। বার্সার রক্ষণভাগের নিজেদের বক্সের মধ্যেও পাস খেলার খ্যাতি আছে। কিন্তু আজ র্যাশফোর্ডদের প্রেসিংয়ে বল বিপদমুক্ত করতে পারলেই যেন বাঁচেন পিকেরা। তবে ব্যাচের বয়স বাড়ার সঙ্গে কর্তৃত্ব চলে আসে মেসির দলের কাছে। পরিষ্কার করে বললে মেসির পায়ে।
ঘরের মাঠ ন্যু ক্যাম্পে মাস্তানি দেখিয়েছেন মেসি। তবে তাঁর দুইটি গোলেই আছে প্রতিপক্ষের অবদান। বিশেষ করে দ্বিতীয় গোলটি ইউনাইটেড গোলরক্ষক ডি গেয়ার উপহার! ১৬ মিনিটে তাঁর প্রথম গোলটা ট্রেডমার্ক। প্রতিপক্ষ লেফটব্যাক অ্যাশলে ইয়াং সময়মতো বল ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হলে পেছন থেকে তেড়েফুঁড়ে দখল নিলেন। বল নিয়ে শুরু করলেন ট্রেডমার্ক দৌড়। বাম প্রান্ত থেকে একে একে তিন ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে পেনাল্টি আর্কের ওপর থেকে বাম পায়ে দূরের পোস্টে প্লেসিং,১-০। ২০১৩ সালের পর চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে মেসির প্রথম গোল।
২০ মিনিটে মেসির দ্বিতীয় গোলটা অনেকটা উপহারের মতো। প্রথম ভুলটা করেছিলেন ফ্রেড, দ্বিতীয় ভুলটা গোলরক্ষক ডি গেয়া। স্প্যানিশ গোলরক্ষক ডি গেয়ার ভুলটাই বড়। কিন্তু ফ্রেড নিজেদের ডিফেন্ডিং জোনে ক্রুইফ টার্ন করে যেই স্পর্ধা দেখিয়েছেন, তা ইয়োহান ক্রুইফ নিজেই ন্যু ক্যাম্পে দেখাতেন কিনা, সন্দেহ আছে। যেখানে কিনা প্রতিপক্ষ দলে আছেন মেসির মতো একজন। প্রতিপক্ষের ভুল থাকলেও মেসির বল কেড়ে নেওয়ার দৃশ্যটা নিশ্চিত চোখ এড়ানোর নয়। বলটা কেড়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে ডান পায়ের নিরীহ শট ডি গেয়ার হাত ফসকে জালে। ম্যাচের জন্য বরাদ্দ তিন পয়েন্ট কার্যত তখনই কাতালান অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে।
দুই লেগ মিলিয়ে ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে সুলশারের শিষ্যরা যতই হাতে ইশারায় উজ্জীবিত দেখাক না কেন, বাস্তবতা হলো ম্যাচে ফিরতে ৩ গোলের প্রয়োজন। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে ন্যু ক্যাম্পে বার্সার বিপক্ষে এমন তো কখনোই হয়নি। এই ম্যান ইউয়ের ইতিহাস বদলানোর সামর্থ্য যে নেই, ৬১ মিনিটে ৩-০ করে প্রমাণ করে দিলেন কুতিনহো। এখানেও আছেন মেসি। আলবার এরিয়াল থ্রুটা যেভাবে ভলি করে (চামুচে) সাজিয়ে দিলেন কুতিনহোর সামনে, ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড যেন আর্জেন্টাইন তারকা সতীর্থের মান রাখলেন প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে বাঁকানো শটে অপূর্ব গোল করে।
ব্রাজিলিয়ান আর্জেন্টাইন রসায়নে আসা এই জয়ে গেরো কাটল বার্সেলোনার। আগের তিনবার এই কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমে গিয়েছিল তাদের চ্যাম্পিয়নস লিগ। এবার অন্তত ফাইনালের আগের দরজায় পা রাখল মেসিরা।