গত রাতে মেসি মাঠ থেকে বিদায় নিয়েছেন এভাবেই।
গত রাতে মেসি মাঠ থেকে বিদায় নিয়েছেন এভাবেই।

মেসির ক্যারিয়ারে যত লাল কার্ড

এককালে পৃথিবীর বিরলতম দৃশ্যের মধ্যে এটাকে ধরা হলে বলার কিছু থাকত না। ব্যাপারটা এতটাই অভিনব ছিল।

কী সেটা? বার্সেলোনার অধিনায়ক লিওনেল মেসির লাল কার্ড দেখা। ক্যারিয়ারজুড়ে মুড়িমুড়কির মতো গোল করা মেসির আরও একটা বড় কৃতিত্ব বলতে গেলে লাল কার্ড প্রায় না দেখা। মেসিকে মাঠ থেকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিতে কেমন লাগে, সেটা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন রেফারিরা। কিন্তু গত দুই বছরে দৃশ্যপট একটু হলেও বদলেছে। আন্তর্জাতিক ও ক্লাব ক্যারিয়ারে তুলনামূলকভাবে ব্যর্থ সময় কাটানোর কারণেই কি না, কয়েক বছর ধরে মেসি অনেক কিছুই করছেন, যেগুলো তাঁর সঙ্গে ঠিক যায় না।

গত রাতের কথাই ধরুন, অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনাল খেলতে নেমেছিল বার্সেলোনা। চোটের কারণে মেসি আদৌ মাঠে নামতে পারবেন কি না, সন্দেহ ছিল। কোমান তো ম্যাচের আগে সরাসরি স্বীকারই করেছিলেন, ফাইনালে মেসি মাঠে নামবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই। ওই সিদ্ধান্ত মেসি নিজেই নেবেন। নিজের শারীরিক অবস্থা বুঝে মেসি নিজেই কোচকে বলবেন, খেলবেন কি না। পরে মেসিকে শুরু থেকেই পেয়েছে বার্সেলোনা। পেয়েও লাভ হলো কোথায়? উল্টো এমন এক কারণে শিরোনাম হয়েছেন, যা কেউ ভাবেননি; অন্তত বার্সেলোনা-সমর্থকেরা তো বটেই! লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেওয়া হলো!

এমনটা যে একেবারে কখনো হয়নি, তা কিন্তু নয়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেল, গোটা ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত চারবার লাল কার্ড দেখেছেন মেসি। এর মধ্যে সিনিয়র ক্যারিয়ারে তিনবার, বয়সভিত্তিক দলে একবার। চার কার্ডের মধ্যে আর্জেন্টিনা আর বার্সেলোনার জার্সি গায়ে দেখেছেন সমান-সমান, দুবার করে। এই সুযোগে একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক...

বার্সেলোনা ‘বি’ বনাম স্পোর্ত দে তালাফায়া (২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)

মেসি তখনো বার্সেলোনার মূল একাদশে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেননি। তা হলে কী হয়েছে? যুব দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। পায়ের কারুকাজ ও ফুটবলীয় মস্তিষ্ক দিয়ে মোহিত করতেন সবাইকে। এমন সময় একদিন হুট করে লাল কার্ড দেখে বসলেন মেসি। প্রতিপক্ষ স্পোর্ত দে তালাফায়া নামের এক অখ্যাত ক্লাব। ২০০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাওয়া সে কার্ডটাই ছিল তাঁর প্রথম ‘লাল’।

আর্জেন্টিনা বনাম হাঙ্গেরি (বুদাপেস্ট, ১৭ আগস্ট, ২০০৫)

একই বছরে কয়েক মাস পর এবার জাতীয় দলের হয়ে লাল কার্ড দেখতে হয় মেসিকে, তাও আবার নিজের অভিষেক ম্যাচে!

আর্জেন্টিনার হয়ে অভিষেকেই লাল কার্ড দেখেছিলেন মেসি।

দেশের জার্সি গায়ে অভিষেক ম্যাচ খেলোয়াড়দের কত অবিস্মরণীয় স্মৃতিই না থাকে। মেসি অবশ্য নিজের জাতীয় দলের অভিষেককে ভুলেই যেতে চাইবেন। অভিষেক ম্যাচে মাঠে নামার মাত্র ৪৩ সেকেন্ডের মাথায় লাল কার্ড দেখার স্মৃতি কেই-বা মনে রাখতে চায়! পোড়খাওয়া স্ট্রাইকার লিসান্দ্রো লোপেজের বদলি হিসেবে সেদিন আর্জেন্টিনার হয়ে অভিষেক হয়েছিল লিওনেল মেসির। সে ম্যাচের মাত্র কিছুদিন আগে যুব দলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিলেন। সেই বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল আর বুট—দুটিই গিয়েছিল তাঁর দখলে। পরের মাসে জাতীয় দলে ডাকলেন কোচ হোসে পেকারম্যান। মেসির চোখে তখন স্বপ্নের মায়াঞ্জন, বয়সভিত্তিক দলে যে ঝলক দেখিয়েছেন, মূল দলেও তেমনটা করে দেখাবেন, এমনটাই আশা। তাঁকে অবশ্য প্রথমার্ধে বেঞ্চেই বসে থাকতে হলো। দ্বিতীয়ার্ধের ১৮ মিনিটে নামলেন ১৮ নম্বর জার্সি পরে। ডান দিক দিয়ে আর্জেন্টিনা ছোট ছোট পাসে আক্রমণে উঠছে। এমেসির পায়ে বল এল। মেসি ছুটলেন, সেই হরিণ-গতিতে।

জার্সি টেনে ধরে মেসিকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন নাছোড় ডিফেন্ডার ভিলমস ভানসাক। মেসি তবু ছুটলেন, যেভাবে ছোটেন। ভিলমস এবার পারলে মেসির জার্সি টেনে ছিঁড়েই ফেলেন! ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এক ঝাড়ায় ছিটকে ফেলতে চাইলেন। মেসির হাত মুখে লেগেছে কি লাগেনি, ভিলমস সে দ্বন্দ্বে যেতে চাইলেন না। যেন গোপন আততায়ীর স্নাইপারের গুলি এসে বিদ্ধ করেছে—এমন ভঙ্গিতে ছিটকে পড়ে গেলেন মাঠে। ফলাফল, গ্যাব্রিয়েল হাইন্সা-হুয়ান পাবলো সোরিন-রবের্তো আয়ালাদের প্রতিবাদের পরেও রেফারির পকেট থেকে বেরিয়ে আসে মেসির জন্য লাল কার্ড!

মেসি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। সেদিন ড্রেসিংরুমে ফিরে খুব কেঁদেছিলেন ১৮ বছর বয়সী মেসি। কিছুতেই প্রবোধ দেওয়া যাচ্ছিল না তাঁকে। পেকারম্যানও শান্ত করতে পারেননি। এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ফুঁসে উঠেছিলেন সদ্যপ্রয়াত কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এর পেছনে দেখেছিলেন ষড়যন্ত্র, শুরুতেই মেসিকে প্রবল একটা মানসিক ধাক্কা দেওয়া।

আর্জেন্টিনা বনাম চিলি (সাও পাওলো, ৮ জুলাই, ২০১৯)

অভিষেকের সেই লাল কার্ডের পর কেটে গেল ১৪ বছর। ক্যারিয়ারে নতুন নতুন উচ্চতায় উঠলেন মেসি। জাতীয় দলের হয়ে দলগত শিরোপার ভাঁড়ারটা যদিও শূন্য। ক্যারিয়ারের এই লগ্নে কেমন যেন হয়ে উঠলেন এই তারকা। প্রমাণ পাওয়া গেল ২০১৯ কোপা আমেরিকার তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে। ফাইনালের স্বপ্ন আগেই শেষ হয়ে যাওয়া মেসিদের সে ম্যাচে পাওয়ার তেমন কিছুই ছিল না। সান্ত্বনার জয়টাই খুঁজছিলেন মেসিরা। এমন অবস্থায় বিতর্কিত এক লাল কার্ড দেখেন লিওনেল মেসি।

ঘটনাটা ২০১৯ কোপার।

ম্যাচের তখন ৩৭ মিনিট। চিলির বিপৎসীমার মধ্যে বল দখলের লড়াইয়ে গ্যারি মেডেলকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। সেটি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, তখন পরিষ্কার বোঝা যায়নি। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় চিলি অধিনায়ক যা করলেন, তা অবিশ্বাস্য, চোখ রগড়ে বারবার দেখতে হয়। পেছনে ঘুরেই তিনি শরীর দিয়ে গুঁতোতে শুরু করেন মেসিকে। হঠাৎ এ আক্রমণের পাল্টা জবাব দেননি মেসি। দুই হাত তুলে চিলি অধিনায়কের প্রতিটি গুঁতোয় পিছিয়েছেন দু-এক পা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন রেফারি মারিও ডিয়াজ দে ভিভার। ছুটে এসে সরাসরি লাল কার্ড দেখালেন দুজনকেই!

পরের দৃশ্যটা আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা ভুলে যেতে চাইবেন। অনেক প্রত্যাশা নিয়েও কোপা আমেরিকার সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ার দুঃখ তো আছেই। সঙ্গে মেসির বিতর্কিত এ লাল কার্ড। যেখানে ভিডিও রিপ্লেতে দেখা গেছে, লাল কার্ড পাওয়ার মতো অপরাধ করেননি আর্জেন্টাইন তারকা। বড়জোর হলুদ কার্ড দেখানো যেত। কিন্তু রেফারি কী ভেবেছিলেন কে জানে! পরে মেসি নিজেও চুপ করে থাকেননি। বরং এভাবে বলা যায়, লাল কার্ড দেখার মতো অপরাধ না করেও লাল কার্ড দেখার পর মেসি যেন অন্য মানুষই হয়ে গিয়েছিলেন! এর আগে বহুবার রেগেছেন, ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, কিন্তু সেই রাগ দিয়ে কথার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন খুব কমই। কিন্তু এই লাল কার্ড দেখার পর আর আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের সহ্য হয়নি। চিলিকে ২-১ গোলে হারিয়ে আর্জেন্টিনা তৃতীয় স্থান নিশ্চিতের পর পদক নিতে মঞ্চে যাননি মেসি। সোজাসাপটা বলেছিলেন, কনমেবল কোপা আমেরিকার শিরোপা ব্রাজিলের হাতে তুলে দিতে সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করছে, যার ফল ওই লাল কার্ড!

বার্সেলোনা বনাম অ্যাথলেটিক বিলবাও (সেভিল, ১৮ জানুয়ারি, ২০২১)

আপাতত ক্যারিয়ারের সর্বশেষ লাল কার্ডটা দেখলেন মেসি গত রাতে। স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনালে দল তখন ৩-২ গোলে পিছিয়ে, এমন সময়ে মেসির হলো মতিভ্রম। অ্যাথলেটিক বিলবাও বক্সের বাইরে বল পেয়েছিলেন মেসি। বাঁ প্রান্তে সতীর্থকে বল ঠেলে বিলবাওয়ের বক্সে ঢুকতে দৌড় শুরু করেছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা। তাঁকে বাধা দিতে পাশ থেকে সামনে গিয়ে পড়েন বিলবাওয়ের স্ট্রাইকার আসিয়ের ভিয়ালিব্রে। ম্যাচে যেকোনো মুহূর্তে শেষ বাঁশি বাজবে, এর মধ্যে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের সামনে পড়ে দৌড়ে বাধা দেওয়ায় সম্ভবত মেজাজ হারান বার্সা তারকা। ভিয়ালিব্রের মাথায় চাটি মেরে বসেন!

মেসির এই অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির (ভিএআর) চোখ এড়ায়নি। মেসি যখন ভিয়ালিব্রেকে চাটি মারেন, তখন পায়ে বলও ছিল না। ‘অফ দ্য বল’ মুহূর্তে এমন মারাত্মক অপরাধের জন্য লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়েছে মেসিকে। বার্সাও ম্যাচটা হেরেছে ৩-২ ব্যবধানে। বার্সার মূল দলে ৭৫৩ ম্যাচের ক্যারিয়ারে এটাই প্রথম লাল কার্ড মেসির।

ক্যারিয়ার শেষে এই তালিকাকে অবশ্যই আর দীর্ঘ করতে চাইবেন না মেসি!