১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক জাতীয় দলের সদস্য ছিলেন শরিফুজ্জামান। সেই দলে ছিলেন তাঁর বড় ভাই নওশেরুজ্জামানও। দুই ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। থাকতেন শহীদুল্লাহ হলে। নওশের জীববিজ্ঞানে, শরিফ পদার্থবিদ্যায়। ঢাবির ছাত্র থাকাকালেই ১৯৭১ সালে নওশের স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে খেলতে চলে যান ভারতে।
তার আগেই শরিফুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নেই শরিফের নাম। এ নিয়ে মোহামেডানের সাবেক মিডফিল্ডারের মনে অনেক ক্ষোভ। কানাডা থেকে মুঠোফোনে মুক্তিযুদ্ধসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে কথা বললেন শরিফুজ্জামান।
শরিফুজ্জামান: বছর চারেক আগে প্রথম টরন্টো আসি। এখানে আমার দুই ছেলে ও একমাত্র মেয়ে থাকে। স্ত্রীসহ আমিও এখানে আছি। ভালোই আছি। তবে দেশকে খুব মিস করি।
শরিফুজ্জামান: পড়ে না আবার! ও ছিল আমার দেড় বছরের বড়। একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। কত স্মৃতি আছে ভাইয়ের সঙ্গে! সাত ভাইয়ের মধ্যে আমরা পাঁচ ভাই ঢাকার প্রথম বিভাগে খেলেছি। একটা ফুটবল পরিবার আমরা। সেই পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করে নওশের গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর করোনার কাছে হার মেনে চলে গেল পরপারে। ভীষণ খারাপ লাগে ওর কথা মনে হলে। কদিন আগে গেল ছোট ভাই আরিফুজ্জামান।
শরিফুজ্জামান: ভীষণ দোলা দেয়। ১৯৭৬ সালে আমি, নওশের ও আরিফুজ্জামান—আমরা তিন ভাই একসঙ্গে মোহামেডানে খেলি সম্ভবত একটা ম্যাচ। কার বিপক্ষে ঠিক মনে নেই। ওয়ারী হতে পারে। তখন মোহামেডানে ১ নম্বর গোলকিপার শহিদুর রহমান সান্টু। স্বাভাবিকভাবেই আরিফের সুযোগ পাওয়া ছিল কঠিন।
শরিফুজ্জামান: হ্যাঁ, ১৯৬৯ সালে ফায়ার সার্ভিস দিয়ে ঢাকার প্রথম বিভাগে আমার অভিষেক। পরের বছরও একই দলে খেলি। ১৯৭২-১৯৭৪ ওয়াপদা হয়ে ১৯৭৫, ১৯৭৬ মোহামেডানে কাটাই। ১৯৭৭ সালে ওয়াপদায় গিয়েছিলাম অধিনায়ক হয়ে। ১৯৭৯ সালে ওয়াপদার জার্সিতে অবসর নিই। ১৯৭৩ সালে জাতীয় দলের জার্সিতে মারদেকায় খেলেছি। তবে ১৯৭৫ সালে মারদেকাগামী দলে ডাক পেলেও চোটের কারণে যেতে পারিনি। সেই আক্ষেপ আজও আছে আমার। অথচ সব তৈরিই ছিল। আমার নামে মারদেকা কর্তৃপক্ষ পাসও তৈরি করে।
শরিফুজ্জামান: খুব মনে পড়ে। ১৯৭৫ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে সেই হ্যাটট্রিকের পর সমর্থকেরা খুশি হয়ে ১০ টাকার নোটের মালা বানিয়ে আমাকে পরিয়ে দেন। আমাকে কাঁধে নিয়ে তাঁরা নাচতে নাচতে ক্লাবে নিয়ে যান। সেই ম্যাচে আমরা ৩-০ গোলে জিতেছিলাম। সে বছর নওশের ঢাকা লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিল। নওশেরের কথা খুব মনে পড়ছে। ফুটবল, মুক্তিযুদ্ধ...সেই দিনগুলো ভুলতে পারি না।
শরিফুজ্জামান: অবশ্যই মনে পড়ে। সবকিছু চোখের সামনে ভাসে। যুদ্ধ, অস্ত্র, গুলি...কত কী যে ঘটেছে, সেই বর্ণনা শেষই হবে না। ৭১ বছরের জীবনে সেসব মনে করেই এখন সময় কাটে প্রবাসে।
শরিফুজ্জামান: ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ থেকেই আসলে যুদ্ধের দামামা বেজে যায়। আমি আর নওশের তখন ঢাবির ছাত্র। ওই দিন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল। হঠাৎ করাচি থেকে খবর আসে, জাতীয় পরিষদ বসবে না। আমরা বের হয়ে গেলাম স্টেডিয়াম থেকে। সবার রক্ত টগবগ করছে। প্রতিবাদ হলো। তারপর থেকে যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে যাই হাতে বাঁশ নিয়ে। এরপর ১২ মার্চ আমি মুন্সিগঞ্জ চলে এলাম।
শরিফুজ্জামান: না, আমরা তখনো সংগঠিত হইনি। মুন্সিগঞ্জে এলেন বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দিন ভাই। আমরা তাঁর বক্তৃতা শুনে উজ্জীবিত হলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধ করব। কিন্তু অস্ত্র পাব কোথায়? বন্ধুবান্ধবসহ ২০০-৩০০ জন মিলে ২৭ মার্চ মুন্সিগঞ্জ ট্রেজারি লুট করলাম। আমার দুই পকেটে থ্রিনটথ্রি রাইফেলের গুলি নিই। আমার বড় ভাই বদিউজ্জামান খসরু সবাইকে মুন্সিগঞ্জ মাঠে ট্রেনিং দেন।
১৯৭১ সালে শরিফুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নেই তাঁর নাম
শরিফুজ্জামান: ঠিক তা-ই। ঢাকা থেকে তখন আজরা লঞ্চ মুন্সিগঞ্জ ঘাটে এসে ভেড়ে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট দখল করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা ২৭ জন সেই আজরা লঞ্চে উঠে পড়ি। নারায়ণগঞ্জ কয়লাঘাটে গিয়ে দেখলাম, লোকজন পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে জানতে পারি, পাকিস্তানি আর্মি আসছে। আমরা কয়লাঘাটে লঞ্চ থামিয়ে হাঁটা শুরু করি। চাষাঢ়ায় গিয়ে আমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। তখন সেখানকার রেললাইনের ওপর ব্যারিকেড দেওয়া হয়। আমি গ্রামের দিকে চলে যাই। তখন পাকিস্তানি সৈন্যদের মার্চ করে আসতে দেখি। ওরা দুই পাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে থাকে। সে এক ভয়ানক দৃশ্য। আমার দুই পকেটে তখন ৪২টি গুলি। সেদিন আমি পাকিস্তানি সৈন্যদের লক্ষ্য করে ২৭ রাউন্ড গুলি করেছিলাম।
শরিফুজ্জামান: আমার আইনজীবী বাবা শিকার করতেন। শিকারে গেলে দেখাতেন, কীভাবে বন্দুকে গুলি লোড করতে হয়। এরপর বাংলাদেশ আনসারে গুলি চালানোর প্রশিক্ষণ নিই।
শরিফুজ্জামান: নারায়ণগঞ্জের ওই অপারেশনে চারজন বাঙালি মারা গেছে, এমনটাই রটে যায় মুন্সিগঞ্জে। মুন্সিগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিনের ছোট ভাই খালেকুজ্জামান খোকা, রফিক, গোলাম হোসেন ও আমি—এই চারজন। মুন্সিগঞ্জে আমাদের জানাজাও হয়ে যায়। চারদিকে কান্নার রোল পড়ে। কিন্তু আসল ঘটনা অন্য। রফিক আর আমি বেঁচে ছিলাম। ওই দিন রাত সাড়ে তিনটায় আমি মুন্সিগঞ্জের বাড়ি গেলাম। আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মহিউদ্দিনের আরেক ছোট ভাই আনিসুজ্জামান।
শরিফুজ্জামান: এক মাস পর মুন্সিগঞ্জে পাকিস্তান আর্মি এল। আমরা মুন্সিগঞ্জের গ্রামের দিকে চলে যাই। এই ফাঁকে ভারতের দেরাদুন থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসেন মোহাম্মদ হোসেন বাবুল ও খোকা। বাবুলের নেতৃত্বে আমাদের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা হয়। আমরা ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করি। আমি ছিলাম বাইগ্যা ক্যাম্পে।
শরিফুজ্জামান: এটা মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে কয়েক মাইল ভেতরে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ২৮ থেকে ৩০ জন। রাতে একজনের পর একজন ক্যাম্প পাহারা দিতাম। মাটির ঘরে পাটি বিছিয়ে শোয়া। একদিন রাত তিনটায় হলো এক কাণ্ড। তারা মিয়া নামের একজন তার দায়িত্ব শেষ করে এল ঘুমাতে। ওই সময় অন্যরা ঘুমাবে আর আমার ডিউটি ছিল। সেই রাতে বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাই। তারা মিয়ার রাখা রাইফেলের নলটা মাটির দিকে তাক করে ট্রিগার চাপি। বিকট শব্দে গুলিটা চলে যায় এক থেকে দেড় ফুট নিচে। পাশেই শোয়া তারা মিয়া। সে তো উঠে গিয়ে ভাবল, অ্যাটাক হলো মনে হয় আমাদের ক্যাম্পে। সবাই উঠে গিয়ে পজিশন নিয়ে নিল। সে এক হুলুস্থুল কাণ্ড।
শরিফুজ্জামান: সেই শঙ্কা সব সময়ই ছিল। তাই যতটা সম্ভব সতর্ক থেকেছি। তবে সেই দিনগুলো অনেক কষ্টের ছিল। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করতাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতাম পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। ওদের দেখলে একটা করে গুলি করে আবার পালিয়ে যেতাম। সম্ভবত ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তান আর্মি মুন্সিগঞ্জ ছাড়ল। আমরা ফিরে আসি মুন্সিগঞ্জে।
শরিফুজ্জামান: আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছি। তবে অস্ত্র জমা দেওয়ার পর মনে হলো, আমি নিঃস্ব।
শরিফুজ্জামান: জেনারেল এরশাদের সময় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমার নাম ছিল। এরপর বিএনপি তালিকা করল, আওয়ামী লীগ পরে করল। আবেদন করতে বলা হলো। আমি কি আবেদন করে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করব? তারপরও বর্তমান সরকার গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে আমি গেছি। সাক্ষাৎকার দিয়েছি। কিন্তু কদিন আগে জানতে পারলাম, সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমার নাম নেই। কী আর বলব, আমি হতাশ, ব্যথিত।