মাশরাফি পারলে আমি কেন পারব না?

শেখ জামালের জার্সিতে আলি হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।
শেখ জামালের জার্সিতে আলি হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।
>

• প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন আলি হোসেন।
• আলিকে দুবার লিগামেন্ট অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে।
• অস্ত্রোপচারের আগে আলি অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় দলে খেলেছিলেন।

তাঁর ডান পা’টা বড্ড বেশি অভিমানী। যার সাক্ষী হয়ে আছে হাঁটুর পাশে এফোঁড়-ওফোঁড় করা সেলাইয়ের আঁচড়। প্রতিটি সুইয়ের ফোঁড়ই একেকটা চাপা কষ্ট। সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেরণাও। তা না হলে যে ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে এসে স্বপ্নের হাতছানি পাওয়া হতো না আলি হোসেনের। হাঁটুতে দুই-দুইটা অস্ত্রোপচার জয় করে এখন জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্পে। তা-ও আবার লিগামেন্টে অস্ত্রোপচার। লিগামেন্ট—যার নাম শুনলেই গা শিউরে ওঠে দেশের ফুটবলারদের।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লিগামেন্টে অস্ত্রোপচার করা মানেই মাঠ থেকে কমপক্ষে এক বছরের ছুটি। আবার সেখান থেকে সুস্থ হয়ে খুব কম ফুটবলারই স্বরূপে ফিরতে পারেন মাঠে। গাজীপুর জেলার আলি সেখানে ব্যতিক্রম। একই হাঁটুতে দুবার অস্ত্রোপচার করিয়ে শুধু নামকাওয়াস্তে মাঠেই ফেরেননি, জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয় দলেও। কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার জোরেই ‘লিগামেন্ট অস্ত্রোপচার’ জয় করেছেন। তাঁর এই বিজয় অভিযানে অনুপ্রেরণা হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহানায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও। অলক্ষ্যে তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন মাশরাফি। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) জাতীয় দলের ক্যাম্পে বসে শোনালেন সেই গল্প।

হেডে বল ক্লিয়ার করছেন আলি হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।

বয়সভিত্তিক (অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-২০) জাতীয় দল পেরিয়ে আলি তখন ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। টগবগে এ মিডফিল্ডার চষে বেড়ান পুরো মাঠ। ২০০৭ সালে ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুলের অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে খেলছিলেন বিজয় দিবস টুর্নামেন্টে। কিন্তু খেলোয়াড়দের নিষ্ঠুরতম শত্রু ইনজুরি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সরাসরি পাঠিয়ে দিল ছুরির নিচে। চিকিৎসা করানোর মতো হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তাই এর-ওর কাছ থেকে টাকাপয়সা জোগাড় করে কলকাতা গিয়ে করালেন অস্ত্রোপচার। এক ধাক্কায় মাঠের বাইরে দুই বছর।

২০০৯ সালে ফরাশগঞ্জের জার্সিতে পেশাদার (পড়ুন নামে) ফুটবল লিগ দিয়ে ফেরা। কিন্তু ভাগ্যদেবী আবারও মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন অস্ত্রোপচারের টেবিলে। দেশের ফুটবলে যে দুরবস্থা, দুবার এত বড় ইনজুরির শিকার হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো থেমেই যেতেন। আলি না থেমে ইনজুরিকে দেখিয়ে দেওয়ার শপথ নিলেন। আবার টাকাপয়সা জোগাড় করে অস্ত্রোপচার করালেন কলকাতায় গিয়ে। এরপর শুরু হলো মাঠে ফেরার আসল যুদ্ধ।

জিমে দুইবেলা হাড়ভাঙা পরিশ্রম। পরবর্তী ধাপ, মাঠে গিয়ে ঘাম ঝরানো। কাছের মানুষগুলো নাকি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘অমানবিক পরিশ্রম’। কিন্তু আলির স্বপ্ন—খেলতেই হবে ফুটবল, ‘সুস্থ হওয়ার জন্য আমি প্রচুর পরিশ্রম করেছি। কারণ ফুটবল খেলা ছাড়া আমার সামনে কোনো পথ ছিল না। ফুটবলের জন্য লেখাপড়া ছেড়েছি। ফুটবল আমাকে খেলতেই হতো। এটা ছিল আমার নিয়ত ও জিদ।’

এই কষ্টের সময়ই নাকি তাঁর সামনে অনুপ্রেরণা হয়ে এসেছিলেন ক্রিকেটের মাশরাফি, ‘আমি চিন্তা করেছি, মাশরাফি ভাই এতগুলো অপারেশন করে মাঠে খেলতে পারলে আমি কেন পারব না?’

গোলের পর সতীর্থ রাফায়েলের সঙ্গে আলি হোসেনের উচ্ছ্বাস। ছবি: সংগৃহীত।

আসলে বাস্তবতা মানলে জীবনযুদ্ধে মাশরাফির চেয়ে কোনো অংশে কম যাননি আলি। কেননা, মাশরাফির মতো উন্নত চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না আলির। মাঠে ফেরার জন্য যে রিহ্যাব প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করাও ছিল আলির জন্য কষ্টের। তাই আবার মাঠে ফিরতে লেগে যায় দুই বছর। সব বাধা জয় করে আলি ফিরলেন ২০১১ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল দিয়ে। অর্থাৎ এক ধাক্কায় প্রিমিয়ার থেকে নেমে গেলেন দ্বিতীয় বিভাগে। আলি যখন দ্বিতীয় বিভাগে খেলার জন্য লড়ছেন, তখন তাঁর বয়সভিত্তিক দলের বন্ধু মামুনুল ইসলাম, জাহিদ হোসেন, আতিকুর রহমান মিশু, নাসিরুল ইসলামরা হয়ে উঠেছেন জাতীয় দলের প্রাণভোমরা।

এরপর কঠোর পরিশ্রম করে ফেনী সকার, রহমতগঞ্জ ও শেষ মৌসুমে শেখ জামালের জার্সিতে খেলে ডাক পেয়েছেন জাতীয় দলে। এমন একটা সময়ে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার অপেক্ষায় যখন তাঁর বন্ধুরা ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছেন জাতীয় দল থেকে। নিজের ডাক পাওয়াটা তাই চমক ও আফসোসে বর্ণনা করলেন আলি, ‘জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা আমার কাছে বড় চমক। অনেক পরিশ্রমের ফল পেলাম আমি। কিন্তু নিজের সেরা সময়ে যদি জাতীয় দলে খেলতে পারতাম, ক্যারিয়ারটা অনেক বড় হতো।’

জাতীয় দলের ক্যাম্পে প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয় আলিকে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নামতে পারেন না। হাঁটু দুটো কয়েকবার ভাঁজ করতে হয়, সোজা করতে হয়—তারপর শুরু হয় দিন। মাঝেমধ্যে রাতগুলোও হয়ে ওঠে আতঙ্কের। তবে ভয়ংকর রাতগুলো আলির স্বপ্নের কাছে খুবই ঠুনকো। তাই তো আলি পরিশ্রমের ওপর ভাগ্য সঁপে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বীরদর্পে। তাঁর মনে সব সময় রিংটোনের মতো বাজে, ‘কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা কখনো বিফলে যায় না।’