মাঠটাই 'ডাইলপট্টির' গর্ব

পুরান ঢাকায় রহমতগঞ্জ ক্লাব ভবন l প্রথম আলো
পুরান ঢাকায় রহমতগঞ্জ ক্লাব ভবন l প্রথম আলো

কোরবানির গরুর হাটের জন্য মাঠের এক পাশে বাঁশ পোঁতা চলছিল কদিন আগে। বাকি অংশে দল নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত ছিলেন কোচ কামাল বাবু। মাঠে তখন এলাকার শত শত ছেলে। সেই অনুশীলন দেখতে মাঠের পাশে চেয়ার পেতে বসে ক্লাব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মালাসহ আরও কয়েকজন। ১৯৬৬ সালে রহমতগঞ্জের তৃতীয় বিভাগ দলে খেলা শুরু করার পর থেকে সুখ-দুঃখের সাথি হয়ে থাকায় এই ক্লাবের প্রতীক হয়ে গেছেন মালা। পেছনে তাকিয়ে বলছিলেন, ‘এই যে মাঠটা দেখছেন, এটা সেই ষাটের দশক থেকেই রহমতগঞ্জ ক্লাবের মাঠ।’

মরহুম মইনুল ইসলাম এখানে মাটি ফেলে বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে মাঠটা তৈরি করেন। ভাগ্যিস, বাংলাদেশে মাঠ ধ্বংস করার সংস্কৃতির চোরাবালিতে রহমতগঞ্জ মাঠ বিলীন হয়ে যায়নি! ঢাকার অনেক কথিত ‘পেশাদার’ বড় দলেরই মাঠ নেই। যেখানে রহমতগঞ্জ এই গর্বটা করতে পারে।

কোচ কামাল বাবু অবশ্য খুব দ্রুতই বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, ‘ঈদের আগে আজই এই মাঠে শেষ অনুশীলন। কোরবানির গরুর হাটের প্রস্তুতি চলবে এখন।’ এই গরুর হাট বসিয়ে পাওয়া অর্থ দিয়েই রহমতগঞ্জ ফুটবল দলটা মূলত চলে। কিন্তু কোরবানির ঈদের পর সেই কামাল বাবু মহা সমস্যায় পড়েছেন। মাঠের অবস্থা আগেও খুব সুবিধার ছিল না, কোরবানির হাটে সেটি এখন আরও বেহাল। এখন আর অনুশীলনের জন্য মাঠ পাওয়া যাচ্ছে না। ‘ঈদের পর কমলাপুর স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখি চারটি দল অনুশীলন করতে বসে আছে, ফাঁকা নেই। এদিক-ওদিক মাঠ খুঁজি কিন্তু পাই না।’ রহমতগঞ্জ কোচ হতাশ ও বিরক্ত।

এক কোটি টাকার মতো ওঠে হাট থেকে, খরচ বাদ দিয়ে নাকি ৭০-৮০ লাখ থাকে। মাঠটা তাই বড় বেশি উপকারী রহমতগঞ্জের জন্য। কিন্তু অবকাঠামো বলতে আর তেমন কিছু নেই। টিকে থাকার লড়াই-ই চলে নিরন্তর। ক্লাবের দশ-বারোটা দোকান, কারখানার জায়গা ভাড়া দিয়ে কিছু টাকা আসে। কিন্তু ক্যাম্প খরচ ও খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক মিলিয়ে বছরে খরচ প্রায় দুই কোটি টাকা।

সাংসদ রহমতউল্লাহ ক্লাব সভাপতি থাকার সময় নব্বইয়ের শেষ দিকে টিনশেড থেকে পাকা হয় ক্লাব ভবন। পরে নাসির উদ্দীন পিন্টু সভাপতি হয়ে দোতলা করেন। সেখানে খেলোয়াড়দের থাকার ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো। কক্ষগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। অত্যাধুনিক না হলেও ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ বলে খুশি খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা।

বড় একটা মাঠই আছে রহমতগঞ্জের l প্রথম আলো

ক্লাব ভবন-মাঠ-দোকানপাট মিলিয়ে ক্লাবের জায়গা প্রায় ১০ বিঘা। মোটামুটি বড় স্থাপনাই। তবে কোনো জিম নেই। যদিও এটি করার প্রতিশ্রুতি দিলেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ হামিদ, ‘জিমের কিছু সরঞ্জাম আছে। পূর্ণাঙ্গ একটা জিম আমাদের কর্মসূচির মধ্যে আছে।’ এই পেশাদারির যুগে বড় দলেরই ফিজিও-ট্রেনার নেই। রহমতগঞ্জও ব্যতিক্রম নয়। দলটির নিজস্ব বাহনেরও ব্যবস্থা হয়নি এত দিনেও। পুরান ঢাকার ‘ডাইলপট্টি’ থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ম্যাচের দিন রহমতগঞ্জের খেলোয়াড়েরা আসেন টেম্পো বা ম্যাক্সিতে। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি বাস কেনার প্রতিশ্রুতি দেন সাধারণ সম্পাদক।

স্বপ্ন আছে তাঁর, কিন্তু তা পূরণ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক সংকট। বড় দলগুলো গড়ে খেলোয়াড় প্রতি ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ করছে, রহমতগঞ্জে এবার সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ৮ লাখ টাকা। যার ৬ লাখ অগ্রিম পেয়েছেন অধিনায়ক শাহেদ। তবে এক-দেড় লাখ টাকা চুক্তির খেলোয়াড়ও আছেন। অগ্রিম কিছু নিয়ে হয়তো ৫-৭ হাজার টাকা মাসিক বেতনেও খেলেন। রহমতগঞ্জে দল গড়ার দায়িত্বটা পালন করেন কোচ। অন্য অনেক ক্লাবে যা করেন কর্মকর্তারা। এই জায়গায় রহমতগঞ্জ একটু আলাদা। সেই ফলও তারা পাচ্ছে কামাল বাবুর অধীনে মাঝেমধ্যেই চমক দেখিয়ে।

দলটিতে সহকারী বা গোলরক্ষক কোচ কিছুদিন আগেও ছিল না। নামমাত্র হলেও এখন দুটিই আছে। এটা একটা ‘অগ্রগতি’ বটে। আগে একজন কোচকে মুখে মুখে বলা হতো, ‘ভাই আপনি একটু আসেন। দলটা দেখেন।’ এখন দিন বদলাচ্ছে। যেনতেন হলেও কোচের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে। তবে রহমতগঞ্জসহ ছোট দলগুলো এখনো কোচকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে পারে না। কোচিং স্টাফ শক্তিশালী নয়। রহমতগঞ্জ এখনো আসলে দল গড়ে টিকে থাকার জন্যই। ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি ১৯৭৭ সালে লিগ রানার্সআপ হয়েছিল। সেটিই এখন পর্যন্ত রহমতগঞ্জের সেরা সাফল্য।

মোহাম্মদ মালা এসব নিয়ে আক্ষেপ করেন, ‘আমাদের সময় সুযোগ-সুবিধা ছিল না তেমন। এই মাঠটা ছিল, ক্লাবঘরটা ছিল মহল্লার মধ্যে। কোচিং স্টাফে এক-দুজন ছিল। এখন তো লোকবল বেড়েছে। তবে যেখানে থাকা উচিত ছিল, আমরা সেখানে যেতে পারিনি।’ পেশাদারির প্রসঙ্গ তুললে হতাশা ঝরে কণ্ঠে, ‘পেশাদার তখনই হতে পারবেন, যখন আপনার হাতে টাকা থাকবে।’

তবে একটু ভালো থাকা, ক্লাবটাকে পরিচ্ছন্ন রাখা—এ জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লাগে না। অথচ রহমতগঞ্জসহ দলগুলো এখনো সেকেলে ব্যবস্থাপনায় চলে। পেশাদার ফুটবল নিয়ে জানাশোনা আছে, এমন লোকেরও অভাব। দাপ্তরিক কাজ করার মতো দক্ষ লোক নেই। এই যখন অবস্থা, পেশাদারির আলোচনাই আসলে অবান্তর। তবু ‘আধুনিক’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে রহমতগঞ্জের। কিন্তু ফরাশগঞ্জ বা রহমতগঞ্জের মতো দলগুলোর দিকে বড় শিল্পগোষ্ঠী ফিরে তাকায় না। তাকালে ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ অবস্থা বদলাত নিশ্চয়ই।

আছে

ক্লাব ভবন

মাঠ

প্রধান কোচ

সহকারী কোচ

গোলরক্ষক কোচ

 নেই

জিম

ফিজিও

ট্রেনার

ডাক্তার

যুব দল

যুব পরিকল্পনা

বিপণন কর্মকর্তা

 বন্ধুর পথচলা

নয়টি পেশাদার লিগের প্রথম পাঁচটিতে টানা খেলেছে। দুই লিগ অবনমিত থেকে এবার টানা তৃতীয় লিগ। পয়েন্ট তালিকায় অবস্থান—একাদশ, সপ্তম, অষ্টম, অষ্টম, একাদশ, দশম, সপ্তম।

পেশাদার লিগে এখন পর্যন্ত মোট ১৫৪ ম্যাচ খেলে ৩৭ জয় ও ৮৬ হার, ড্র ৩১। তিনটি লিগে ৭টি করে জয়। ২০ ম্যাচের লিগে ১৫ ম্যাচ হারের বাজে অভিজ্ঞতা আছে। ১৬৮ গোল করে খেয়েছে ২৯২ গোল।