রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা আর জুভেন্টাস এখন দাবি করতে পারে, তাহলে তাদের পরিকল্পিত ইউরোপিয়ান সুপার লিগের সঙ্গে প্রস্তাবিত নতুন নেশনস লিগের পার্থক্য কোথায় থাকছে?
গত এপ্রিলে বার্সা-রিয়ালসহ ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১২ ক্লাব ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ইউরোপিয়ান সুপার লিগ বাজারে আনতে যাচ্ছে। কেন? চ্যাম্পিয়নস লিগের বর্তমান ছক তাদের পছন্দ নয়। তার চেয়েও বড় আপত্তি চ্যাম্পিয়নস লিগে আয়ের বণ্টনে তাদের ভাগ নিয়ে। উয়েফার হুমকি-ধমকি আর সমর্থকদের প্রতিবাদের মুখে প্রথম দফায় তাদের পিছু হটতে হয়েছে বটে, কিন্তু রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ, বার্সা সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা, জুভ সভাপতি আন্দ্রেয়া আনিয়েল্লি নেপথ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সুপার লিগের পরিকল্পনা নিয়ে।
সে নিয়ে বিতর্ক-আলোচনা শেষ হয়নি, এর মধ্যে উয়েফা আর কনমেবল গতকাল অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৪ সাল থেকে নেশনস লিগে যোগ দেবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাসহ লাতিন আমেরিকার দশ দলও। অর্থহীন প্রীতি ম্যাচের বদলে আসা নেশনস লিগে এত দিন শুধু ইউরোপের দলগুলো খেলত, শুধু উয়েফার আয়োজনে হতো। ধীরে ধীরে প্রতিটি মহাদেশে টুর্নামেন্টটা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ফিফার। এর মধ্যেই নিজেরা এক হয়ে একটা টুর্নামেন্টের ছাতায় চলে আসার পেছনে উয়েফা আর কনমেবলের উদ্দেশ্য কী?
রিয়াল-বার্সা ‘সুপার লিগ’ আনতে চাইছে উয়েফাকে অমান্য করে, এখানে নতুন ছকের নেশনস লিগও কি ফিফার বাইরে গিয়ে কিছু করতে কনমেবল আর উয়েফার পরিকল্পনা? শেষ পর্যন্ত এই টুর্নামেন্ট আলোর মুখ দেখলে ফিফার বিশ্বকাপের কী হবে?
উয়েফা-কনমেবলের এমন পরিকল্পনার কারণ ভাবতে খুব বেশি দূর যেতে হয় না। ফিফার সাম্প্রতিক কার্যক্রমে চোখ রাখলেই সেটি বোঝা যাবে। জিয়ান্নি ইনফান্তিনো সভাপতি হওয়ার পর থেকে কি ক্লাব, কি জাতীয় দলে, ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানোর একের পর এক পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হয়েছে ফিফা। ইউরোপের ক্লাবগুলোকে সেটি বিরক্ত করেছে। আর বিরক্তির শেষ সীমায় তারা চলে গেছে ফিফার সর্বশেষ পরিকল্পনায়—দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ!
ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যেই এ নিয়ে অসন্তোষ আছে। চার বছর পর বিশ্বকাপের আমেজ-আকর্ষণ যতটা, দুই বছর পরপর হলে ততটা থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অর্থ যেখানে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে দর্শকের আবেগের গুরুত্ব সামান্যই। একটা টুর্নামেন্ট মানে ম্যাচের আকর্ষণের চেয়েও একটা ‘প্যাকেজ’, একটা উৎসবের আবাহন। বিজ্ঞাপনী আয় থাকে সেখানে, স্পনসরদের ভিড় থাকে। আয়ের কমতি তাই হয় না।
দুই বছর পরপর ফিফার বিশ্বকাপ আয়োজনের আগ্রহ তাহলে আর কমবে কেন!
আর এই আগ্রহকে বৈধতা দিতে হবে? গায়ে ‘গণতন্ত্রে’র চাদর পরানোর সুযোগ তো সব সময়ই আছে। দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ মানে বিশ্বের আরও বেশি দল সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা, আফ্রিকা-এশিয়া-ওশেনিয়ার মতো ফুটবলে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর কাছে এই ‘বিজ্ঞাপন’ বিক্রি করা যায় সহজেই। ফিফা বিক্রি করেছেও। পাশাপাশি বেশি টুর্নামেন্ট মানে ফিফার কাছ থেকে এই অঞ্চলের দেশগুলোর ফেডারেশন আগের চেয়ে বেশি অর্থ পাবে। দুই বছর পরপর বিশ্বকাপের আয়োজনে এই অঞ্চলগুলোর কাছ থেকে ‘হ্যাঁ’ ভোট পেতে তাই ফিফার কষ্ট হয়নি।
কিন্তু উয়েফা আর কনমেবলের কি ঠেকা পড়েছে? দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ মানে ইউরো আর কোপা আমেরিকার আয়োজনে ঝামেলা। বিশেষ করে ইউরোর আয়োজনে, সেখানে তো মূল টুর্নামেন্টের আগে বাছাইপর্বও আছে! দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ হলে ইউরোর বাছাইপর্বই কখন হবে, আর মূল পর্ব কীভাবে হবে?
এ তো গেল জাতীয় দলগুলোর টুর্নামেন্টের কথা। দ্বিবার্ষিক বিশ্বকাপ মানে ক্লাব ফুটবলের মৌসুম শেষে খেলোয়াড়দের বিশ্রামের সুযোগও কমে যাচ্ছে।
এমনিতেই বিশ্বকাপ-ইউরো-কোপা আমেরিকার বছরগুলোতে খেলোয়াড়দের চোটের পরিমাণ বেড়ে যায়। গবেষণা বলে, জুন-জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের বছরগুলোতে ক্লাবের খেলোয়াড়দের শতভাগ ফিটনেস ফিরে পেতে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ক্লাবগুলো কেন ফিফার পরিকল্পনায় অখুশি, তা সহজেই বোঝা যায়।
কিন্তু খেলোয়াড়দের শারীরিক অবস্থার চেয়েও এখানে অর্থ আর ক্ষমতাই তো দিন শেষে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য। যত সিদ্ধান্ত, যত বিদ্রোহের কারণ শেষ পর্যন্ত অর্থের চাহিদা আর জোগানে ব্যবধান এবং ক্ষমতার খেলায় আরও ওপরের সিঁড়িতে যাওয়ার লিপ্সা। ঠিক যে কারণে ইউরোপিয়ান সুপার লিগও অনেক দিন ধরেই ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর মাথায় ঘুরছে।
খুব সহজ হিসাব। এ পর্যন্ত ২১ বিশ্বকাপের সব কটি জিতেছে হয় ইউরোপ নয়তো লাতিন দেশ। টুর্নামেন্টের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেও এই দলগুলোই। তাহলে উয়েফা আর কনমেবল কেন তাদের দাপট আরও বাড়াতে চাইবে না? তাদের আপত্তি, পরামর্শ উপেক্ষা করেই ফিফা যদি দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চায়, তারা সে ক্ষেত্রে তাদের অর্থ আর ক্ষমতার জোর দেখিয়ে ফিফাকে পাল্টা ধাক্কা দিতে চাইবেই! সেটিই হচ্ছে।
তাতে বিশ্বকাপের ভাগ্য পড়ে যাচ্ছে সংশয়ে। ভেবে দেখুন না, ঘানা-ক্যামেরুন কিংবা জাপান-কোরিয়ার মতো দল বিশ্বকাপে বাড়তি রং নিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু মানুষের আকর্ষণ তো সেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগালের মতো দলগুলোকে ঘিরে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৪ সাল থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন নেশনস লিগে এই সব দলই একই লিগে খেলবে। ইউরোপের সেরা ১৬ দলের পাশাপাশি লাতিন সেরা ৬ দল...প্রস্তাবিত নেশনস লিগের গ্রুপ ‘এ’-ই তো বিশ্বকাপের সব আকর্ষণ কেড়ে নিতে যথেষ্ট!
খেলোয়াড়েরা নিজেরাও এ নিয়ে রোমাঞ্চিত। গতকাল নেশনস লিগের ঘোষণা আসার পর আয়াক্সের আর্জেন্টাইন লেফটব্যাক নিকোলাস তাগলিয়াফিকোকে এক সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাতে তাগলিয়াফিকোর উত্তর, ‘দারুণ! আমার মনে হয় এটা বিশ্বকাপের চেয়েও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।’
এখনো নতুন ইউরোপা লিগের ঘোষণাটা আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি। হতে পারে দুই বছর পরপর বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চাওয়া ফিফাকে একটা ধাক্কা দিতেই এমন ঘোষণা দিয়েছে কনমেবল-উয়েফা। ফিফার এখনো আলোচনার টেবিলে বসার সুযোগ থাকছেই।
ধরে নেওয়া যেতে পারে, দাবার চালের মাত্র শুরু।