ব্রাজিলের সম্ভাবনা বেশি তবু প্রিয় মেসির দল

বিশ্বকাপের মাসকটটি নজর কাড়ছে সবার। তোলা হচ্ছে ছবি আর সেলফি! ছবি: এএফপি
বিশ্বকাপের মাসকটটি নজর কাড়ছে সবার। তোলা হচ্ছে ছবি আর সেলফি! ছবি: এএফপি

পাঁচটি বিশ্বকাপ ট্রফি তাদের শোকেসে শোভাবর্ধন করছে। বর্ণে, বৈচিত্র্যে, প্রভাব কিংবা বিভবে ব্রাজিল সবচেয়ে বড় দল হতে পারে, তবে দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশগুলোর সমর্থক বা সাংবাদিকদের কাছে ফুটবল উন্মাদনার মহাদেশটিতে আর্জেন্টিনাই বেশি জনপ্রিয়। নিজেদের দল আছে এই রাশিয়া বিশ্বকাপে, তবু এমন অনেককেই পাওয়া গেল যাঁরা চাইছেন এবার সোনালি ট্রফিটার গায়ে হাত উঠুক মেসির। সেদিন, ৯ জুন যেমন পাওয়া গেল পেরুর পাঁচ ফুটবল-ভক্তকে।

লাল জ্যাকেট গায়ে। হাতে পেরুর পতাকা। ‘পেরু, পেরু’ বলতে বলতে তাঁদের তিনজনের নাচ আরও উদ্দাম হচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে যখন শেষ করার পথে, মুখে গেরেরোর নামে জয়ধ্বনি। ৩৬ বছর পর পেরুর বিশ্বকাপে ফেরাকে তাঁরা উদ্যাপন করতে চলে এসেছেন রাশিয়ায়। ব্রাজিলিয়ানদের মতো অত রং ছড়িয়ে, কলধ্বনি তুলে তাঁরা আসেননি। আর্জেন্টাইনদের মতো ততটা সপ্রাণ আগ্রাসী উপস্থিতিও নয়। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশের ফুটবল-ভক্ত তো, তাঁরাও ফুটবলের নামে আত্মহারা।

ওরা তিন বান্ধবী এসেছেন পেরুর লিমা থেকে। মধ্যবয়সী। সঙ্গে দুই তরুণ। সম্পর্ক কী সেটি কে আর খুঁজে বেড়াতে যায়! সারা বছর কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে চলে এসেছেন ফুটবল দলের পিছু পিছু। ডোপের সাজা কাটিয়ে, অনেক আইনি লড়াই করে পাওলো গেরেরো দলে সুযোগ পেয়েছেন, আর ওদের স্বপ্নের সীমাটা বেড়েছে। ‘পেরু খারাপ করবে না, আমাদের গেরেরো আছে না!’ যখন বলা হলো পেরুর গ্রুপে ইউরোপের দুই জবরদস্ত দল ফ্রান্স আর ডেনমার্ক, স্বপ্নটা দ্বিতীয় রাউন্ড পেরিয়ে সামনে এগোতে পারবে কি? দলনেত্রী মার্সেদেসের চিন্তায় সেই ভাবনাও আছে। এবং পেরু দ্বিতীয় রাউন্ডে না উঠতে পারলে বিকল্প দলও হাতে আছে। সেই দলটি আর্জেন্টিনা। মার্সেদেসরা নিজের দেশ বাদে আর্জেন্টিনার পেছনে আছেন, আর তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় ফুটবল মুখ মেসি।

এরিকা ইকুয়েডরের একজন সাংবাদিক। থাকেন দেশের বাণিজ্যনগরী কুয়েঙ্কায়। বিশ্বকাপ কভার করতে তিনি আসেননি। চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে এমিলিকে সঙ্গে করে মস্কোয় কর্মরত স্বামী এমিলিওর সঙ্গে কয়েকটি দিন কাটিয়ে যেতে এসেছেন। বিশ্বকাপের খেলাও দেখা হবে, কদিনের জন্য স্বামীসঙ্গও পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে রথ দেখা আর কলাবেচা আরকি!

মেসির দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে আর্জেন্টিনা ভেঙে দিয়েছে ইকুয়েডরের ২০১৮ বিশ্বকাপ-স্বপ্ন। এরিকা ও এমিলিও তবু আর্জেন্টিনার ভক্ত। মেসি তাঁদের কাছে এক নিঠুর দরদি। এরিকা আশায় আছেন মেসির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটা উঠতে দেখবেন। মস্কোয় নিউজ টুডেতে কাজ করা এমিলিও ফুটবলটা খুব ভালো বোঝেন। তিনি জানেন এবং মানেন দলগতভাবে ব্রাজিল খুব ভালো অবস্থায় আছে। তবু আর্জেন্টিনার মধ্যে কী একটা বাড়তি কিছু আছে। এই বাড়তি জিনিস বা বিষয়ই তো এক্স-ফ্যাক্টর! সেই এক্স-ফ্যাক্টর অবশ্যই মেসি।

এমিলিও বলে যেতে থাকেন, ফুটবল-বিধাতা হয়তো মেসির হাতে ট্রফি তুলে দেবেন বলে চার বছর তাঁকে অপেক্ষায় রেখেছেন। চার বছর আগে ব্রাজিলে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলে পরীক্ষা নিয়েছেন, ট্রফিটা দেননি। এবার দেবেন।
এমিলিও বলে যেতে থাকেন, ব্রাজিল ফুটবলটা খেলে মস্তিষ্ক দিয়ে, আর্জেন্টিনার ফুটবলে থাকে হৃদয়। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, কোপা আমেরিকা-তিনটি বড় টুর্নামেন্টে ফাইনালে উঠে মেসিরা শূন্য হাতে ফিরেছেন। সেই শূন্যতা পূরণের একটা দায় কিন্তু প্রকৃতির থাকেই। তাহলে আর্জেন্টিনার হাহাকার এবার ঘুচতে চলেছে? ‘হয়তো’-এমিলিওর প্রতিধ্বনি ওঠে স্ত্রী এরিকার কণ্ঠেও।

আসল বিশ্বকাপের আগে কাল ফ্যান ফেস্টের উদ্বোধনেই মানুষের সমুদ্র! বিশ্বকাপের ব্যাপারটাই এমন! ছবি: ফিফা

তাহলে মেসিরা যে ইকুয়েডরের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন খুন করল, তার কী হবে? ‘হ্যাঁ, দুঃখ আছে, আমাদের দেশ এবার বিশ্বকাপে আসতে পারল না। তবে একজন বিশ্বসেরার (মেসি) কাছে পরাজয় বলে আমরা সহজভাবেই মেনে নিয়েছি’, বলেন এমিলিও। মার্সেদেসরা বলেছিলেন জনপ্রিয়তায় দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলকে ছাপিয়ে গেছে আর্জেন্টিনা, এরিকা-এমিলিওদের সেই কথার সঙ্গে দ্বিমত নেই।
অবশ্য জনপ্রিয়তা পলকা একটি বিষয়। জনপ্রিয়তা দিয়ে কী হবে যদি না সঙ্গে যোগ হয় সাফল্য। ব্রাজিল পাঁচটি বিশ্বকাপ জিতে ষষ্ঠের অপেক্ষায় আর আর্জেন্টিনা তাদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতেছে ৩২ বছর আগে। আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের জন্য হাহাকার পারানা আর লা প্লাটা নদীর স্রোতে মিশে চলে এসেছে ভোলগার তীরে।

তবে এবারও যাতে হাহাকারের নদীতে আরও কিছু অতৃপ্তির ফোঁটা না পড়ে তার জন্য আর্জেন্টিনা কাল রাশিয়া এসে ঘাঁটি গেড়েছে ব্রোনিৎসিতে। জায়গাটা মস্কো অঞ্চলের মধ্যেই পড়েছে, যদিও কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ-পূর্বে। এটি আগে ছিল নিভৃত গ্রাম, এখন অনেকটাই কর্মচঞ্চল খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এলাকা। মস্কোর চেয়েও শীত ওখানে একটু বেশি। রাশিয়ায় শীতের সঙ্গেও একটা লড়াই হতে পারে ভেবে আর্জেন্টিনা দল মূল আবাসস্থল বানিয়েছে ব্রোনিৎসিকে।
গতকাল তো প্রথম অনুশীলন সেশনে আর্জেন্টিনা দলকে দেখা গেছে শীতে জবুথবু। কালো জ্যাকেটের গলাটা একেবারে নাক পর্যন্ত টেনে দিয়ে প্র্যাকটিস করেছেন মেসি।

আর্জেন্টিনার সাংবাদিক এমিলিও ফেদেরিকো জেলিচ ওখানে যাওয়ার জন্য পথে নেমে পড়েছিলেন। পরে ফিরে এসেছেন আর্জেন্টিনার মিডিয়া ম্যানেজারের টুইট পেয়ে। বৃষ্টির জন্য মাঠে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি মেসিরা। পরে করেছেন জিম। ১৫ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনটিও বাতিল করে দিয়েছে আর্জেন্টিনা দল।
মেসিরা তাও রাশিয়া এসে একটি সেশন অনুশীলন করেছেন। ব্রাজিল তো এখনো পা-ই ফেলেনি পুতিনের দেশে। গত রাতে ভিয়েনার আর্নস্ট হ্যাপেল স্টেডিয়ামে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলে আজ রাশিয়ায় আসার কথা নেইমারদের। ব্রাজিলের আস্তানা কৃষ্ণসাগর-তীরবর্তী রাশিয়ার দক্ষিণের পর্যটন শহর সোচি।

এটা বিশ্বকাপ বলে দেখা যাবে না কোন দল অনুশীলনে কত মানুষ টানে। অনুশীলন তো সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। অনুশীলনে ফুটবল জনতার উপস্থিতিকে জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ভাববেন? ব্রাজিল অথবা আর্জেন্টিনার তাতে কিছু এসে যায় না। তাদের চাই শিরোপা। ৩৬.৮ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৬.১৭৫ কেজি ওজনের সোনার ট্রফিটা হাতে তোলা। বিশ্বকাপের দেশে এসে সেই লড়াইয়ের মনস্তাত্ত্বিক অংশটা শুরু হয়ে গেছে কাল থেকেই। ইউরোপে বিশ্বকাপ বলে ইউরোপের কোনো একটি দল শিরোপা জিততেই পারে। তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা না আসা অবধি বিশ্বকাপ যেন শুরুই হতে চায় না।