সেই বেনজেমাই বাঁচালেন রিয়ালকে
সেই বেনজেমাই বাঁচালেন রিয়ালকে

চ্যাম্পিয়নস লিগ

বেনজেমা-মদরিচে অপূর্ণ চেলসির প্রত্যাবর্তনের গল্প, সেমিতে রিয়াল

এমন রাতগুলোর জন্যই তো চ্যাম্পিয়নস লিগ অনন্য!

প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ৩-১ গোলে হারার পরেও দ্বিতীয় লেগে রিয়ালের মাঠে প্রত্যাবর্তনের অসাধারণ গল্পটা প্রায় লিখেই ফেলেছিল চেলসি। কিন্তু রিয়ালে যে একজন বেনজেমা ছিলেন! ছিলেন একজন মদরিচ। যাঁরা হারার আগে হারতে নারাজ। এ দুজনের নৈপুণ্যেই শেষমেশ চেলসির প্রত্যাবর্তনটা অসম্পূর্ণই থেকে গেল। ম্যাচে ৩-২ গোলে চেলসি জিতলেও দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৪ গোলের ব্যবধানে সেমিতে উঠে গেছে রিয়াল মাদ্রিদ। বিদায় নিয়েছে গতবারের ইউরোপজয়ীরা। আর চেলসিকে হারিয়ে গতবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল হারেরও একটা বদলা নিল রিয়াল।

চেলসির যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না

মেসন মাউন্ট, আন্তোনিও রুডিগার আর টিমো ভেরনারের গোলে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল চেলসি। দুই লেগ মিলিয়ে চেলসি তখন ৪-৩ গোলে এগিয়ে। এরপরই বেনজেমা-মদরিচদের পুনরুত্থান। ড্রেসিংরুমে ঠাট্টা করে ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রদ্রিগো মদরিচকে বাবা ডাকেন, কারণ মদরিচের বয়স রদ্রিগোর বাবার সমান। সে হিসেবে রদ্রিগো মদরিচের ‘ছেলে’-ই। সেই পাতানো ‘ছেলে’কে দিয়ে গোল করিয়ে রিয়ালের নিবু নিবু আশাটা আরেকটু উজ্জ্বল করে তোলেন এই মদরিচ। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে করিম বেনজেমার গোলেই নিশ্চিত হয়, প্রত্যাবর্তনের গল্পটা পূর্ণতা পাচ্ছে না চেলসির।

একাদশ দিয়ে প্রথমেই রিয়ালকে চমকে দিয়েছিল চেলসি। দলের অধিনায়ক সেজার আজপিলিকেতা বেঞ্চে, তাঁর জায়গায় নামান হয়েছে ইংলিশ মিডফিল্ডার রুবেন লফটাস-চিককে, যিনি বলতে গেলে তেমন সুযোগই পান না খেলার। তাও আবার লফটাস-চিককে তাঁর পছন্দের জায়গা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে নয়, দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাইট উইংব্যাক পজিশন সামলানোর জন্য। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে রাইট উইংব্যাক রিস জেমস কোথায় খেলেছেন? ৩-৪-৩ ছকে তাঁকে ডানদিকের সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলিয়েছেন কোচ টমাস টুখেল।

গোল করে, ম্যাচ জিতেও শেষ পর্যন্ত হতাশাই জুটল রুডিগারের

অর্থাৎ ব্যাপারটা পরিষ্কার, রিয়ালের আক্রমণভাগের বাঁ দিক থেকে বিপজ্জনকভাবে বারবার ঢুকে যাওয়া ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে রিস জেমসের গতি দিয়ে পরাস্ত করার জন্যই এত আয়োজন, যে কাজটা হয়তো অপেক্ষাকৃত শ্লথগতির আজপিলিকেতা করতে পারতেন না। মাঝমাঠে ছিলেন না জর্জিনিও-ও, তাঁর জায়গায় এনগোলো কান্তের সঙ্গী হয়েছিলেন ক্রোয়াশিয়ার মিডফিল্ডার মাত্তেও কোভাচিচ। আক্রমণভাগে হাভার্টজের সঙ্গে টিমো ভেরনার ও মেসন মাউন্ট। ওদিকে রিয়ালের একাদশে চমক বলতে এদের মিলিতাওর অনুপস্থিতি। তাও, চোটে না পড়লে হয়তো মিলিতাওর জায়গায় নাচো ফার্নান্দেজের নামা হতো না।

এই কৌশলেই ম্যাচের শুরু থেকে রিয়ালের সঙ্গে সমানে সমান টেক্কা দিচ্ছিল চেলসি। পরের মাঠে খেলা বলে নিজেদের পরিচিত নীল জার্সি ছেড়ে হলুদ জার্সি পরেছিল চেলসি। কিন্তু খেলা দেখে কে বলবে, সেটা যে তাদের মাঠ স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ ছিল না? প্রথম থেকেই রিয়ালকে চেপে ধরে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নরা। লফটাস-চিককে খেলানোর সিদ্ধান্তটা যে কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল, সেটা বোঝানোর জন্য ১৫ মিনিট সময় নিয়েছেন এই ইংলিশ মিডফিল্ডার। মেসন মাউন্টকে দিয়ে ম্যাচের প্রথম গোলটা যে তিনিই করিয়েছেন!

ম্যাচের শুরুতে ৩-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল চেলসিই

৫১ মিনিটেই নিজেদের পরিশ্রমের ফসল পেয়ে যায় দলটা। মেসন মাউন্টের কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে দলকে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে দেন জার্মান ডিফেন্ডার আন্তোনিও রুডিগার। ততক্ষণে দুই লেগ মিলিয়ে ৩-৩ গোলের সমতায় দুই দল! পরের রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্নটা তখন রিয়ালের চেয়ে চেলসিরই বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে! ৬২ মিনিটে রিয়াল সমর্থকদের হৃৎস্পন্দন প্রায় থামিয়েই দিয়েছিলেন চেলসির লেফট উইংব্যাক মার্কোস আলোনসো। কিন্তু তাঁর গোলটা বাতিল হয় হ্যান্ডবলের কারণে।

চেলসির গোল বাতিল হওয়ার পরেই রিয়াল যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। বেনজেমার একটা শট পোস্টে লাগে। কিন্তু ৭৫ মিনিটে আরেকটা গোল করে বেনজেমাদের আবারও থমকে দেন জার্মান ফরোয়ার্ড টিমো ভেরনার। এই অগ্রগামিতা অবশ্য বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারেনি ব্লুজরা। ৮০ মিনিটে মদরিজের অসাধারণ এক পাস পেয়ে রদ্রিগোর দারুণ ফিনিশিংয়ে টাই আবার সমতায় ফেরে। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

রদ্রিগো গোল পেয়েছেন

আর সেখানেই জাদু দেখাবেন বলেই যেন জাদুকর এতক্ষণ বসে ছিলেন চুপচাপ। প্রথম লেগে হ্যাটট্রিক করা বেনজেমা ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জ্বলে উঠলেন আবারও। টেনে তুললেন রিয়ালকে। জাদুকর শেষ মুহুর্তে জাদু দেখাবেন বলেই যেন সারা ম্যাচে দুর্দান্ত খেলে ভিনিসিয়ুসকে আটকে রাখা রিস জেমস ঠিক ওই সময়টাতেই ব্যর্থ হলেন। নিখুঁত ক্রস দিলেন ভিনিসিয়ুস। জাদুকর শেষ মূহুর্তে জাদু দেখিয়ে বার্নাব্যুকে উদ্বেল করবেন দেখেই যেন গোটা ম্যাচে প্রতিপক্ষের আক্রমণ ঠেকিয়ে আর নিজে গোল করে প্রায় নায়ক বনে যাওয়া রুডিগার ঠিক ওই সময়টাতেই নিজের নিয়ন্ত্রণ ঠিক ধরে রাখতে পারলেন না, পা ফসকে একটু পড়ে গেলেন।

অতটুকু সুযোগই যথেষ্ট ছিল করিম বেনজেমা নামের জাদুকরের জন্য। নিখুঁত হেডে গোল করলেন, দুই লেগ মিলিয়ে দলকে এগিয়ে দিলেন ৫-৪ গোলের ব্যবধানে। সে ব্যবধান আর ঘোচাতে পারল না চেলসি। রিয়ালও পাড়ি জমাল পরের রাউন্ডে, সেমিফাইনালে।

বেনজেমার এই গোলই শেষ করে দেয় চেলসির ফিরে আসার সব আশা

যাদের লক্ষ্য এখন চ্যাম্পিয়নস লিগের ১৪ তম শিরোপা। সেমিতে রিয়ালের প্রতিপক্ষ হয় নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী আতলেতিকো মাদ্রিদ, না হয় পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। বার্নাব্যুতে শেষ বাঁশি বাজার পর অবশ্য সেমির প্রতিপক্ষ কে হবে, এটা বেনজেমাদের মাথায়ই ছিল না। তাঁরা তখন ভেসে যাচ্ছেন খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসে আরেকটি সেমিফাইনালে ওঠার আনন্দে।