বিশ্বকাপ শুরুর আগেই রিয়াল মাদ্রিদের কোচের দায়িত্ব নেওয়ায় স্পেনের পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন হুলেন লোপেতেগি। তাঁর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন স্পেন জাতীয় দলের স্পোর্টিং ডিরেক্টর ফার্নান্দো হিয়েরো। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আগে ৪৮ ঘণ্টা সময়ও পাচ্ছে না স্পেন। এমন মুহূর্তে লোপেতেগির পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনবেন না হিয়েরো। তাই লোপেতেগির ট্যাকটিকসই এখানে আলোচনা করা হলো।
ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র দল হিসেবে টানা তিনটি বড় শিরোপা জেতার কীর্তি তাঁদের। ২০০৮ ইউরো, ২০১০ বিশ্বকাপ এবং ২০১২ ইউরো জিতে এই অসাধারণ ঘটনার জন্ম দেয় স্পেন। তবে ২০১৪ বিশ্বকাপে প্রথম পর্বে বিধ্বস্ত হয়ে বাদ পড়া, ২০১৬ ইউরোতে দ্বিতীয় পর্বেই বাড়ির পথ ধরার পর অনেকেই ধরে নিয়েছিল স্পেনের রাজত্ব এখানেই শেষ। লোপেতেগি দায়িত্ব নেওয়ার পরই যেন আবারও নিজেদের চেনা পথ খুঁজে পেয়েছে লা ফুরিয়া রোজারা। তাঁর অধীনে ২ বছরে ২০ ম্যাচ খেলেও অপরাজিত স্পেন। জিতেছে ১৪টি, ড্র করেছে ৬টি।
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেই যেমন ইতালির গ্রুপে থেকেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই বিশ্বকাপে এসেছে স্পেন। সবচেয়ে বড় কথা, যেই টিকিটাকার শেষ দেখে ফেলেছিল সবাই সেই টিকিটাকার মন মাতানো ফুটবল দিয়েই স্পেন বিশ্বকাপের ফেভারিটদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। স্পেনের ফুটবল মানেই বল পায়ে রেখে ছোট ছোট পাসে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে চির ধরানো। লোপেতেগি টিকিটাকাকে মূল স্তম্ভ হিসেবে রেখে যোগ করেছেন গতি এবং দ্রুত প্রতি আক্রমণ করার পদ্ধতি। যেটি টিকিটাকাকে করেছে আরও কার্যকরী।
একটি কথা বেশ প্রচলিত; স্পেনে টমেটো এবং মিডফিল্ডার এই দু’টি জিনিসের অভাব কখনোই হয় না। দুই যুগ ধরে যেটির প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। জাভি, ইনিয়েস্তা, জাবি আলোনসো, বুসকেটস, ডেভিড সিলভা, ইসকো, থিয়াগোদের মতো মিডফিল্ডার ফুটবলকে উপহার দিয়েছে স্পেন। তাঁদের খেলার ভিত্তিই যে দাঁড়িয়ে আছে মিডফিল্ডের ওপর।
লুইস আরাগোনেস কিংবা ভিসেন্তে দেল বস্ক, দুই পূর্বসূরির সাজানো ফরমেশনে পরিবর্তন আনেননি লোপেতেগি। ৪-৩-৩ ফরমেশনেই আস্থা রেখেছেন তিনিও। মিডফিল্ড মাস্টার জাভির বিদায়ের পর দারুণ দক্ষতার সঙ্গে সে জায়গা পূরণ করেছেন থিয়াগো। মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করার দুর্দান্ত ক্ষমতা, নিখুঁত পাসিং, লং রেঞ্জ শুটিং মিলিয়ে জাভির নতুন প্রজন্মের সংস্করণ থিয়াগো। চিরকালীন আস্থার সার্জিও বুসকেটস আছেন মাঝমাঠে নিজের রাজত্ব স্থাপন করতে। নিজেদের ডি-বক্সেও বল নিয়ে কারিকুরি দেখানোর সাহস বোধ হয় কেবল বুসকেটসেরই রয়েছে। আছেন একজন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারফরম্যান্সের ধারও যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সবার ভালোবাসার ডনের। স্পেনের ইতিহাস বদলে দেওয়া বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতা গোলটিও তাঁর। রক্ষণাত্মক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ডিফেন্সচেরা পাসটি পাওয়ার জন্য ইনিয়েস্তার দিকেই তাকিয়ে থাকবে স্পেন।
মাঠের বাঁ দিকে থাকবেন ইসকো। সন্দেহাতীতভাবেই স্পেনের নতুন প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড়। ২০১৪ বিশ্বকাপে দেল বস্ক তাঁকে দলে রাখেননি অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে, ২০১৬ ইউরোতেও ছিলেন না ফর্ম হারিয়ে ফেলায়। প্রথমবারের মতো ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে স্পেনের হয়ে নামবেন ইসকো। উপলক্ষটা স্মরণীয় করে রাখতে চাইবেন তিনি। আঁকাবাঁকা ড্রিবলিং, দূরপাল্লার শটে গোল করার সামর্থ্য, ফলস নাইন হিসেবে খেলতে পারার দক্ষতা, নিখুঁত ফ্রি-কিক রয়েছে ইসকোর অস্ত্র ভান্ডারে। যা কাজে লাগিয়ে ইসকো হতে পারেন বিশ্বকাপেরই সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন।
ডান পাশে স্পেনের ভরসা ডেভিড সিলভা। বয়স ৩২ হলেও বিদায়ী মৌসুমেই নিজের ক্যারিয়ার সেরা ফর্মে ছিলেন সিলভা। স্পেন দলের সবচেয়ে সমাদৃত খেলোয়াড়ও তিনি। বাঁ পায়ের এই জাদুকর যে কোনো দলের জন্যই বড় সম্পদ। অসাধারণ ড্রিবলিং, দ্রুত বল আদান-প্রদান করার ক্ষমতা, ন্যূনতম ফাঁকা জায়গা বের করা, সতীর্থদের সঙ্গে দারুণ বোঝাপড়া সিলভার বড় গুণ। যা সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে চাইবেন হিয়েরো।
রক্ষণে থাকবেন দলনেতা সার্জিও রামোস এবং জেরার্ড পিকে। ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের হলেও জাতীয় দলে দীর্ঘদিন একত্রে খেলার ফলে তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়াটা দারুণ। দুপাশে থাকবেন জর্ডি আলবা আর দানি কারভাহাল। দুজনই দুর্দান্ত গতিসম্পন্ন, রক্ষণের পাশাপাশি আক্রমণেও দারুণ পারদর্শী। যেটি স্পেনকে দেবে আক্রমণে বাড়তি সুবিধা। রক্ষণের শেষ বাধা হিসেবে থাকবেন বর্তমানে বিশ্বের সেরা গোলরক্ষক ডেভিড ডি গেয়া। ক্লাবের হয়ে ব্যক্তিগতভাবে দুর্দান্ত একটি মৌসুম কাটিয়েছেন তিনি। বিশ্বকাপে তাঁর গ্লাভস জোড়া দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে স্পেনকে গোল দেওয়াটা কঠিনই হতে যাচ্ছে।
স্পেনের সবচেয়ে বড় শক্তিমত্তা তাঁদের বেঞ্চ। মূল একাদশে অনায়াসে সুযোগ পাবেন এ রকম মানসম্পন্ন খেলোয়াড়রা আছেন দলটির বেঞ্চে। তাঁদেরই একজন মার্কো অ্যাসেনসিও। লোপেতেগির প্ল্যান ‘বি’। স্প্যানিশ ফুটবলের ভবিষ্যৎ ভাবা হয় অ্যাসেনসিওকে। এবারের বিশ্বকাপের তারকা হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনাই রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া আছেন সাউল, কোকে, অ্যাজপিলিকুয়েতা, লুকাস ভাসকেজদের মতো তরুণেরা।
স্পেনের দুর্বলতা তাঁদের ‘নাম্বার নাইন’ পজিশনটি। রাউল গঞ্জালেস, ডেভিড ভিয়া, ফার্নান্দো তোরেসদের রেখে যাওয়া জায়গা পূরণ করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে পায়নি স্পেন। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ব্রাজিলের সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করেই ২০১৪ সালে ডিয়েগো কস্তাকে নেওয়া হয়েছিল। সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি কস্তা। বিশ্বকাপে গোল পাওয়ার জন্য স্পেনকে এবারও তাঁর ওপরেই ভরসা করতে হচ্ছে। এমনকি তাঁর বদলি হিসেবে খেলানোর জন্যও মানসম্পন্ন স্ট্রাইকার নেই দলে।
স্পেনের রক্ষণ প্রতি আক্রমণের বিপক্ষে দুর্বল। গত বিশ্বকাপেই নেদারল্যান্ডসের কাছে ৫-১ গোলের লজ্জাজনক হারে সেটি প্রমাণিতও হয়েছে। সার্জিও রামোস, জেরার্ড পিকে দুজনই দুর্দান্ত ডিফেন্ডার। তাঁদের যেকোনো একজনের অফফর্ম ভোগাতে পারে স্পেনকে। জর্ডি আলবা এবং দানি কারভাহালের অতি আক্রমণাত্মক মানসিকতা রক্ষণের দুই দিকে জায়গা খালি করে দেয়, যেটি কাজে লাগাতে মুখিয়ে থাকবে প্রতিপক্ষ।
প্রায় নিখুঁত একটি দল পেলেও স্পেনের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে দলের দুর্বল দিকগুলো। বিশ্বকাপ নিজেদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে হলে এই দুর্বলতাগুলো ঢাকার উপায় বের করতে হবে ফার্নান্দো হিয়েরোকে। শক্তিশালী দিকগুলোকে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে যেটি সম্ভব। স্পেনের হারানো রাজত্ব এবং সম্মান ফিরিয়ে আনতেও এর বিকল্প নেই। মাত্রই দায়িত্ব পাওয়া হিয়েরো পারবেন কি না সেটি সময়ই বলে দেবে।