>রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলে বড় দল বলে কিছু নেই। নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেরে গেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। জিততে ব্যর্থ হয়েছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা।
বাছাইপর্ব থেকেই শুরু। চূড়ান্তপর্বেও অটল রইল সেই ধারা। বিশ্বকাপে এখন কোনো সহজ দল নেই। ৩ পয়েন্টের নিশ্চয়তার কোনো ম্যাচ নেই। যে দলগুলোর বিপক্ষে অনায়াসে ৩ পয়েন্ট, এমনকি গোল উৎসব হবে বলে এত দিন ধরে নেওয়া হতো, তারাই এখন আটকে দিচ্ছে। ওলট-পালট করে দিচ্ছে। বিশ্বকাপে এখন আর ছোট বলে কোনো দল নেই। কথাটা এভাবেও বলা যায়, বিশ্বকাপে এখন আর বড় দল বলেও কিছু নেই!
অপেক্ষাকৃত ছোটদের হাতে ধরা খেয়েছে ফুটবল বিশ্বের দুই মোড়ল জার্মানি ও ব্রাজিল। এর আগে বড় শিকার আরেক ‘বড় মাছ’ আর্জেন্টিনা। পর্তুগালের চেয়ে গায়ে-গতরে ঢের বড় স্পেন ধাক্কা খেয়েছে। হারেনি, সে-ই তাদের ভাগ্য। ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ফ্রান্স জিতেছে ভিএআরের সাহায্য নিয়ে। আর্জেন্টিনাকে জিততে দেয়নি আইসবার্গের দেয়াল তুলে দাঁড়ানো আইসল্যান্ড। মেক্সিকো এমন দাপটের সঙ্গে খেলে জার্মানিকে হারিয়েছে, ম্যাচটিকে অঘটন বললে আবার অনেকে খেপে যাচ্ছেন। এই ম্যাচে জার্মানির হারই নাকি প্রাপ্য ছিল!
ওই দিনই সুইজারল্যান্ড রুখে দিয়েছে এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় ফেবারিট ব্রাজিলকে। পুঁচকে পানামা কাল বেলজিয়ামের মতো প্রতিভাধর দলকে প্রথমার্ধে গোলশূন্যতে আটকে রেখেছিল। তিউনিসিয়ার বিপক্ষে ইংল্যান্ড জিতেছে যোগ করা সময়ের গোলে! বিশ্বকাপে বলে-কয়ে জেতার দিন শেষ!
পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল দিয়েই শুরু করা যাক। ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের মিশন নিয়ে রাশিয়ায় পা রেখেছে নেইমারের ব্রাজিল। আক্রমণভাগে কত রথী-মহারথীর নাম। কোচ তিতে কাকে রেখে কাকে খেলাবেন্ই—এই মধুর সমস্যা নিয়ে তাঁর ঘুম হারাম হওয়ার মতো অবস্থা। অথচ সেই দলই কিনা সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠ ছাড়ল ১-১ গোলের ড্র নিয়ে।
অথচ সুইসদের বিপক্ষে জোগো বনিতো শোতে গোল উৎসব করবে ব্রাজিলিয়ানরা, ম্যাচ শুরুর আগে তা ধরেই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গোলের জন্য কতটা হাপিত্যেশ করতে হয়, শেষ পর্যন্ত তাই দেখা গেল জেসুস-নেইমারদের চোখে-মুখে। নেইমারের মতো বিশ্বসেরা তারকাকেও কি আলাদাভাবে চেনা গেছে? একেবারেই না। আসলে ‘অখ্যাত’ সুইসরা নেইমারকে সেই সুযোগই দেননি। তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারকা খ্যাতিতে নেইমার-কুতিনহো-উইলিয়ানরা বড় হতে পারেন, কিন্তু তাঁরাও ছোট নন।
ব্রাজিলের আগের ম্যাচে তো রীতিমতো মেক্সিকোর বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরেই গেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। অথচ গত বছর এই রাশিয়াতেই কনফেডারেশনস কাপে জার্মানির বিপক্ষে ৪-১ গোলে উড়ে গিয়েছিল মেক্সিকো। ফলাফলের কথা বাদ দিন। ম্যাচে মেক্সিকানদের বিপক্ষে কোনো জায়গায় কি এগিয়ে ছিল জার্মানরা? পরিষ্কার নয়।
দুর্দান্ত কাউন্টার অ্যাটাকে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে দেওয়ার খ্যাতি আছে জার্মানদের। জার্মানির এই ওষুধই জার্মানিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে হিরভিং লোজানো ও হাভিয়ের হার্নান্দেজরা। দুর্দান্ত এক কাউন্টার অ্যাটাকের গোলেই হয়েছে ম্যাচের মীমাংসা। আরও কয়বার জার্মান রক্ষণে ত্রাস ছড়িয়েছে সবুজ ঢেউ।
পাঁচবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল ও চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি বাদ যায়নি, দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাই-বা ছাড় পাবে কেন! মেসিদের রুখে দিয়েছে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো পা রাখা আইসল্যান্ড। আয়তন ও জনসংখ্যায় ছোট হওয়া মানেই আসলে ছোট নয়। স্পার্তাক স্টেডিয়ামে সেদিন তাঁরা কী না করে দেখিয়েছেন? যেই মেসির পায়ে বল গেলে পুরো বিশ্ব ঝাঁকুনি খায়, সে খুদে জাদুকরকেই ঠান্ডা করে রাখল আইসল্যান্ড। ৩২ বছরের বিশ্বকাপ খরা মেটানোর অপেক্ষায় থাকা আর্জেন্টিনাও পেল না কাঙ্ক্ষিত জয়।
রাশিয়া বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই বিশ্বকাপের আকাশ থেকে বড় তারকাদের খসে পড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। ৬০ বছর পর বিশ্বকাপে আসতে ব্যর্থ হয়েছে চারবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি। হল্যান্ডের মতো দলও উঠতে পারেনি রাশিয়ার বিমানে। নতুন নতুন দল উঠে আসছে, ছোটরা বড় হয়ে উঠছে, বড়দের মাস্তানিও আর আগের মতো নেই। শুধু ইউরোপের বাছাইপর্বে নয়, দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের বাছাইপর্বেও যে দলগুলোকে পুঁচকে ভাবা হতো, তারাও এবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের পর প্রথম খেলতে এল পেরু।
এখন পর্যন্ত এই বিশ্বকাপে মাত্র দুটি ম্যাচ হয়েছে একতরফা। প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়া। আর কাল পানামাকে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয়ার্ধে ৩ গোল খাইয়েছে বেলজিয়াম। এ ছাড়া একতরফা ম্যাচ সেভাবে হয়নি একটিও। ফুটবলবোদ্ধারাও মাথা দুলিয়ে বলছেন, এবার একটা বিশ্বকাপ হচ্ছে বটে! মানসম্পন্ন ফুটবল, দারুণ সব গোল, রক্ষণ আর গোলরক্ষকদের আলো ছড়ানো...আর কী চাই!
এ-ই না হলে বিশ্বকাপ!