>মাঠের পুরো স্পটলাইটটা তো থাকে যে গোল করে তাঁর ওপর। যে পেছনে দাঁড়িয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণগুলোয় বাধা দেন, স্পটলাইট থাকে তাঁর ওপরেও। কিন্তু তিন কাঠির নিচে দাঁড়িয়ে যিনি জীবন বাজি রাখেন, তিনি মনোযোগের কেন্দ্রে থাকেন কতটুকু! অথচ গোলরক্ষকের কারিশমায় দল জিতেছে—এমন উদাহরণ ইতিহাসে যথেষ্টই। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসেও এমনি করে বেশ কয়েকজন গোলরক্ষক নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন। অসাধারণ সব সেভ আর ক্ষিপ্রতা দিয়ে সেই গোলরক্ষকেরাও পরিণত হয়েছেন বিশ্বকাপ ফুটবলের কিংবদন্তিতে!
লেভ ইয়াশিন
বিশ্বকাপ ফুটবলের সেরা গোলরক্ষকের যে পুরস্কারটা দেওয়া হয়, সেই পুরস্কারটা কিন্তু এই ভদ্রলোকের নামেই। বোঝাই যাচ্ছে কী ধরনের গোলরক্ষক ছিলেন তিনি! লেভ ইয়াশিন ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র গোলরক্ষক, যিনি ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের এই গোলরক্ষক বিশ্বকাপে ম্যাচই খেলেছিলেন মাত্র তিনটি। অথচ গোটা ক্যারিয়ারে ২৭০টি ম্যাচে গোল না খাওয়া ইয়াশিন ক্যারিয়ারে পেনাল্টি ঠেকিয়েছেন ১৫১টি! বিংশ শতকেরই সেরা গোলরক্ষক হিসেবে সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছে তাঁকে।
গর্ডন ব্যাঙ্কস
১৯৬৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা গর্ডন ব্যাঙ্কসের। সেবার সেমিফাইনালের আগে কোনো গোলই না খাওয়া ব্যাঙ্কস শেষ দুই ম্যাচে হজম করেছিলেন তিন গোল। ক্যারিয়ারে পাঁচবার ফিফার বর্ষসেরা গোলরক্ষক হওয়া ব্যাঙ্কস ১৯৭০ বিশ্বকাপে পেলের একটা হেড ঠেকিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তিনি। অসাধারণ দক্ষতায় সেই হেডটি ঠেকিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের কথাই যেন কালোমানিককে নিঃশব্দে জানিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাঙ্কস!
সেপ মাইয়ার
জার্মান ফুটবল সেপ মাইয়ারের মতো একই সঙ্গে সফল আর দুর্দান্ত গোলরক্ষক দেখেনি কখনো। হ্যাঁ, ম্যানুয়েল নয়্যারের সম্ভাবনা আছে মাইয়ারের সমান হওয়ার, কিন্তু তার আগ পর্যন্ত জার্মান গোল রক্ষণের শেষ কথা কিন্তু এই সেপ মাইয়ারই। ১৯৭২ সালের ইউরো জেতার পর ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপজয়ী জার্মান দলের এই ‘নাম্বার ওয়ান’ গোলরক্ষক পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র চার গোল হজম করেছিলেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত টানা ৪২২ ম্যাচ খেলা মাইয়ার তিনবার হয়েছিলেন জার্মান ফুটবলের বর্ষসেরা খেলোয়াড়।
দিনো জফ
চল্লিশ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জিতে অনন্য এক কীর্তি গড়েছিলেন ইতালির গোলরক্ষক দিনো জফ। ১৯৮২ সালে তিনি ছিলেন ইতালির অধিনায়ক। দেশের হয়ে ১৯৬৮ সালের ইউরো জেতা জফ ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষকও হয়েছিলেন। ইতালির হয়ে তাঁর ক্যারিয়ার ১১২ ম্যাচের।
জিলমার
ব্রাজিলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম গোলরক্ষক মানা হয় জিলমারকে। জিলমারের আগে আর কোনো গোলরক্ষকই টানা দুটি বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। জিলমার জিতেছিলেন, ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপ। সামনে পেলে ও গারিঞ্চারা মাঠ মাতালেও পেছনে জিলমারের সতর্ক উপস্থিতি না থাকলে হয়তো সেই দুবার বিশ্বকাপ জেতা কঠিনই হতো ব্রাজিলের।
জিয়ানলুইজি বুফন
দিনো জফের যোগ্য উত্তরসূরি মানা হয় তাঁকে। বুফন কেমন গোলরক্ষক সেটি নতুন করে বলার আদৌ প্রয়োজন আছে কি? ২০০৬ বিশ্বকাপেই বুফন পেয়ে যান অমরত্ব। ইতালিকে বিশ্বকাপ জিততে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সাত ম্যাচে মাত্র দুই গোল খেয়ে। সেই দুই গোলের একটি ফাইনালে—জিদানের সেই পেনাল্টি আর অন্যটি গ্রুপপর্বে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ক্রিস্টিয়ান জাক্কার্ডোর আত্মঘাতী।
অলিভার কান
অনেকের মতে আক্রমণাত্মক গোলরক্ষণের শেষ কথা এই অলিভার কান। মুখোমুখি মোকাবিলায় অলিভার কানকে পরাস্ত করতে পেরেছেন এ রকম স্ট্রাইকার বিশ্বে কমই আছে, আর সে ধরনের গুটি কয়েক ভাগ্যবান স্ট্রাইকারের একজন ব্রাজিলের রোনালদো। ক্লাব জীবনে সম্ভাব্য সবকিছু জেতা কান কেবল বিশ্বকাপটাই জেতেননি। রোনালদো, রিভালদো, মিরোস্লাভ ক্লোসাদের ছাপিয়ে ইতিহাসের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন তিনি।
ইকার ক্যাসিয়াস
২০১০ সালের বিশ্বজয়ী স্পেনের অধিনায়ক। ইতিহাসের তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ নিয়েছিলেন তিনি। স্পেনের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা (১৬৭) ক্যাসিয়াস ২০১০ বিশ্বকাপের আগে-পরে স্পেনের হয়ে দুটি ইউরোও জিতেছেন, অধিনায়ক হিসেবেই।
ফাবিয়ান বার্থেজ
ফ্রান্সের হয়ে ৮৭ ম্যাচ খেলা ফাবিয়ান বার্থেজ ১৯৯৮ সালে দেশের বিশ্বকাপ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ম্যাচে গোল না খেয়ে থাকার রেকর্ডে আছেন তিনিও—বিশ্বকাপে ১০ ম্যাচে গোল না খেয়ে তিনি পাশে বসেছেন ইংলিশ-কিংবদন্তি গোলরক্ষক পিটার শিলটনের। ক্লাব ক্যারিয়ার খুব সমৃদ্ধ না হলেও বার্থেজ জাতীয় দলে সব সময়ই ছিলেন অসাধারণ। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচের আগে বার্থেজের টাক মাথায় লরেন্ত ব্লঁর চুম্বনের সেই দৃশ্য তো বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অংশ।
পিটার শিলটন
বিশ্বকাপে ১৭ ম্যাচ খেলে দশটাতেই গোল খাননি ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গোলরক্ষক পিটার শিলটন। দারুণ এই রেকর্ড নিয়েও বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ পাননি তিনি। দেশের জার্সি গায়ে খেলেছেন ১২৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। শিলটন সম্পর্কে সবচেয়ে মজার তথ্য হচ্ছে, ৩২ বছর বয়সের আগে তিনি বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচই খেলেননি। ১৯৯০ সালে শেষ বিশ্বকাপের সময় শিলটনের বয়স ছিল ৪০!