>ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পেনাল্টি রুখে দিয়েছেন ইরানের গোলরক্ষক আলিরেজা বেইরানভান্দ। তাঁর জীবনের গল্পটাও চমকপ্রদ
স্বপ্ন ছোঁয়ার অভিযানে নেমে কখনো পিছিয়ে যেতে নেই। তাতে নিজেরই ক্ষতি। লেগে থাকাটাই শ্রেয়। স্বপ্নটা তাতে আপনাতেই একদিন হাতের মুঠোয় চলে আসে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে ইরানের গোলরক্ষক আলিরেজা বেইরানভান্দের জীবনের গল্প শুনুন।
তাঁর জন্ম লোরেস্তানের সারাবায়োসে। মেষপালক পরিবারে জন্মানোয় সারাক্ষণ এই অঞ্চল থেকে ওই অঞ্চলে চরকির মতো পাক খেতে হতো। সেটি সবুজ ঘাসের জন্য। নইলে যে মেষপালন সম্ভব নয়। আর সেটা না হলে পেটেও দানাপানি পড়বে না। বেইরানভান্দ ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের বড় ছেলে। আর দশটা সংসারে বড় ছেলেদের যেমন অনেক দায়িত্ব থাকে, অনেক স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়—বেইরানভান্দকেও হাঁটতে হচ্ছিল সেই পথে। মেষ চরানোই ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবন। বড্ড একঘেয়ে!
কিন্তু স্বপ্নচারীরা সব সময়ই পথ খুঁজে নেয়। বেইরানভান্দ মেষপালনের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। আর ইরানের একটি স্থানীয় প্রচলিত খেলা ‘দাল পারান’, যেখানে যত দূরে সম্ভব পাথর ছুড়ে মারতে হতো। ফুটবল খেলার সঙ্গে এই খেলার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও বেইরানভান্দের ক্ষেত্রে তা বেশ ভালোই কাজে লেগেছে। ১২ বছর বয়সে সারাবায়োসের এক স্থানীয় ক্লাবে স্ট্রাইকার হিসেবে অনুশীলন শুরু করেছিলেন বেইরানভান্দ। দলের নিয়মিত গোলরক্ষক একদিন চোট পাওয়ায় গোলে দাঁড়াতে হয়েছিল তাঁকে। দারুণ কিছু সেভে কাড়লেন নজর।
কোচসহ অন্যরা পরামর্শ দিল, স্ট্রাইকার নয়, গোলরক্ষক হও। ব্যস, বেইরানভান্দ তখন থেকেই গোলরক্ষক।
কিন্তু বাবা মেনে নেননি। টানাটানির সংসারে ছেলের ফুটবলার হওয়ার ব্যাপারটা তাঁর বাবার কাছে ছিল বিলাসিতা। এ জন্য বেইরানভান্দকে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। বাবার সঙ্গে তখনকার সম্পর্কটা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে বেইরানভান্দ বলেছেন এভাবে, ‘বাবা ফুটবল খেলা পছন্দ করতেন না। তিনি কাজ করতে বলতেন। এমনকি তিনি আমার খেলার জার্সি-গ্লাভস ছিঁড়ে ফেলতেন। সে জন্য আমাকে বহুবার খালি হাতে গোলকিপিং করতে হয়েছে।’
কিন্তু এভাবে কত দিন সহ্য হয়? কিশোর বয়সটাই তো নিয়ম ভাঙার। প্রথাগত ভাবনার বিরুদ্ধাচরণের। বেইরানভান্দ তাই মনে মনে ফন্দি আঁটলেন। এক আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে পালালেন বাড়ি থেকে। সোজা তেহরান। তাঁর মনে স্বপ্ন, একদিন বড় ফুটবলার হবেন। ভাগ্য সব সময় সাহসীদের সহায় হয়। কাকতালীয় ব্যাপার, বাড়ি থেকে পালিয়ে বেইরানভান্দ তেহরানগামী যে বাসে উঠেছিলেন, সেই একই বাসে ছিলেন হোসেইন ফাইজ নামের এক ফুটবল কোচ।
ফাইজ তেহরানের স্থানীয় এক ক্লাবের সঙ্গে জড়িত। বেইরানভান্দকে তিনি প্রস্তাব দিলেন, আমাদের ক্লাবে অনুশীলন করতে পারো। তার বদলে ৩০ ইউরো করে দিতে হবে। সে তো অকূলপাথারে। দেওয়ার মতো টাকা তো নেই-ই, নেই তেহরানের মতো বড় শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই। কোথায় থাকবেন, কোথায় খাবেন আর অনুশীলনের জন্য টাকাটাই-বা জোগাড় হবে কীভাবে!
চালচুলোহীন অবস্থায় তেহরানের আজাদি টাওয়ারের নিচে বেইরানভান্দের অনেক রাত কেটেছে। সেখান থেকে তাঁর ঠিকানা হয় ক্লাবের সদর দরজার সামনের জায়গাটুকুতে। বিশ্বাস হচ্ছে না? বেইরানভান্দের মুখেই শুনুন, ‘ক্লাবের গেটের সামনে ঘুমাতাম। সকাল হলে দেখতাম, সামনে অনেক পয়সা পড়ে আছে। সবাই আমাকে ভিক্ষুক ভাবত। তখন পেটপুরে একটু খেতে পারতাম।’
ক্লাবের এক সতীর্থ দয়াপরবশ হয়েই তাঁর বাবার দোকানে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল। সঙ্গে রাতে থাকা ও তিন বেলা খাওয়ার সুযোগ। সেখানেও টিকতে পারেননি বেশি দিন। নিলেন গাড়ি ধোয়ামোছার কাজ। গাড়ি ধুতে ধুতেই একদিন দেখা হয়ে গেল ইরানের কিংবদন্তি ফুটবলার আলী দাইইর সঙ্গে। যে গ্যারেজে গাড়ি ধুতেন, সেখানে এলেন ইরানের এই সাবেক তারকা। এমনিতেই উচ্চতার জন্য সে গ্যারেজে এসইউভি ধরনের গাড়ি ধোয়ার ব্যাপারে তাঁর খ্যাতি ছিল। দাইইকে দেখে তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। বেইরানভান্দকে যাঁরা জানতেন, সবাই ঠেলতে থাকল দাইইকে অন্তত নিজের স্বপ্নের কথাটা বলার। কিন্তু কেন যেন তা হলো না। আত্মমর্যাদাও বাদ সেধেছিল তাতে।
দাইইকে কেন নিজের ইচ্ছার কথা বলতে পারেননি, এটা বলেছেন গার্ডিয়ানকে, ‘আমার খুব লজ্জা করত। জানি, আমার কথা শুনলে দাইই নিশ্চয়ই আমাকে সর্বোচ্চ সাহায্যটাই করতেন। কিন্তু কেন জানি তাঁকে বলতে পারিনি।’
বেইরানভান্দ এরপর একদিন নাফত-ই-তেহরান ক্লাবে যোগ দেন। সেখানে নামাজ পড়ার কক্ষে ঘুমাতেন। কিন্তু এভাবে তো বেশি দিন থাকা যায় না। বেইরানভান্দও তাই সেই নামাজ পড়ার কক্ষ ছেড়ে কাজ নেন পিৎজার দোকানে। রাতে সেখানেই থাকতেন। সেখানেও আরেক গল্প। নাফত-ই-তেহরানের কোচ গেলেন সেই দোকানে। বেইরানভান্দ তো কিছুতেই ওয়েটার হিসেবে তাঁর সামনে দাঁড়াবেন না। কিন্তু দোকানমালিক বাধ্য করেছিলেন। প্রতিদানে বেইরানভান্দ সেই দোকানও ত্যাগ করেছিলেন।
আবারও কিছুদিন ক্লাবছাড়া। কিন্তু অনুশীলনটা চালিয়ে গেছেন তিনি। এরপর পেটের দায়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নিলেন। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর নাফত-ই-তেহরান থেকে ডাক পান বেইরানভান্দ। কপাল খুলতে শুরু করল। সেই ক্লাবে থাকতেই ইরান অনূর্ধ্ব-২৩ দলে ডাক পেলেন বেইরানভান্দ। নাফতের নিয়মিত গোলরক্ষক থাকাকালীন শৈশবের সেই ‘দাল পারান’ খেলার বিদ্যেটা কাজে লাগান তিনি। হাত দিয়ে অনেক দূরে বল ছুড়তে পারতেন। এক ম্যাচে ৭০ মিটার দূরে ‘অ্যাসিস্ট’ করে নজরও কাড়লেন বিদেশি সংবাদমাধ্যমের। বাকিটা ইতিহাস।
২০১৫ সালে ইরান জাতীয় দলে অভিষিক্ত এই গোলরক্ষক কাল মুখোমুখি হয়েছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। ১২ গজ দূর থেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলারের পেনাল্টি শট ফিরিয়ে দেওয়ার পর কি বেইরানভান্দের মনে পড়েছে ফেলে আসা সেই কষ্টের দিনগুলোর কথা?
না, সেসবই এখন ইতিহাসের খাতায়। বেইরানভান্দ সেখানে নতুন যে পাতা সংযুক্ত করলেন, সেটি তো অন্য রকম। গর্বের আর এগিয়ে চলার হাতছানির। রোনালদোর পেনাল্টি ঠেকিয়ে তিনি এখন বিশ্বতারকা। একবার ভাবুন তো, বাড়ি থেকে না পালালে বেইরানভান্দ কি এই স্বপ্ন ছুঁতে পারতেন!