জাতীয় দল থেকে বাদ নাবিব নেওয়াজ
জাতীয় দল থেকে বাদ নাবিব নেওয়াজ

বাড়ি থেকেই বেরোচ্ছেন না বিব্রত নাবিব, ঘটনা থেকে নিলেন শিক্ষা

ঢাকা থেকে অনেকবারই বগুড়ায় শিবগঞ্জ উপজেলার গাংনগরে নিজের গ্রামের বাড়ি গেছেন দেশের অন্যতম শীর্ষ ফুটবলার নাবিব নেওয়াজ। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার রাতের যাওয়া ছিল একটু ভিন্ন।

এবার তিনি বাড়ি ফিরেছেন শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার হতাশা নিয়ে। সেই হতাশায় বাড়ি থেকেই নাকি বেরোচ্ছেন না। আজ ফোনে প্রথম আলোকে সে কথাই জানালেন নাবিব, ‘সবাই কি–না–কি মনে করে, তাই বাড়ি থেকে বের হচ্ছি না! সবখানে হেডলাইন হয়েছে।

আমি নাকি শৃঙ্খলা ভেঙেছি। আসলে তো ব্যাপারটা তা নয়। একটা ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছে। তবু একরকম লজ্জাও লাগছে। কারণ, এভাবে তো কখনো জাতীয় দল থেকে বাদ পড়িনি।’

ঘটনা হলো, আগামী মাসে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব সামনে রেখে ১৬ মে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ছিল জাতীয় দলের ২০ ফুটবলারের রিপোর্টিং। কিন্তু জাতীয় দলের স্ট্রাইকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া নাবিব এসেছেন পরদিন দুপুরে।

এর কারণ হিসেবে ঢাকা আবাহনীর অধিনায়ক বলেছেন, জাতীয় দলের ক্যাম্প ডাকার বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। বাড়িতে থাকায় তিনি খবর পাননি। বাফুফে থেকে তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।

তবে বাফুফে বলছে, নাবিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। শেষমেশ, সোমবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে জাতীয় দলের ম্যানেজার ইকবাল হোসেন নাবিবকে ফোন করেন। নাবিব তখন ইকবালকে বলেন, ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁকে কেউ কিছু বলেনি।

নাবিবকে তখন সোমবার রাতের মধ্যেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে বলা হয় বাফুফের পক্ষ থেকে, যাতে মঙ্গলবার সকালে নাশতার টেবিলে তাঁকে পান কোচ। কোচকে সেভাবেই বাফুফের পক্ষ থেকে জানিয়ে রাখা হয়। বলা হয়, নাবিব রাতে রওনা দেবেন।

কিন্তু রাতে নাবিব রওনা দেননি। এ ক্ষেত্রে বৃষ্টিকে কারণ দেখাচ্ছেন তিনি। প্রথম আলোকে আজ নাবিব বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে আমি আসলে থেকে বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি। তা ছাড়া রাতে প্রাইভেটকারও ম্যানেজ করা যায়নি। ফলে আমার পক্ষে রাতে আসা সম্ভব হয়নি।’

নাবীব নেওয়াজের সঙ্গে কাবরেরা

নাবিবের এই ‘বৃষ্টিতত্ত্ব’ নিয়েও আছে বিভ্রান্তি। সোমবার রাতে বগুড়ায় কি এতই বৃষ্টি হয়েছে যে বাড়ি থেকে বেরোনো সম্ভব হয়নি! বৃষ্টি হলেও তাঁর তো বাফুফেকে সেটা জানানো উচিত ছিল। কিন্তু নাবিব সেটা জানাননি। ফলে তিনি যে রাতেই আসছেন না, বাফুফে তা জানত না। জানলে বাফুফে সেভাবেই বলে রাখত কোচকে। অন্তত তেমনটা বলছে বাফুফে।

আর বাফুফে জানলে হয়তো নাবিবের এমন পরিণতি হতো না। সমস্যা হলো, বাফুফেকে না জানিয়ে নাবিব নিজেই সিদ্ধান্ত নেন যে রাতে নয়, পরদিন সকালে রওনা দেবেন।

যা–ই হোক, মঙ্গলবার সকালে নাশতার টেবিলে নাবিবকে না পেয়ে কোচ বেজায় ক্ষুব্ধ হন। বাফুফের সংশ্লিষ্ট কর্মীকে তখন তিনি ফোন করে বলেন, ‘ওর আর আসার দরকার নেই। ওকে জানিয়ে দিন ক্যাম্পে আর না আসতে।’ কাবরেরা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ফুটবলাররা উনিশ-বিশ। কেউই দলে অপরিহার্য নয়। তাই শৃঙ্খলাই আগে।’

কোচের এই মনোভাব জানার পর নাবিবকে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয় ক্যাম্পে আর না আসতে। তবু নাবিব ঢাকায় এসে টিম হোটেলে যান। গিয়ে তাঁর আসার কথা জানান একজন সহকারী কোচকে।

ওই কোচ জানান, প্রধান কোচ কাবরেরা দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। এই সময় লবিতে প্রায় এক ঘণ্টা বসে ছিলেন নাবিব। এরপর দেখা হলে কোচকে নিজের সমস্যার কথা বলেন নাবিব। বলেন, ‘রাতে অনেক বৃষ্টি ছিল। তাই আমি আসতে পারিনি।’

নাবিবের এই যুক্তিতে খুশি হতে পারেননি কাবরেরা। কারণ, নাবিবকে সোমবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে মঙ্গলবার সকাল সতাটায় পর্যন্ত ধরলে ক্যাম্পে আসতে অন্তত ১২ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। কিন্তু সময়টা কাজে না লাগিয়ে নাবিব কিছুটা ঢিলেঢালা মনোভাব দেখান। যে কারণে তাঁকে বড় শাস্তিই পেতে হয়েছে।

নাবীব নেওয়াজ

জাতীয় দলের ব্রাজিলিয়ান কোচ এডসন সিলভা ডিডো ২০০৮ সালে একসঙ্গে আটজন ফুটবলারকে ক্যাম্প থেকে বের করে দিয়েছিলেন। জাহিদ হাসান এমিলিসহ সে সময়ের শীর্ষ ওই ফুটবলাররা ঠিকমতো অনুশীলন করতেন না বলে অভিযোগ আনেন ডিডো। অবিশ্বাস্য হলেও তখন ঘটনার পরম্পরায় ডিডোকেই উল্টো বরখাস্ত করে বাফুফে।

বাংলাদেশের ফুটবলারদের শৃঙ্খলাভঙ্গ এখানেই শেষ নয়। ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কায় চার জাতি টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার আগে মোহামেডানের তৎকালীন ডিফেন্ডার আতিকুজ্জামান জাতীয় দলে ডাক পেলেও ক্যাম্পেই আসেননি। কাউকে তিনি কিছুই জানাননি। কাজেই ক্যাম্পে দেরিতে আসা অনেকটা রীতি হয়ে গেছে এ দেশে।

এই ধারা অতীতেও ছিল, এখনো আছে। একসময় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় রজনীকান্ত বর্মণের কোনো হদিস পাওয়া যেত না ক্যাম্প ডাকলে। পরে জানা যেত, তিনি পশ্চিমবঙ্গে আছেন শ্বশুরবাড়িতে। সেখান থেকে কয়েক দিন পর আসতেন ক্যাম্পে।

বিদায়ী কোচ জেমি ডের সময় অনেক ফুটবলারই জরিমানা গুনেছেন। জেমির সময় রাত ১০টার পর রুমের বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। ঝাল খাবার খাওয়া ছিল বারণ। এগুলোর অন্যথা হলে জরিমানা দিতে হতো ফুটবলারদের। নাবিব নিজেই জানালেন, এমন টুকটাক জরিমানা তিনি জেমির ক্যাম্পেও দিয়েছেন।

দুর্দান্ত ভলিতে নাবিবের গোল

এই যখন দেশের ফুটবল–সংস্কৃতি, নাবিব হয়তো ভেবেছেন এ আর এমন কী, ‘কাল সকালে যাই’। কিন্তু কাবরেরা সেটা গ্রহণ করেননি। এ ক্ষেত্রে কোচকে দোষারোপ করা যাবে না। কোচ তাঁর খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলার ব্যাপারে জোর দেবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

তবে নাবিবের আক্ষেপ অন্য জায়গায়। জাতীয় দলের ২০১৫ সাল থেকে খেলছেন, গোটা পাঁচেক গোলও করেছেন। সেসব বিবেচনায় তাঁকে একটা সুযোগ দিতে পারতেন কোচ। কিন্তু কোচ দেননি।

কঠোর অবস্থানই নিয়েছেন তিনি। আর তাতে হতাশা নিয়ে নাবিব বলছেন, ‘যেহেতু অতীতে এমন কিছু করিনি আমি, তাই এবার সতর্ক করে ছেড়ে দিতে পারত। আবাহনীতে আট বছর ধরে খেলছি, কখনো শোকজ পাইনি। এবার বাফুফে শোকজ করল। এটা অনেক বেশি বিব্রতকর আমার জন্য।’

তবে দিন শেষে কোচের সিদ্ধান্ত মেনে ভবিষ্যতের জন্য নিলেন শিক্ষাও, ‘কারও ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি কোচের সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। পাশাপাশি এই ঘটনা থেকে শিক্ষাও নিচ্ছি।’

শুধু নাবিব নন, এ ঘটনা অন্যদের জন্যও শিক্ষা। একটা সতর্কবার্তাও।