চার গোল দিয়েছেন তোরেস-অবামেয়াংরা
চার গোল দিয়েছেন তোরেস-অবামেয়াংরা

কৌশলের কাটাছেঁড়া

বার্সেলোনার জন্য ফাঁদ পেতে রিয়ালই ফাঁসল

ম্যাচের আগে সবচেয়ে বড় আলোচনা ছিল করিম বেনজেমাকে ঘিরে। রিয়াল আক্রমণভাগের সবচেয়ে বড় তারকা—তাঁকে ছাড়া গোল বের করতে রিয়ালের সমস্যা হয়—সেই বেনজেমাকে ছাড়া কীভাবে ক্লাসিকোর মতো বড় ম্যাচ খেলবে রিয়াল? বেনজেমার জায়গায় কে খেলবেন বার্সার বিপক্ষে? বেনজেমাকে ছাড়া কোচ কার্লো আনচেলত্তির কৌশলই–বা কেমন হবে?


প্রশ্ন ছিল হাজারো। কিন্তু সব প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দু একজনই। করিম বেনজেমা।

কৌশল সফল হয়নি আনচেলত্তির

দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ডকে হারিয়ে আনচেলত্তি যেন আরও খেই হারিয়ে ফেললেন। রিয়াল গোল তো করতে পারেইনি, উল্টো হজম করল এক হালি। নিজেদের মাঠে রিয়াল মাদ্রিদ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে হেরেছে ৪-০ গোলে। আনচেলত্তির দলকে দেখে মনে হলো ছন্নছাড়া, জোর করে ফুটবল খেলছে। বেনজেমা-সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরও দশ রকমের সমস্যা ডেকে এনেছেন আনচেলত্তি।

বেনজেমার জায়গায় মূল একাদশে এদেন হ্যাজার্ড, গ্যারেথ বেল, মারিয়ানো দিয়াজ, ইসকো কিংবা দানি সেবায়োস নন, সুযোগ পেলেন উরুগুইয়ান মিডফিল্ডার ফেদেরিকো ভালভার্দে। কিন্তু স্ট্রাইকার হিসেবে বেনজেমার যে ভূমিকা, সেটা কোনো নির্দিষ্ট একজনের ওপর ন্যস্ত করেননি আনচেলত্তি। দায়িত্বটা ভাগ করে দেন তিন মিডফিল্ডার লুকা মদরিচ, টনি ক্রুস ও ভালভার্দের মধ্যে।

৪-৪-২ ছকে ক্রুস ও মদরিচ ওপরে উঠে যাচ্ছেন, বাকি সবাই নিচে নেমে যাচ্ছেন

এমনিতেই কাগজে-কলমে ৪-৩-৩ বলা হলেও বল পায়ে না থাকলে মাঠে রিয়ালের ছক কখনোই ৪-৩-৩ থাকে না, ৪-৫-১ বা ৪-৪-২–এ রূপ নেয়। মাঝমাঠ থেকে উঠে গিয়ে বেনজেমার পাশে প্রেস করা শুরু করেন লুকা মদরিচ। বার্সেলোনার বিপক্ষে যেহেতু বেনজেমা ছিলেন না, মদরিচের পাশে কখনো দেখা গেল ক্রুসকে, কখনো ভালভার্দেকে। মিডফিল্ডাররা ফরোয়ার্ডের ভূমিকা নিচ্ছেন দেখে দুই উইঙ্গার ভিনিসিয়ুস আর রদ্রিগো ম্যাচের অধিকাংশ সময়ই কাটালেন দুই পাশে।

এখানে ক্রুস শুধু ওপরে, ৪-৫-১ ছকে বাকি সবাই নিচে

বেনজেমার জায়গায় কখন কে খেলেন, সেটা নিয়ে বার্সেলোনাকে ৯০ মিনিট ধন্দে রাখার পরিকল্পনাটা খারাপ ছিল না, যদি ঠিকভাবে সবাই বাস্তবায়ন করতে পারতেন। কিন্তু মদরিচ-ভালভার্দেরা সেটা পারেননি। কাকে কখন ওপরে উঠে প্রেস করতে হবে, কখন নিচে নেমে আসতে হবে, বুঝতে পারেননি কেউ।

এখানে আবার ক্রুস নয়, বেনজেমার জায়গা নিতে চলে এসেছেন মদরিচ

ফল? ঝঞ্ঝাটহীনভাবে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বার্সেলোনা।

সের্হিও বুসকেতস বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা–ও বুসকেতসকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা যায়, যদি ভালোভাবে তাঁকে প্রেস করা যায়। গত কয়েক মৌসুমে লিভারপুল, বায়ার্ন মিউনিখ, পিএসজির মতো দলগুলো যেটা করে দেখিয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত ভালভার্দে-মদরিচদের ওপরে উঠে আসার কারণে বুসকেতসকে ঠিকঠাক প্রেস করতে পারেনি রিয়াল মাদ্রিদ। মাঝমাঠে ঢের জায়গা পেয়েছেন এই বর্ষীয়ান মিডফিল্ডার। মাঝমাঠে বুসকেতসকে জায়গা দিলে কী হয়, সেটা গত রাতে রিয়াল মাদ্রিদ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বুসকেতসের খেলা দেখে মনেই হয়নি, তাঁর বয়স ৩৩ পেরিয়েছে!

পিকে কে প্রেস করার কেউ নেই, স্বাচ্ছন্দ্যে মাঝমাঠে উঠে এসে দেম্বেলেকে পাস দিচ্ছেন

বুসকেতস তো বটেই, রিয়াল মাদ্রিদের ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলা কেউই বার্সেলোনার দুই সেন্টারব্যাককে প্রেস করতে পারছিলেন না। পিকে, গার্সিয়ারা সুযোগ পেলেই মাঝমাঠে এসে পড়ছিলেন বল পায়ে, খেলা গড়ে দিচ্ছিলেন। বুসকেতসের মতো এই দুজনেরও একই সমস্যা, প্রেসের মুখে ভেঙে পড়েন।

কিন্তু রিয়াল ঠিকঠাক প্রেস করতে পারলে তো! প্রথম গোলে নজর দেওয়া যাক, বল পায়ে পিকে বলতে গেলে বুসকেতসের জায়গায় চলে এসেছিলেন। সেখান থেকে সরাসরি পাস দেন ডান প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে থাকা ফরাসি উইঙ্গার উসমান দেম্বেলেকে। দেম্বেলেকে দেখে রাখার দায়িত্ব রিয়াল অধিনায়ক নাচো ফার্নান্দেসকে দেওয়া হলেও পিকে যে এত আগে দেম্বেলেকে পাস দিয়ে দেবেন, বুঝতে পারেননি নাচো। ফলে তখনো দেম্বেলের কাছে দেখা যায়নি তাঁকে। পিকের পাস নিয়েই মাঠের ডান প্রান্ত থেকে বক্সে থাকা পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াংয়ের উদ্দেশে নিখুঁত ক্রস দেন দেম্বেলে। প্রথম গোলটা এভাবেই পেয়ে যায় বার্সেলোনা।

পিকের মতো গার্সিয়াও সুযোগ পেয়েছেন লম্বা বল দেওয়ার। ওদিকে রিয়ালের মাঝমাঠে সে পাস ঠেকানোর জন্য এক কাসেমিরো ছাড়া আর কেউ নেই

বার্সেলোনার কোচ জাভির কৌশলের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গই এটা। যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রতিপক্ষের কেউ প্রেস করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের পায়ে বল রেখে সামনে এগিয়ে মাঝমাঠে চলে আসার জন্য সেন্টারব্যাকদের নির্দেশ দেন জাভি। প্রেস করাতে রিয়াল মাদ্রিদ ভজকট পাকিয়ে ফেলায় পিকের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার জন্য তেমন কেউই ছিলেন না। পিকেও স্বাচ্ছন্দ্যে বল পায়ে চলে এসেছিলেন মাঝমাঠে।

ব্যাপারটা অনেকটা এমন, জাভি যেন তাঁর কৌশলের সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারেন, সেটার জন্য রিয়াল কোচ আনচেলত্তি যেন রাস্তা বানিয়ে দিচ্ছিলেন!

দুই সেন্টারব্যাক মাঝমাঠে উঠে আসার পাশাপাশি লম্বা পাস দেওয়া শুরু করেছিলেন দুই উইঙ্গার ফেরান তোরেস আর দেম্বেলের দিকে। কৌশলগত দিক দিয়ে ম্যাচে জাভির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকল এ ব্যাপারটা।

সে কাজটা আনচেলত্তি নিজেও করতে চেয়েছিলেন, যে কারণে দুই উইঙ্গারকে স্ট্রাইকারের জায়গায় মাঝখানে নিয়ে আসেননি, উইঙ্গারদের নিজ নিজ পজিশনেই রেখেছিলেন, মিডফিল্ডারদের আনছিলেন স্ট্রাইকার হিসেবে। কিন্তু জাভি যেভাবে উইঙ্গারদের খেলাতে পারছিলেন, রিয়ালের উইঙ্গারদের সেভাবে খেলানো তো লাগবে! মাঝমাঠ থেকে বলই এল না উইঙ্গারদের পায়ে। আর থাকবেই বা কি করে, মাঝমাঠ থেকে ভিনিসিয়ুসদের পায়ে বল দেওয়ার জন্য ছিলেনবই বা কে, সবাই তো বেনজেমার অভাব পূরণ করতে উঠে যাচ্ছিলেন ওপরে!

এই মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ভিনিসিয়ুসের খেলা দেখেও চেনা যাচ্ছিল না এ ম্যাচে। এমনিতেও বেনজেমা না থাকলে তার প্রভাব ভিনিসিয়ুসের খেলাতে পড়ে, তা–ও জাভি এমন এক পরিকল্পনা বের করলেন, যাতে পুরো ম্যাচে এই ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার নিষ্ক্রিয় থাকেন।

ওপর থেকে এভাবেই রিয়ালকে প্রেস করে গেছে বার্সেলোনা। স্ট্রাইকার অবামেয়াংয়ের পাশে সুবিধামতো উঠে যাচ্ছিলেন পেদ্রি কিংবা ডি ইয়ং

ম্যাচে খেলেননি নিয়মিত রাইটব্যাক দানি আলভেজ। তাঁর জায়গায় সেন্টারব্যাক রোনালদ আরাউহোকে খেলানো হলো রাইটব্যাক হিসেবে। এই সিদ্ধান্তটাই শাপেবর হলো বার্সেলোনার জন্য। আলভেজের বয়স ৩৮ ছাড়িয়েছে, ভিনিসিয়ুসের মতো গতিশীল উইঙ্গারকে আটকানোর কাজটা তাঁর বয়সী পা দুটো হয়তো করতে পারতো না। যে কাজটা নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন রোনালদ আরাউহো। গোটা ম্যাচে ভিনিসিয়ুসের পিছু পিছু ছায়া হয়ে থাকলেন এই উরুগুইয়ান ডিফেন্ডার। বেশি ওপরে উঠে আক্রমণে সাহায্য করলেন না, অবশ্য সাহায্য করাও লাগেনি তাঁর। আরাউহো ভিনিসিয়ুসকে আটকে তো রাখছিলেনই, উল্টো রিয়ালের কোনো মিডফিল্ডার ভিনিসিয়ুসের উদ্দেশে সেভাবে পাসও পাঠাচ্ছিলেন না। ভিনিসিয়ুস যেন বাঁ প্রান্তে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ হয়ে ছিলেন।

ফলে আরাউহোর ওপরে থাকা উইঙ্গার দেম্বেলেকেও রক্ষণকাজে সাহায্য করার জন্য নিচে নেমে আসতে হয়নি, ইচ্ছেমতো আক্রমণ করে গেছেন। দুটি গোলসহায়তা সেটারই প্রমাণ।

তিন ডিফেন্ডারকে প্রেস করছেন বার্সেলোনার তিন ফরোয়ার্ড

বেনজেমা না থাকায় রিয়াল মাদ্রিদের ফরোয়ার্ডরা ঠিকঠাক প্রেস না করতে পারলে কি হয়েছে, বার্সার ফরোয়ার্ডরা নিজেদের প্রেস করার কাজটা করেছেন ষোলো আনা। প্রায় সময়ই দেখা যাচ্ছিল, বার্সার তিন ফরোয়ার্ড ফেরান তোরেস, অবামেয়াং ও দেম্বেলে রিয়ালের তিন ডিফেন্ডার আলাবা, মিলিতাও ও নাচোকে প্রেস করছিলেন। শুধু তা–ই নয়, নিচ থেকে উঠে আসছিলেন ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংও। ওদিকে কে কখন ওপরে উঠবেন, সে চিন্তায় ব্যস্ত থাকা মদরিচ, ভালভার্দে আর ক্রুস ও কামাভিঙ্গারা ডি ইয়ং বা পেদ্রির হুটহাট এভাবে উঠে যাওয়ার ব্যাপারটা সামাল দিতে পারেননি। ম্যাচের তৃতীয় ও চতুর্থ গোলটি এ রকম প্রেসের কারণেই হয়েছে।

মাঝমাঠ থেকে উঠে আসছেন ডি ইয়ং

শুধু স্ট্রাইকারই নন, সেন্টারব্যাক হিসেবে কে কখন খেলবেন, সেটা নিয়েও ধোঁয়াশা ছিল রিয়াল তারকাদের মধ্যে। মদরিচ-ক্রুসকে দিয়ে বেনজেমার কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে না দেখে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে রাইটব্যাক কারভাহালকে সরিয়ে নামানো হলো স্ট্রাইকার মারিয়ানো দিয়াজকে। ফলে রাইটব্যাক হিসেবে খেলানোর জন্য লেফটব্যাক থেকে জায়গা বদল করে নিয়ে আসা হলো নাচোকে। নাচোর জায়গায় লেফটব্যাকের ভূমিকা নিলেন সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলা ডেভিড আলাবা।

চার গোল দেওয়ার পর ৪-৫-১ ছকে রক্ষণ করে গেছে বার্সা

আলাবার জায়গায় খেলানোর জন্য আরেক সেন্টারব্যাক এদের মিলিতাওর পাশে কখনো নেমে গেলেন এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, কখনো কাসেমিরো। বার্সেলোনাকে ধন্দে ফেলে দিতে গিয়ে রিয়াল নিজেই ধন্দে পড়ে গেল যেন! বার্সার জন্য ফাঁদ পেতে সে ফাঁদে নিজেরাই ফাঁসল!


যে সংশয়ের চূড়ান্ত রূপ দেখা গেল সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর স্কোরবোর্ডে। ৪-০ লেখা স্কোরবোর্ডটা রিয়ালকে যে পোড়াবে বহুদিন!