‘কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে...’ কবির সুমনের এ গানটা গুনগুনিয়ে গাইতে পারেন আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পাঁড় সমর্থকেরা। দর্শকপ্রিয় দুই ক্লাবের লড়াইয়ে উত্তাপটা উধাও হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই যে কাল সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল, তা কজনই বা জানেন!
যাঁরাও জানতেন, তাঁদেরও ইউটিউবে চোখ রাখতে পারার কথা নয়। কারণ একই সঙ্গে চট্টগ্রামে চলছিল বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যকার ওয়ানডে ম্যাচ। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের সময়ে আফগানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের ইনিংস মেরামতে লড়ছিলেন আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। শেষ পর্যন্ত ১৭৪ রানের রেকর্ড জুটি গড়ে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেনও তাঁরা। ঠিক সেই সময় মোহামেডানের বিপক্ষে আবাহনীর ১-০ গোলের জয়ের ম্যাচ নিয়ে আগ্রহী হওয়া মানুষ খুব একটা খুঁজে পাওয়ার কথা না।
তবুও আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ বলে কথা। কাল সে ম্যাচে এমন একটা কীর্তি গড়েছেন মোহামেডানের আবিদ হোসেন, যা বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসেই আর কারও নেই।
আবিদের বাবা দেশের ফুটবলের এক বিখ্যাত নাম। আশি ও নব্বইয়ের দশকের প্রথমভাগে তিনি ছিলেন মাঠ মাতানো ফুটবল তারকা। মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন। রাইট ব্যাক জায়গাটার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন সাদাকালো শিবিরে। ঢাকার মাঠে লম্বা থ্রোয়ের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। হ্যাঁ, তিনি আবুল হোসেন। মোহামেডানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা।
কাল আবুল হোসেনের ছেলে আবিদ আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে খেলতে নেমেই রেকর্ডটা করলেন। বাবা নিজের ক্যারিয়ারে অনেক আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথে মাঠে নেমেছেন। কাল ছেলে নামলেন। দেশের ফুটবলের স্বর্ণযুগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে খেলা কোনো খেলোয়াড়ের সন্তান হিসেবে এই প্রথম সেই ম্যাচে মাঠে নামার সৌভাগ্য হলো তাঁর।
আবুল হোসেন খেলা ছাড়ার পর কোচিংয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। ২০০৪ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। আবিদের বেড়ে ওঠা সেখানেই। সেখানেই ফুটবলে হাতেখড়ি। আবিদের প্রথম ফুটবল গুরু তাঁর বাবাই। ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনেকবারই পা রেখেছেন। কাল বাবার গায়ে চড়া সেই বিখ্যাত সাদাকালো জার্সিতে খেললেন আকাশি-নীলের আবাহনীর বিপক্ষে।
পুরো ম্যাচ খেলেননি। কুঁচকিতে চোট থাকায় ম্যাচের ৬৭ মিনিটে আবিদকে তুলে নেন কোচ শন লিন। একটি জায়গায় বাবা-ছেলে একবিন্দুতেই আছেন। দুজনেই রক্ষণের খেলোয়াড়। তবে বাবা রাইট ব্যাক হলেও ছেলে খেলেন লেফট ব্যাক পজিশনে।
২০১৭ সালে আবিদের বাংলাদেশ অধ্যায় শুরু, মোহামেডানেই। কাগজে-কলমে এবার নিয়ে মোহামেডানের সঙ্গে তিন মৌসুম থাকলেও মাঝখানে আমেরিকায় ফিরে গিয়েছিলেন। এবারই প্রথম আগেভাগে এসে মৌসুমের শুরু থেকে দলের সঙ্গে অনুশীলন শুরু করেন। জয় করে নিয়েছেন কোচের মনও। গত ২৮ নভেম্বর স্বাধীনতা কাপে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের বিপক্ষে মোহামেডানের জার্সিতে অভিষেক। এর পর থেকেই মোহামেডানের লেফট ব্যাক আবিদই কোচের প্রথম পছন্দ।
কাল যে একটা ইতিহাসের অংশ হয়েছেন, সেটি জানতেন না আবিদ। প্রথম আলোকে তিনি বলছিলেন, ‘তাহলে তো এটা অনেক বড় ব্যাপার। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলা কোনো খেলোয়াড়ের সন্তান হিসেবে প্রথমবারের মতো এ ম্যাচ খেলা! গর্ব করার মতোই।’
তবে ম্যাচটি নিয়ে রোমাঞ্চিত ছিলেন আবিদ, “যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সময়ে সকালে ম্যাচটি হয়েছে, এই সময়ে বাবা দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি সম্ভবত খেলা দেখেননি। খেলা শেষে আমার সঙ্গে কথাও হয়নি। তবে আগের দিন (গত পরশু) ম্যাচ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আবাহনীর বিপক্ষে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলতে।’ ম্যাচের আগে আমি খুব মানসিক চাপে ছিলাম। কিন্তু খেলা শুরু হলে সে চাপ আর থাকেনি।”
আবাহনী মোহামেডান ম্যাচটা আবুল দেখেছেন কি না, তা জানা গেল না। ফ্লোরিডায় অবস্থান করা আবুলকে মেসেঞ্জারে কল করা হলেও তিনি তা ধরেননি। তবে এই ম্যাচের আগে ছেলে সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ‘আমার ছেলেটা বয়সে তরুণ। এখনো শিখছে। আগে মিডফিল্ডার থাকলেও বাংলাদেশে গিয়ে ডিফেন্ডার হয়ে গিয়েছে। বড় খেলোয়াড় হতেই হবে, এ নিয়ে কখনো চাপ দেইনি ছেলেকে। মোহামেডানের হয়ে খেলছে, এটাই আমার ভালো লাগে।’
আবুল হোসেন ২০ বছর বয়সেই জাতীয় দলে জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন। করেছেন জাতীয় দলের অধিনায়কত্বও। সে হিসেবে বাবার তুলনায় পেছনে পড়ে গিয়েছেন আবিদ। ২৬ বছর বয়সে এসে এখনো জাতীয় দলে ডাক পাওয়া হয়নি তাঁর। তবে এই মৌসুমে যেভাবে খেলছেন আবিদ, তাতে ভবিষ্যতে লাল-সবুজ জার্সিতে খেলার সুযোগ আসতেই পারে তাঁর সামনে।