বাবার পথ ধরে ছেলেও ফুটবলার হয়েছেন-এমনটা হরহামেশাই দেখা যায়। দেখা গেছে একই পরিবারের একাধিক ভাইকেও ফুটবল খেলে বিখ্যাত হতে। কিন্তু দাদা-বাবা-নাতি-তিন প্রজন্মই ফুটবলার এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন, এমন ঘটনা একটু বিরলই।
এ বছরের শুরুর দিকে দাদা সিজার মালদিনি ও বাবা পাওলো মালদিনির পথ ধরে এসি মিলানের মূল দলে অভিষেক হয়েছে ড্যানিয়েল মালদিনির। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফুটবলার হওয়ার ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত পরিবার মালদিনিরাই। তবে তাঁরাই একমাত্র নন।তিন প্রজন্মের এমন কিছু ফুটবল পরিবার নিয়েই এবারের ধারাবাহিক। আজ পড়ুন শেষ পর্ব—
প্রথম প্রজন্ম: মার্টিন কোমান
দ্বিতীয় প্রজন্ম: রোনাল্ড কোমান, আরভিন কোমান
তৃতীয় প্রজন্ম: রোনাল্ড কোমান জুনিয়র, লেনস কোমান
তিন প্রজন্মের মধ্যে মাঝের প্রজন্মের যিনি, তাঁকে সারা ফুটবল বিশ্ব এক নামে চেনে। রোনাল্ড কোমান নিজের ক্যারিয়ারে ইয়োহান ক্রুইফের অধীনে বার্সেলোনার বিখ্যাত সেই ‘ড্রিম টিমে’ খেলেছেন। বেশ বৈচিত্র্যময় খেলোয়াড় ছিলেন, মাঠের বিভিন্ন জায়গায় খেলতে পারতেন। খেলোয়াড় হিসেবে বার্সেলোনার হয়ে টানা চারটি লা লিগা জিতেছেন (১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত), তাঁর গোলেই ১৯৯২ সালে বার্সেলোনা প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরা হয়। নেদারল্যান্ডসের হয়ে ৭৮ ম্যাচে ১৪ গোল এই মিডফিল্ডারের, জিতেছেন ১৯৮৮ ইউরোর ট্রফি। ওই বছর এবং এর আগের বছর হয়েছেন বর্ষসেরা ডাচ ফুটবলার। ইদানীং আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ঝঞ্জামুখর সময়ে বার্সেলোনার কোচের দায়িত্ব নিয়ে।
কোমান শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই দারুণ ছিলেন না, ব্যক্তিত্বের দিক থেকেও প্রবল শক্তিশালী। বার্সেলোনার কোচ হওয়ার আগে এক দফায় সহকারী কোচ ছিলেন ১৯৯৮-২০০০ সালে। এরপর আয়াক্স, বেনফিকা, পিএসভি, ভ্যালেন্সিয়া, সাউদাম্পটন, এভারটন ও নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলের কোচিং করিয়েছেন। খেলোয়াড়ি জীবনের চেয়ে কোচিং ক্যারিয়ারও কম বর্ণাঢ্য নয়। তবে অর্জন খেলোয়াড় হিসেবেই বেশি।
দুই ভাই একই সময় দুটি জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বে, ফুটবল ইতিহাসে এই ঘটনাও সম্ভবত একমাত্র।
রোনাল্ড কোমানের বড় ভাই আরভিন কোমানের অবশ্য খেলোয়াড় হিসেবে এত নামডাক ছিল না। তবে তিনিও নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলেছেন ৩১টি ম্যাচ। ১৯৮৮ ইউরো জেতা ডাচ দলে ছোট ভাই রোনাল্ডের মতো ছিলেন তিনিও। ভাইয়ের মতোই খেলা ছাড়ার পর কোচিং পেশা বেছে নেন। ফেইনুর্দ, হাঙ্গেরি জাতীয় দল ও আইন্দহোভেনের মতো দলকে কোচিং করানোর পর ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেন ওমান জাতীয় দলের। রোনাল্ড কোমান তখন নেদারল্যান্ডসের কোচ। দুই ভাই একই সময় দুটি জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বে, ফুটবল ইতিহাসে এই ঘটনাও সম্ভবত একমাত্র। আবার রোনাল্ড কোমান এভারটনের কোচ থাকার সময়ে আরভিন ছিলেন তাঁর সহকারী।
আরভিন ও রোনাল্ডের বাবা মার্টিন কোমানও খেলেছেন জাতীয় দলে। ছেলেদের মতো এত অর্জন নেই তাঁর। কপাল খারাপ— অনেকবার নেদারল্যান্ডস দলে ডাক পেলেও মাঠে নেমেছেন মাত্র একবারই। তাঁর ক্লাব ক্যারিয়ারের বড় সময়টা কেটেছে ডাচ শীর্ষ লিগের দল গ্রুনিঙ্গেনে। পরে তাঁর দুই ছেলেও ক্যারিয়ারের কোনো না কোনো সময় খেলেছেন গ্রুনিঙ্গেন ক্লাবে। গ্রুনিঙ্গেন স্টেডিয়ামের একটি স্ট্যান্ডের নামও রাখা হয়েছে কোমান পরিবারের সম্মানে।
এই পরিবারের ফুটবল ঐতিহ্য এখানেই থেমে থাকেনি। বাবাদের পথ ধরে ফুটবলার হয়েছেন রোনাল্ড কোমান জুনিয়র ও আরভিনের ছেলে লেনস কোমানও। রোনাল্ড জুনিয়র গোলরক্ষক, খেলেন ডাচ দ্বিতীয় বিভাগের দল ওসে। একই বিভাগের হেলমোঁদ স্পোর্ত ক্লাবে খেলেন লেনস কোমান।
প্রথম প্রজন্ম: মার্কোস আলোনসো ইমাজ মারকোইতোস
দ্বিতীয় প্রজন্ম: মার্কোস আলোনসো পেনা
তৃতীয় প্রজন্ম: মার্কোস আলোনসো
মার্কোস আলোনসো ইমাজ নামটা অনেকের কাছে অচেনা লাগতে পারে, তবে ‘মারকোইতোস’ বললে স্পেন ও রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকেরা হাসিমুখে বলবেন, ‘ও আচ্ছা তাঁর কথা বলছেন!’ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রিয়াল মাদ্রিদের প্রথম ‘গ্যালাকটিকো’ দলের অন্যতম তারকা মারকোইতোস বিখ্যাত হয়ে আছেন টানা পাঁচটি ইউরোপিয়ান কাপ জেতা দলের ডিফেন্ডার হিসেবে। ওই সময় ছয়বার লা লিগাও জিতেছেন রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে, জিতেছেন কোপা ডেল রে ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। স্পেন দলে নিয়মিত না হলেও খেলেছেন দুটি ম্যাচ।
এই পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম মারকোইতোসের ছেলে মার্কোস আলোনসো পেনা মূলত ছিলেন রাইট উইঙ্গার, তবে আক্রমনভাগের যেকোনো জায়গায় খেলতে পারতেন স্বচ্ছন্দে। বাবা রিয়াল মাদ্রিদের তারকা হলেও মার্কোস ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় খেলেন রিয়ালের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও বার্সেলোনায়। লা লিগায় ৩০২ ম্যাচে ৪৬ গোল, একবার শিরোপা জিতেছেন বার্সেলোনার হয়ে। স্পেনের বয়সভিত্তিক প্রায় সবগুলো দলে খেলা মার্কোস জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ২২টি ম্যাচ, ছিলেন ১৯৮৪ ইউরো রানার্স আপ স্পেন দলেও।
এই মার্কোসের ছেলেই চেলসির লেফট ব্যাক মার্কোস আলোনসো। দাদার ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমিতে বেড়ে ওঠা আলোনসোর। রিয়ালের ‘বি’ দলে কয়েক বছর খেললেও মূল দলে জায়গা পাকা করতে পারেননি, পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। বোল্টনে খেলেছেন তিন মৌসুম, তারপর ফিওরেন্টিনা, সান্ডারল্যান্ড ঘুরে থিতু হন চেলসিতে। প্রিমিয়ার লিগ, ইউরোপা লিগ ও এফএ কাপ—বলার মতো যা শিরোপা জিতেছেন সবই চেলসির হয়ে। আসলে এমন এক সময় আলোনসোর ক্যারিয়ার, যখন স্পেনের সোনালি প্রজন্ম রাজত্ব করছে। আলোনসো তাই খুব একটা থিতু হতে পারেননি জাতীয় দলে। বয়স ২৯ হয়ে গেছে, এখন নতুন করে তরুণদের চ্যালেঞ্জ জানানো একটু কঠিনই আলোনসোর জন্য।
প্রথম প্রজন্ম: সিজার মালদিনি
দ্বিতীয় প্রজন্ম: পাওলো মালদিনি
তৃতীয় প্রজন্ম: ড্যানিয়েল মালদিনি, ক্রিস্টিয়ান মালদিনি
সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত পরিবার। সিজার মালদিনি ও তাঁর ছেলে পাওলো মালদিনি তো এসি মিলানের কিংবদন্তি। অথচ এই পরিবারের পূর্বপুরুষ সিজারের বাবা আলবিনো মালদিনি ছিলেন জাহাজের নাবিক। ইতালিয়ান ডিফেন্ডারদের যে বিশ্বজোড়া সম্মান, সেটার পেছনে বড় ভূমিকা এই পরিবারের। ফুটবলে রক্ষণ কত অভিজাত, কত নান্দনিক হতে পারে, সেটাও মূলত দেখিয়েছেন মালদিনিরাই।
ত্রিয়েস্তিনার হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও সিজার ১৯৫৪ সালে যোগ দেন এসি মিলানে। পাক্কা এক যুগ খেলেছেন মিলানে। চারবার সিরি ‘আ’ জয়ে মিলানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, একবার জিতেছেন ইউরোপিয়ান কাপ। ইতালির হয়ে ১৯৬২ বিশ্বকাপ খেলা সিজার মালদিনি দেশকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারপর কোচিংকে পেশা হিসেবে নেওয়া। মিলান ও ইতালিকে নেতৃত্ব দেওয়া সিজার এই দুই দলেরই কোচ হয়েছেন। জায়গা করে নিয়েছেন ইতালিয়ান ফুটবলের হল অব ফেমে।
বাবার এসব অর্জন ছাড়িয়ে পাওলো মালদিনি পরে হন ইতালি ও মিলানের আরও বড় কিংবদন্তি। তর্কযোগ্যভাবে ফুটবল ইতিহাসের সেরা ডিফেন্ডার বলা যায় তাঁকে, এমনকি সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের ছোট তালিকাতেও রাখতে হবে মালদিনিকে। ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে একটা ক্লাবেই খেলেছেন—মিলান। রোজোনেরিদের হয়ে তাঁর ২৫টি ট্রফি, যার মধ্যে আছে পাঁচটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ও সাতটি সিরি ‘আ’।
টানা ৮ বছর ইতালিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ও ২০০০ ইউরো ফাইনাল খেলা ইতালি দলে ছিলেন, ছিলেন ১৯৯০ বিশ্বকাপ ও ১৯৮৮ ইউরো সেমিফাইনাল খেলা ইতালি দলেও। ৪১ বছর বয়সে ২০০৯ সালে অবসরের পর তাঁর ‘৩’ নম্বর জার্সিটা চিরদিনের জন্য তুলে রাখে মিলান। তবে একই সঙ্গে ক্লাব এই সিদ্ধান্তও নেয়, যদি মালদিনির কোনো ছেলে মিলানের হয়ে খেলেন এবং বাবার জার্সি নম্বর নিতে চান, সে ক্ষেত্রে ফেরত আনা হবে জার্সিটা।
কে জানে সেই দিনটা কাছাকাছি চলে এসেছে কি না! পাওলো মালদিনির দুই ছেলে ক্রিস্টিয়ান মালদিনি ও ড্যানিয়েল মালদিনি দুজনেই বেড়ে উঠেছেন মিলানের একাডেমিতে। ক্রিস্টিয়ান বাবার মতোই ডিফেন্ডার, তবে বাবার প্রতিভা খুব বেশি পাননি সম্ভবত। বয়স ২৪ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো ঝলক দেখাতে পারেননি। মিলানের বয়স ভিত্তিক দল থেকে আর মূল দলে জায়গা করে নিতে পারেননি। এখন খেলছেন ইতালির চতুর্থ বিভাগের দল প্রোসেস্তোতে।
৪১ বছর বয়সে ২০০৯ সালে অবসরের পর পাওলো মালদিনির ‘৩’ নম্বর জার্সিটা চিরদিনের জন্য তুলে রাখে মিলান।
দাদা-বাবা ও ভাইয়ের মতো ডিফেন্ডার না হয়ে ড্যানিয়েল মালদিনি হয়েছেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। মিলানের সবগুলো বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে অবশেষে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মূল দলের হয়ে অভিষেক ড্যানিয়েলের। তাঁকে নিয়ে তাঁর বাবা এবং ক্লাব মিলানেরও অনেক আশা। আপাতত ড্যানিয়েল খেলছেন ২৭ নম্বর জার্সি গায়ে। মিডফিল্ডার বা ফরোয়ার্ডদের জন্য ৩ নম্বর জার্সি একটু বেমানান। হয়তো সে কারণে এখনো বাবার জার্সি ক্লাবের কাছে চাননি, কিংবা এখনো সেই জার্সির ওজন নেওয়ার যোগ্য মনে করেন না নিজেকে।
তাই বলে আশা তো শেষ হয়ে যায়নি, ধমনিতে যে মালদিনি পরিবারের রক্ত!