একজন ‘সুনীল ছেত্রী’ কে খুঁজে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ।
একজন ‘সুনীল ছেত্রী’ কে খুঁজে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ দলে একজন ‘সুনীল ছেত্রী’ না থাকার আক্ষেপ

মাঝখানে কেটেছে কয়েকটি ঘণ্টা। আবার নেমে পড়তে হয়েছে প্রাত্যহিক রুটিনে। কিন্তু মনের ভেতর খচখচ করছে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের ফল। যে ফল হয়তো বাংলাদেশের অনুকূলেও আসতে পারত। হতে পারত অন্তত ড্রও। কিন্তু শনিবার রাতে কুয়ালালামপুরের বুকিত জলিল স্টেডিয়ামে তুর্কমেনিস্তানের কাছে ২-১ গোলে হেরে গেছে বাংলাদেশ।

ফুটবলারদের সবারই তাই মন খারাপ। সেটাই স্বাভাবিক। এমন একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভালো খেলেও শেষ পর্যন্ত হার কার না খারাপ লাগবে! বাংলাদেশ দলের ফুটবলাররাও ব্যতিক্রম নন। তাঁদের কষ্টটা বেশি, কারণ তাঁরা মাঠে নেমে খেলেন।

ম্যাচের পরদিন আজ সকালে ১০টায় বাংলাদেশ দলের হোটেলে পা রেখে দেখা গেল, ফুটবলারদের সবার মুখেই আফসোস। সুইমিং সেরে সবার আগে রুমে যাওয়ার পথে গোলকিপার আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বললেন, ‘ওরা দ্বিতীয় গোলের আগে যখন ক্রসটা করেছে, আমাদের ডিফেন্ডিং লাইন ঠিক থাকলে গোল আর হয় না। আমাদের কিছু ঘাটতি ছিল। ফলে দ্বিতীয় গোলটা হয়ে গেছে। কিন্তু কালকের ম্যাচটা ড্র হলে খুব ভালো লাগত।’

বলতে বলতে খানিকটা আক্ষেপও ঝরে আনিসুরের মুখে, ‘আমাদের দলে একজন সুনীল ছেত্রী থাকলে হয়তো ফল অন্য রকম হতে পারত।’ কথাটা ভুল বলেননি। ভারতকে যেমন একা টানছেন ছেত্রী। জাতীয় দলের হয়ে ১২৮ ম্যাচে যাঁর গোল এখন ৮৩টি! অথচ বাংলাদেশ এই দলের কারও ৩-৪টির বেশি গোল নেই!

তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ইব্রাহিমের গোলের মুহূর্ত। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা হেরেছে বাংলাদেশ

ঠিক এই জায়গাতেই কথা আসছে গত বছর মার্চে নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ছেড়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেওয়া এলিটা কিংসলিকে জাতীয় দলে নিতে ভালো হতো কি না। তুর্কমেনিস্তান ম্যাচের পর থেকে কিংসলির কথা আসছে বারবার।

এ নিয়ে ফুটবলারদের প্রশ্ন করা হলে তাঁরা এড়িয়ে যাচ্ছেন, কারণ, এটা তাঁদের বিষয় নয়। তবে আনিসুর এটুকু বলেছেন, ‘এলিটা শেষ ২০ মনিট বদলি হিসেবে বেশ ভালো। বসুন্ধরা কিংসের হয়ে সে শেষ দিকে নেমে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ গোল করেছে। কিংস পিছিয়ে থাকলে ওকে নামিয়ে দেয় মাঠে শেষ দিকে। বদলি হিসেবে আমি বলব ও কার্যকর।’

বাংলাদেশের ফুটবলারদের গোল করার সামর্থ্যের অভাবই কিংসলির প্রসঙ্গে উঠে আসছে। তবে তুর্কমেনিস্তারের বিপক্ষে বাংলাদেশের একমাত্র গোলটা করা মোহাম্মদ ইব্রাহিম এ বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ। শুধু বলছেন, ‘ওটা কোচের ব্যাপার। আমি কোনো মন্তব্য করব না।’

আগের দিন ইব্রাহিম ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামে বলেছিলেন, গোল করে তিনি খুশি। কিন্তু দল জিতলে তাঁর বেশি ভালো লাগত। অথবা ড্র করলেও। কিন্তু হেরে যাওয়ায় এই গোল তাঁকে কোনো আনন্দ দিচ্ছে না।

আজ টিম হোটেলে সুইমিং শেষে সেই ইব্রাহিম বললেন, ‘আমার কাছে এই গোলের কোনো মূল্যই নেই। যেহেতু আমরা কোনো পয়েন্ট পাইনি। তাই গোলটা কোনো কাজে আসেনি আমাদের।’

তবে পরবর্তী ম্যাচের জন্য গোলটা অনুপ্রেরণা কি না, সেই প্রশ্নে তাঁর উত্তর, ‘অনুপ্রেরণা হতে পারে। তবে ম্যাচের ফল তো আর বদলাবে না। যেটা হয়ে গেছে, সেটা হয়ে গেছে। আসলে গোল কে করছে, সেটা বিষয় নয়। বিষয় হলো, দল পয়েন্ট পেল কি না। পয়েন্ট পেলে খুশি হতাম।’

বাংলাদেশ ম্যাচে ভালো করতে করতে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত পারছে না। তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে এই ম্যাচটা বের করে আনতে পারলে ফুটবলের জন্য ইতিবাচক হতো কি না প্রশ্নে ইব্রাহিমের কথা, ‘অবশ্যই হতো। আমার একটা সময় মনে হয়েছিল ম্যাচটা জিতব। কিন্তু হলো না। আসলে আমাদের ব্যাড লাক।’

ইব্রাহিম তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে গোল করলেও দল না জেতায় সেটি নিয়ে ভাবছেনই না

জেমি ডের পর হাভিয়ের কাবরেরা। জাতীয় দলে কী পরিবর্তন এসেছে? ইব্রাহিম বলছেন, দুই কোচকে প্রায় একই রকম লাগে তাঁর। দুজনই ‘লো ব্লক’ থেকে শুরু করেন। এই কৌশলটা খুব বেশি বদল করা যাবে না। কারণ, বেশি বদল করলে কালকের ম্যাচের ফল অন্য রকম (বেশি গোল খাওয়া) হতে পারত।’

জাতীয় দলের হয়ে ইব্রাহিমের এটি তৃতীয় গোল। আর গোল করার পর দেশ থেকে অনেক শুভেচ্ছা বার্তা পেয়েছেন। ‘বাবা–মা বলেছেন গোল করেছ ভালো। কিন্তু দল জিততে পারল না। আসলে দলের জয়টা তাঁদের কাছেও বড়।’ বলছিলেন কয়েক বছর আবাহনী–মোহামেডান ম্যাচে আবাহনীর বিপক্ষে গোল করে আলোচনায় আসা কক্সবাজারের এই তরুণ উইঙ্গার। ইব্রাহিম গোল করে আলোচনায়। অন্যদিকে উইঙ্গার রাকিব হোসেন গোল না করেও আলোচনায়। স্ট্রাইকার সাজ্জাদের পাশাপাশি গোল করার সুযোগ পেয়েছিলেন রাকিবও।

কিন্তু গোল করতে পারেননি। সেই আফসোস তাঁকে পোড়াচ্ছে জানিয়ে এই উইঙ্গার আজ টিম হোটলে স্বদেশি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা শতভাগ চেষ্টা করেছি জেতার জন্য। কিছু ভুলের জন্য হয়তো সেটা হয়নি। তাই সবার মন খারাপ, আক্ষেপও হচ্ছে সবার। আমাদের দিক থেকে শতভাগ চেষ্টা করেছি। এটাই ভালোই দিক।’ এরপর তাঁর সংযোজন, ‘সুযোগ কাজে লাগাতে পারছি না আমরা। ফরোয়ার্ডরা চেষ্টা করছে। হয়তো কাল হয়নি, আগামী ম্যাচে হবে।’

এলিটা কিংসলি থাকলে কি ভালো হতে পারত? ‘সে থাকলে গোল পেতে পারত আবার না–ও পেতে পারত। সুতরাং নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।’ বলছিলেন রাকিব।

সামনে মালয়েশিয়া ম্যাচ। ৬০–৬৫ হাজার দর্শকের কোলাহলের মধ্যে মালয়েশিয়ার মাঠে খেলা তীব্র চাপই। পারবেন এই চাপ সামলাতে? রাকিব বলছেন, ‘মালয়েশিয়া অনেক শক্তিশালী। তাদের সমর্থন করতে অনেক দর্শক আসে মাঠে। তবে আশা করি স্থানীয় দর্শক সমস্যা হবে না আমাদের জন্য। দর্শকের মধ্যে খেলতে আরও ভালো লাগে।’

বাংলাদেশ দলে একজন সুনীল ছেত্রীকে দরকার

বাংলাদেশ দলের গোলকিপার কোচ বিপ্লব ভট্টাচার্যও মনে করেন মালয়েশিয়ার সঙ্গে তাদেরই মাঠে খেলা কঠিন হবে। তবে তাঁরও বিশ্বাস বাংলাদেশ ভালা করবে। শনিবার তুর্কমেনিস্তান ম্যাচের পর সারা রাত নাকি ঘুমাতে পারেননি।

বারবারই তাঁর মনে হচ্ছিল এই বুঝি জিতে গেছে বাংলাদেশ। বলতে বলতে বিপ্লব আজ টিম হোটেলে দাঁড়িয়ে যোগ করেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, দেশের মানুষ একটা ফল চাইছিল। তাই ভাবতেই পারছি না আমরা হেরে গেছি। তবে এটাও ঠিক, দেশের মানুষকে আমরা আশা দিতে পেরেছি। ছেলেরা দেখাতে পেরেছে আমরাও ভালো ফুটবল খেলতে পারি। আমাদের সেই সামর্থ্য আছে।’

এমন লড়াকু ফুটবলে খেলতে পারলে সামনে বাংলাদেশ আরও ভালো করবে বিশ্বাস বিপ্লবের। বলছেন, ‘ইন্দোনেশিয়া, বাহরাইনের পর আমরা তুর্কমেনিস্তান ম্যাচে বেশি ভালো খেলেছি। এখন সময় এসেছে দেশের মানুষকে কিছু উপহার দেওয়া। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। এখন ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে আমাদের।’

বিপ্লবের শেষ কথাটাই সব কথার আসল কথা। ধারাবাহিকতা না থাকলে কোনো দলই বেশি দূর এগোতে পারে না। বাংলাদেশের সামনে তাই ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার চ্যালেঞ্জ।