হার্নান বার্কোস কী খেলাটাই না দেখালেন। লিওনেল মেসির সতীর্থ হয়ে খেলেছেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে হাইপ্রোফাইল বিদেশি ফুটবলার হিসেবে পরিচিত হতে জীবনবৃত্তান্তে এতটুকু তথ্যই যথেষ্ট। এএফসি কাপে বসুন্ধরা কিংসের হয়ে খেলতে নেমে অবশ্য ওই পরিচয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি তিনি। মালদ্বীপের টিসি এফসির বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ চার গোল করে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের জাতটা। সঙ্গে ছিলেন কোস্টারিকার হয়ে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলা দানিয়েল কলিনদ্রেস। দুজনের রসায়নের জাদু কাল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এনে দিয়েছিল স্বপ্নিল এক আবেশ। তবে একটা আফসোস থেকেই গেছে। এমন দুজন বিদেশি ফুটবলারের ক্রীড়াশৈলির ঝলক উপভোগ করতে খুব বেশি দর্শক কাল উপস্থিত ছিলেন না বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। তবে অনেকেই আশা দেখছেন, এমন ফুটবলারের কল্যাণে এখন যদি দেশের ঘরোয়া ফুটবল কাটাতে পারে দর্শক-খরা। অতীতে মোহামেডান-আবাহনীর মতো ক্লাবে অনেক বিদেশি ফুটবলারই খেলে গেছেন, যাদের নামের আকর্ষণ অন্য রকম চেহারা দিয়েছিল ঘরোয়া ফুটবলারকে। বার্কোস-কলিনদ্রেসের ফুটবল দেখে অনেকেই হয়তো ফিরে গেছেন অতীতের দিনগুলোতে। বাংলাদেশের ফুটবলে খেলে যাওয়া কয়েকজন দুর্দান্ত বিদেশি ফুটবলারের কথা মনে করে একটু স্মৃতিমেদুর তো হওয়াই যায়...
সামির শাকির
১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইরাকের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। ইরাকের সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকা হিসেবেই ধরা হয় সামির শাকিরকে। ডিফেন্ডার সামির ১৯৮৭ লিগে খেলতে আসেন আবাহনীতে। এর আগে সে বছরই ইরাকের শীর্ষ ক্লাব আল-রশিদের হয়ে ঢাকায় এসেছিলেন এশিয়ান ক্লাব কাপ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে। সাতাশির লিগে সামির শাকিরের মতো ফুটবলারের অন্তর্ভুক্তিতে নিজেদের ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল আবাহনী। কিন্তু দুর্ভাগ্য, শিরোপা জেতা হয়নি। সামির শাকিরের সঙ্গে এরপরেও বাংলাদেশের সম্পর্ক থেকে গিয়েছিল। ফুটবল ছেড়ে তিনি আবাহনী-মোহামেডান দুই প্রধানেরই কোচ হয়ে এসেছিলেন। সামির শাকির বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রইবেন জাতীয় ফুটবল দলের কোচ হিসেবে। ১৯৯৯ সালে তাঁর অধীনেই প্রথমবারের মতো সাফ গেমস ফুটবলে সোনার পদক জেতে বাংলাদেশ।
নাসের হেজাজি
সত্তর ও আশির দশকে এশিয়ার সর্বকালের সেরা গোলরক্ষকই বলা হলো তাঁকে। ইরানি এই ফুটবল তারকা ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে খেলেছিলেন তাঁর দেশের হয়ে। ১৯৮৭ মৌসুমে তিনি মোহামেডানের কোচ কাম খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে আসেন। যদিও তিনি খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি। লিগের শেষ ম্যাচে আবাহনীর বিপক্ষে তাঁর মাঠে নামা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে ওই প্রজন্মের মোহামেডান সমর্থকদের মনে। হেজাজি ১৯৯২ পর্যন্ত মোহামেডানের কোচ ছিলেন। তিনি ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। যদিও সেবার রুপার পদক নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ২০১১ সালে তিনি ফুসফুসের ক্যানসারে মারা যান। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি ইরানে ফুটবল কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ভিজেন তাহিরি
১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে মোহামেডানের হয়ে খেলেছিলেন ভিজেন তাহিরি। দুর্দান্ত এই স্ট্রাইকার বাংলাদেশের ফুটবল চিরস্মরণীয় হয়ে রইবেন নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে তিনি ২৪ গোল করেছিলেন। দেশের ফুটবলে ১৯৮২ সালে ২৭ গোল করে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড করেছিলেন সালাম মুর্শেদী। সেটি আজ ৩৮ বছর পরেও রেকর্ড। তাহিরিই শেষবার সালামের খুব কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন। সালাউদ্দিনের ২৪ গোলের রেকর্ড ভেঙেছিলেন সালাম। ইরানি তাহিরি ব্রাকেটবন্দী হয়েছিলেন সালাউদ্দিনের সঙ্গে।
আজামত আবদু রহিমভ
১৯৯২ সালে মোহামেডান উড়িয়ে এনেছিল উজবেক এই ফুটবলারকে। দুরন্ত এই গোলস্কোরার মোহামেডানের হয়ে সেবার লিগের মাঝপথে এসে করেছিলেন ১৭ গোল। ১৯৯৪ সালে হিরোশিমা এশিয়ান গেমসে উজবেকিস্তান ফুটবলে সোনার পদক জেতে। রহিমত ছিলেন সে দলের প্রাণভোমরা।
সের্গেই ঝুকভ
সের্গেই নিকোলায়েভিচ ঝুকভকে অনেকেই বলেন বাংলাদেশে খেলে যাওয়া সবচেয়ে কুশলী ফুটবলার। রাশিয়ান এ ফুটবলারকে ১৯৯২ মৌসুমে এনেছিল আবাহনী। রুবেন কাজান, টর্পেডো মস্কো, লোকোমোটিভ মস্কোর মতো ক্লাবে খেলা ঝুকভের ফুটবল প্রাণভরে উপভোগ করেছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। আবাহনীর লিগ জয়ে সেবার অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল ঝুকভের।
রেজা নালজেগার
পুরো নাম গোলাম রেজা নালজেগার। ইরানের অত্যন্ত কুশলী মিডফিল্ডার। আবাহনীর সমর্থকেরা যদি সের্গেই ঝুকভকে সেরা বিদেশি বলেন, তাহলে মোহামেডানের সমর্থকেরা বলবেন রেজা নালজেগারের নাম। ১৯৮৭ আর ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে নালজেগার ছিলেন মোহামেডানের সেরা তারকা। এ দুই মৌসুমে মোহামেডানের লিগ বিজয়ে তাঁর ছিল দুর্দান্ত অবদান। ইরানে খেলেছেন বিখ্যাত ইশতেগলাল ক্লাবে। ইরান জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৮টি ম্যাচ।
এমেকা ইজিউগো
নাইজেরিয়ান এমেকাকে কোনো দিন ভুলতে পারবেন না মোহামেডানের সমর্থকেরা। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮-৮৯ লিগে মোহামেডানকে শিরোপা জেতাতে দারুণ ভূমিকা ছিল এমেকার। তিনি বাংলাদেশের ফুটবলে খেলতে আসার আগে খেলেছেন ভারতের ইস্টবেঙ্গল ও কলকাতা মোহামেডানের হয়েও। বাংলাদেশে খেলেই তিনি চলে যান ইউরোপে। খেলেছেন নাইজেরিয়া যুব দলে। ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে তিনি নাইজেরীয় স্কোয়াডে ছিলেন। খেলেছেন বুলগেরিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচে। এমেকা পরবর্তীতে মোহামেডানের কোচ হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ এমেকার অন্য রকম একটা ইমেজই আছে বাংলাদেশের ফুটবলে আর সেটি চিরস্মরণীয়ই। কিছুটা বিতর্কিত চরিত্রের কারণেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি।