‘হোয়ার ইজ ইওর নাম্বার টেন?’ প্রশ্নটা ভুটান-বাংলাদেশ ম্যাচের একাদশে বাংলাদেশের ১০ নম্বর জার্সিধারীকে (জাফর ইকবাল) না দেখে মাঝবিরতিতে ভুটান জাতীয় দলের এক ফুটবলারের। তাঁর ধারণা, জাফর মাঠে না নামলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে জিততে না পারুক অন্তত আর হারছে না!
৫৩ মিনিট পর্যন্ত গোলশূন্য ড্র। বিশ্বাসটি তখন বাংলাদেশ থেকে থিম্পুতে যাওয়া সংবাদমাধ্যমকর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। ৫৪ মিনিটে জাফর মাঠে প্রবেশ করার সঙ্গে গ্যালারিতে একটা বার্তা যেন পৌঁছে গেল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কিন্তু জাফরকে ‘ডাবল টিউনিং কমপ্যাক্ট’ ডিফেন্ডিংয়ে রাখল ভুটানিজরা। ঠিক মেসিকে নিয়ে প্রতিপক্ষদের যেমন বিশেষ কৌশল থাকে। আসলে জাফর তো প্রতিপক্ষদের চোখে ‘চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামের মেসিই’। মেসি যেভাবে প্রতিপক্ষের সব কৌশল ফুঁড়ে গোল করে দলকে জেতান, জাফরও করলেন তা-ই। ৮১ মিনিটে ডান প্রান্তে অ্যাটাকিং থার্ডের শুরু থেকে বল নিয়ে দ্রুতগতিতে ভুটানের দুই ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে বক্সে ঢুকে দূরের পোস্টে প্লেসিংয়ে গোল। মেসি ভেতরের দিকে ঢুকে দূরের পোস্টে বাঁ পায়ে প্লেসিং করেন আর জাফর করেছেন ডান পায়ে।
তবে ‘চাংলিমিথাংয়ের মেসি’ আর লিওনেল মেসির মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই। তিন মিনিট পরে বাঁ প্রান্তে ভুটানিজ রাইটব্যাককে স্টেপ ওভারে ঘোল খাইয়ে কাছের পোস্টে নিখুঁত প্লেসিংয়ে করেছেন ২-০। তিন মনিটের ব্যবধানে জোড়া গোল করে দলকে জিতিয়ে অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ ফুটবলের শিরোপা জয়ের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে রেখেছিলেন জাফরই। শেষ পর্যন্ত শিরোপা না জিততে পারলেও চার ম্যাচে পাঁচ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন জাফর ইকবাল।
প্রায় দুই সপ্তাহ থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়াম মাত করে রেখেছিলেন জাফর। টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে পিছিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেদিন দ্বিতীয়ার্ধে জোড়া গোল করে এবং সতীর্থকে দিয়ে একটি করিয়ে ৪-৩ গোলের অবিশ্বাস্য জয়ে রাখেন বড় অবদান। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় এই জয়ে লেফট উইঙ্গার জাফরের নাম লেখা থাকবে উজ্জ্বল অক্ষরে।
দ্বিতীয় ম্যাচেও মালদ্বীপের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ের ম্যাচে দুর্দান্ত এক গোল করেছিলেন জাফর। ডান প্রান্তে বক্সের বাইরে থেকে জাফরের নেওয়া বাঁ পায়ের আচমকা জোরালো শটে বোকা বনে যায় মালদ্বীপ-গোলকিপার। তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে নেপাল শুধু জাফরকে আটকানোর কৌশল নিয়েই মাঠে নেমছিল। জাফরের পায়ে বল গেলেই একজন মার্কারের সঙ্গে দুজন কভারিং থেকেছে নেপালিরা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে বিশ্বনাথ ঘোষ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ায়, দ্বিতীয়ার্ধের পুরোটা সময় ১০ খেলোয়াড় নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। এই বড় চাপটা আর সেদিন জয় করতে পারেননি বান্দরবান থেকে উঠে আসা অনূর্ধ্ব-১৮ সাফের পোস্টার বয় জাফর ইকবাল।
ছোটবেলায় সাঙ্গু নদীর পাড়ে তিন নম্বর বল দিয়ে শুরু হয়েছিল জাফরের ফুটবল-জীবন। নদীর পানির মতো বহুদূর বয়ে চলার পথ কোথাও কোথাও বাঁক বদল হয়ে তিনি এখন মূল জাতীয় দলের খেলোয়াড়। অথচ বাবা আলি হোসেন ও মা দেলোয়ারা বেগম চাইতেন, তাঁদের একমাত্র ছেলেটা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হোন, অন্তত ফুটবলার যেন না হন।
২০১৫ সালে তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় দিলকুশা ক্লাবের জার্সি গায়ে তোলেন জাফর। তাঁর এক হ্যাটট্রিক ও নয় গোলের কল্যাণে দিলকুশা চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। নজর পড়ে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব আরামবাগের। একই বছর ২৫ হাজার টাকায় আরামবাগ ক্লাবে গিয়ে ওঠেন জাফর। বাচ্চা ছেলেটি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ঘাস চেনার আগেই পাঁচ গোল। বাংলাদেশের একজন উইঙ্গারের জন্য সেটা ঢের বেশি! ২০১৫-১৬ মৌসুমে ফেডারেশন কাপে আরামবাগের রানার্সআপ হওয়ার পেছনে জাফরের বড় অবদান। এশিয়ান কাপের প্রাক্ বাছাইপর্বের জন্য বেলজিয়াম কোচ টম সেইন্ট ফিটের দলে ডাক পড়ে জাফরের। একই বছর তৃতীয় বিভাগ, প্রিমিয়ার ক্লাব ও জাতীয় দল। একজন ফুটবলারের জন্য আর কী চাই!
বছর ঘুরতেই ৫ ও ২৫ হাজার দামের জাফর ২০১৬-১৭ মৌসুমে চট্টগ্রাম আবাহনীতে পাড়ি জমিয়েছেন ১৫ লাখ টাকায়। এখন একমাত্র ছেলেকেই নিয়ে মা-বাবার গর্ব। অথচ পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছেলেকে খেলার মাঠেই পড়ে থাকা দেখে আলি হোসেন কিনে এনেছিলেন বড় এক শিকল। বিকেলে যেন মাঠে যেতে না পারেন, তাই দুপুরে সোফার সঙ্গে বেঁধে রাখা হতো জাফরকে। কিন্তু বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠিকই শিকল খুলে বের হয়ে মাঠে চলে যেতেন জাফর। কে জানে, হয়তো ডিফেন্ডারদের করা মার্কিং ভেদ করে গোল করার রাস্তাটা শিখেছিলেন ওই শিকল খোলা থেকেই!