সেই আশির দশক থেকে শুরু। জীবিকার টানে বাংলাদেশে ফুটবল খেলতে নাইজেরিয়া থেকে ছুটে এসেছেন চিমা ওকোরি, এমেকা ইউজিগো। একে একে লাডি বাবালোলা, বোডি বাবালোলা...কত কত নাম। বছর চারেক আগে, ২০১১ সালে ওঁদের দেখানো পথে এলেন আরেক নাইজেরিয়ান এলিটা কিংসলে। ঠিকানা আরামবাগ। পেশাদার ফুটবলারের কঠিন মনের ছোট্ট একটি কোণে জায়গা পেয়ে গেল সবুজ বাংলাদেশ। পরের মৌসুমেই এলিটা তাই নিয়ে এলেন ভাই বেঞ্জামিনকে।
২০১৩-১৪ মৌসুমে দুই ভাই একসঙ্গে খেললেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে। ঢাকা মোহামেডানের হয়ে গত লিগে খেলেই বেঞ্জামিন ফিরে গেছেন নাইজেরিয়ায়। কিন্তু রয়ে গেছেন এলিটা। টানটা কিসের? জীবিকার উৎস অবশ্যই প্রধানতম কারণ। তবে সেটিই একমাত্র কারণ নয়। বাংলাদেশেই যে খুঁজে পেয়েছেন ভালোবাসা। এক বছরের মধ্যেই তাঁর মন কেড়ে নিয়েছেন ঢাকার এক তরুণী—লিজা বেগম। ভালোবাসার নীড় বেঁধেছেন দুজনে। সাফিরা এলিটা নামে এক ‘রাজকন্যা’ও এসেছে দুজনের ঘর আলো করে। এলিটা কিংসলের অর্ধেক সত্তাজুড়েই এখন বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম আবাহনীর হয়ে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট জয়ের পর পরশু যে নিজেকে লাল-সবুজ পতাকায় মুড়ে উদ্যাপন করলেন, তা ওই বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই। কাল সকালে নিজেই যেমন বললেন, ‘বাংলাদেশে বিয়ে করেছি, নিজেকে তো মন থেকে এ দেশেরই একজন ভাবি। তবে হ্যাঁ, এটা বলতে পারেন, আমি এখন অর্ধেক নাইজেরিয়ান, অর্ধেক বাংলাদেশি।’ বলেই হা হা করে হাসি দিলেন।
সেমিফাইনালে দুই গোল করে বলতে গেলে একাই ফাইনালে তুলেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীকে। ফাইনালেও নায়ক কিংসলে, দুই গোল করালেন, অবদান রাখলেন কলকাতার ইস্টবেঙ্গলকে বিধ্বস্ত করা তৃতীয় গোলটিতেও। তাঁর জয়োৎসবের আনন্দটা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল গ্যালারিতে স্ত্রী-কন্যার উপস্থিতি। ফাইনালেও সবটুকু আলো কেড়ে নিতে কাড়বেন, এই বিশ্বাসটা মনের মধ্যে ছিল বলেই হয়তো হৃদয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি দুজনকে নিয়ে এসেছিলেন সেমিফাইনাল জয়ের পরই। আর কী আশ্চর্য, ফাইনালের সেরা, টুর্নামেন্টের সেরা, পাঁচ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা—সবগুলো পুরস্কার জিতে নিলেন চট্টগ্রাম আবাহনীর এই নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তাই বারবারই মঞ্চে উঠতে হলো। টুর্নামেন্টটাই যেন শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল এলিটা কিংসলের প্রদর্শনী। স্ত্রী-সন্তানদের সামনে জীবনের এক স্মরণীয় এক মুহূর্ত রচিত হলো। কিংসলে যেটিকে বলছেন, তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন।
মাস কয়েক আগে এ দেশে খেলা তিনজন আফ্রিকান ফুটবলারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল বাংলাদেশ। কিছু বিতর্ক আর সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত সেটি অবশ্য হয়নি। বাংলাদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে শেখ কামাল টুর্নামেন্টে কিংসলে যেমন খেললেন, তাতে নতুন করে এখন অনেকের মনে নাগরিকত্বের প্রশ্নটি জাগতেই পারে। এলিটা কিংসলেকে নাগরিকত্ব দেওয়া যায় না? কিংসলে নিজেই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চান, ‘আর কিছুদিন পর বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করব।’
নাগরিকত্ব যদি পান, এ দেশের জাতীয় দলে একদিন খেলতেও পারেন কিংসলে। চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক যেমনটা বলেছেন, তাতে খেলাটির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ কিংসলে। অন্য নাইজেরিয়ানদের মতো শারীরিক শক্তিটা কাজে লাগান, বাঁ পায়ে প্রচণ্ড শক্তি। আর যেটি বড় মুখ করে বলার কথা, বাংলাদেশের স্ট্রাইকারদের মতো গোলের সুযোগ নষ্ট করেন না। সে যা-ই হোক, নাগরিকত্বের ব্যাপারটি আসবে পরে। আপাতত এলিটা কিংসলে বাংলাদেশের ফুটবলে এক আলোচিত নাম। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপে নিজেকে চিনিয়েছেন নতুন আলোয়। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আপাতত তাঁর কোনো ক্লাব নেই। মুক্ত খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীতে। আগামী লিগে ক্লাব পেতে তাঁকে মনে হয় আর ভাবতে হবে না। আর ওই লিগে নিশ্চয়ই আলো ছড়াবেন এই নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার।
ওহ্, একটু ভুল বলা হলো।
অর্ধেক নাইজেরিয়ান আর অর্ধেক বাংলাদেশি স্ট্রাইকার!