তাসখন্দের পাখতাকর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের গোলরক্ষক পাপ্পু হোসেনকে দেখে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। একের পর এক বল জালে জড়িয়ে দিচ্ছেন উজবেকিস্তানের ফুটবলাররা আর পোস্ট থেকে বল কুড়িয়ে আনছেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত স্বাগতিক উজবেকিস্তানের কাছে ৬ গোল খেয়েছে বাংলাদেশ। গোল করা তো দূরের কথা, একবারও প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকের পরীক্ষা নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ বাছাইপর্বের ‘ডি’ গ্রুপে স্বাগতিক উজবেকিস্তানের সঙ্গে একই গ্রুপে আছে বাংলাদেশ, সৌদি আরব ও কুয়েত। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় এশিয়ান কাপেরও স্বাগতিক হওয়ায় সরাসরি খেলবে উজবেকিস্তান। তাই বাছাইপর্বে উজবেকিস্তানের সঙ্গে সব দলের ম্যাচগুলোকেই ধরা হচ্ছে প্রীতি ম্যাচ হিসেবে। সে অনুযায়ী আজকের ম্যাচে জিতলেও পয়েন্ট পাবে না উজবেকরা
জাতীয় দলের র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের থেকে ১০৩ ধাপ এগিয়ে আছে উজবেকিস্তান (৮৪)। সর্বশেষ এশিয়ান কাপে চতুর্থ হয়েছিল মধ্য এশিয়ার দেশটি। ম্যাচটা জাতীয় দলের নয়, অনূর্ধ্ব-২৩ দলের, তবু এত সব মিলিয়ে এত এগিয়ে থাকা উজবেকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ হারবে, এটি অনুমিতই ছিল। কত গোলে হারবে, সেটিই ছিল দেখার বিষয়।
প্রথম ২৬ মিনিটের মধ্যেই ৪ গোল করে উজবেকিস্তান বুঝিয়ে দেয় কেন এশিয়ার ভবিষ্যৎ বলা হচ্ছে তাদের। এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে আগে ইউক্রেন ও কাজাখস্তানের সঙ্গে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছে উজবেকিস্তান। ইউক্রেনের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্রয়ের পর কাজাখস্তানকে হারিয়েছে ২-০ গোলে।
বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচে এশিয়ান অনূর্ধ্ব-২৩ টুর্নামেন্টে বর্তমান রানার্সআপ সৌদি আরবের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্রয় করেছে উজবেকরা। আজ বাংলাদেশকে রীতিমতো গোলবন্যায় ভাসিয়েছে।
ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ কোচ মারুফুল হক বলেন, ‘দুই দলের খেলোয়াড়দের বল পায়ে রাখার দক্ষতা ও কৌশলগত পার্থক্যের মানই ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে দুই গোল হজম করায় খেলোয়াড়েরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া আরও একটা কারণ ঠান্ডা আবহাওয়া। বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা সাধারণত গরম আবহাওয়ায় খেলতে অভ্যস্ত। এখানে তীব্র ঠান্ডার মধ্যে আমাদের খেলোয়াড়েরা মানিয়ে নিতে পারছে না (তাসখন্দে এখন তাপমাত্রা ১৪–১৫ ডিগ্রি)।’
আবহাওয়া হয়তো একটা কারণ। তবে বড় কারণ অবশ্যই প্রস্তুতি ম্যাচ আয়োজনে বাফুফের চরম ব্যর্থতা। এই বাছাইপর্বের আগে বাংলাদেশ দলকে ন্যূনতম একটি প্রস্তুতি ম্যাচের ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি দেশীয় ফুটবলে সর্বোচ্চ সংস্থাটি। ফলও পাওয়া গেল হাতেনাতে। প্রথম ম্যাচে কুয়েতের বিপক্ষে ১-০ গোলে হারলেও আজ ভেঙে পড়ে বাংলাদেশের সব প্রতিরোধ।
৬-০ গোলের হারা ম্যাচের কোনো কাঁটাছেঁড়া বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। উজবেকিস্তানের খেলোয়াড়দের পায়েই ছিল বল। আক্রমণভাগে তাদের জায়গা অদল-বদল করে খেলা, ডামি করে বক্সে ঢুকে পড়া, মিডল করিডরে খেলোয়াড়সংখ্যা বাড়িয়ে আচমকা উইং দিয়ে ঝড়ের গতিতে আক্রমণে ওঠা...ঘরের মাঠে গোছানো ও আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে বড় জয় তুলে নিয়েছে উজবেকরা।
মাঝেমধ্যে বল দেখা গেছে ফয়সাল আহমেদ, মাহবুবুর রহমানদের পায়ে। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলেও নিচ থেকে খেলাটা তৈরির পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু শারীরিকভাবে এগিয়ে থাকা উজবেকিস্তানের খেলোয়াড়দের ‘হাই প্রেসিংয়ে’ বল পায়ে রাখার সামর্থ্য দেখাতে পারেননি লাল–সবুজের ডিফেন্ডাররা। একমাত্র উইঙ্গার ফয়সাল হোসেনই দু–একবার বল নিয়ন্ত্রণে রাখার সাহস দেখাতে পেরেছেন।
যেকোনো পর্যায়ে আজ বাংলাদেশের জার্সিতে প্রথম খেলেছেন ইংল্যান্ডপ্রবাসী ইউসুফ জুলকারনাইন। রাইট উইঙ্গার হিসেবে তাঁকে প্রথম ম্যাচ দেখে মনে হয়েছে, এই পর্যায়ে খেলার জন্য এখনো তৈরি হতে পারেননি। প্রথমার্ধ শেষে তাঁকে মাঠ থেকে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন কোচ মারুফুল হক।
১২ মিনিটে বাংলাদেশের প্রথম গোল খাওয়ার পেছনে ইউসুফের দায় কম নয়। তাঁর ভুল পাস উজবেকিস্তান অধিনায়ক খোসিমোভ উলুজবেকের পায়ে পড়লে একেক প্রচেষ্টায় গোলমুখে ঢুকে বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের শট নেন। বাংলাদেশ গোলরক্ষক হাত ছোঁয়াতে পারলেও গোল আটকানোর মতো যথেষ্ট ছিল না।
১২ থেকে ১৬ মিনিট পর্যন্ত ঝড় বয়ে যায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। ১৫ মিনিটে ২-০। কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকে লাফিয়ে উঠে হেডে গোল করে ব্যবধান বাড়ান ডিফেন্ডার বেজিমোভ এলদারবেক। ১৬ মিনিটে ব্যক্তিগত দ্বিতীয় গোলে ৩-০ করেন উজবেক অধিনায়ক উলুজবেক। বক্সের বাইরে থেকে তাঁর শট দূরের পোস্ট দিয়ে জালে জড়িয়ে যায়।
এরপর অনেক বড় ব্যবধানের হারের শঙ্কা পেয়ে বসেছিল বাংলাদেশ শিবিরকে। শেষ পর্যন্ত বাকি সময়ে আরও ৩ গোল খেয়েছে বাংলাদেশ। ২৬ মিনিটে ৪-০ করেন ডিফেন্ডার টসটেমিরোভ আসলেদদিন। বাঁ প্রান্ত থেকে আসা ক্রসে বক্সের মধ্যে থেকে হেডে গোলটি করেন তিনি।
উজবেকিস্তানের খেলোয়াড়েরা দীর্ঘদেহী। বাতাসে তাঁদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি টুটুল হোসেন, রিয়াদুল হাসান, রহমত মিয়ারা।
দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছে মারুফুলের দল। কিন্তু গোল আটকাতে পারেনি। এই সময় ইউসুফের জায়গায় রহিমউদ্দিন বদলি হিসেবে নামলে ‘টিম ডিফেন্ডিংয়ে’ শক্তি বাড়ে বাংলাদেশের। নিচে নেমে রক্ষণভাগকে সহায়তা করেন এই উইঙ্গার। কিন্তু ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে অনেক এগিয়ে থাকা উজবেক খেলোয়াড়দের বিপক্ষে লড়াই করার মতো শক্তি বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের নেই।
৬৩ মিনিটে ফ্রি–কিক থেকে ৫-০ করেন মিডফিল্ডার আবোসফেক ফাজিলোভ। বক্সের বাইরে থেকে তাঁর ডান পায়ে নেওয়া শট সরাসরি জালে জড়িয়ে যায়। ৮৭ মিনিটে ওদিলোব আলিশার পায়ে ৬-০।
দিনের অন্য ম্যাচে চমক দিয়েছে কুয়েত। সৌদি আরবকে আজ তারা ২-১ গোলে হারিয়ে দিয়েছে। দুই জয়ে ৬ পয়েন্ট নিয়ে চূড়ান্ত পর্ব নিশ্চিত করেছে কুয়েত। ২ নভেম্বর শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব।