বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁর নাম অজানা। তবে সত্তর-আশির দশকের দর্শকেরা তাঁর ফুটবলীয় দক্ষতার কথা বলেন। তারকাখ্যাতিতে কাজী সালাউদ্দিন অনেক এগিয়ে থাকলেও অনেকের চোখে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা ফুটবলার এনায়েতুর রহমান খান। দীর্ঘ ২৭ বছর পর পরশু দেশে এসে উঠেছেন ঢাকা ক্লাবে।
সেখানেই গতকাল প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক এই তারকা স্ট্রাইকার ফিরে গেলেন অতীতে। দিলেন অনেক প্রশ্নের উত্তর—
এনায়েতুর রহমান খান: কারণ নিশ্চয়ই আছে। জীবনের তাগিদে মানুষকে অনেক কিছু করতে হয়।
এনায়েত: কারণ আছে। সাবেক ফুটবলার আবদুল গাফফার বা ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতি মুশফিকুর রহমান মোহনের মতো আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলল, আপনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আপনার স্বীকৃতির (সনদ) দরকার আছে। এ জন্যই আসলে আসা।
এনায়েত: দেখুন, কোনো কিছু চেয়ে নিতে আমার ভালো লাগে না। তার পরও দেখি।
এনায়েত: অভিমানের কথা বললেন, এটার ভিত্তি কী?
এনায়েত: বিষয়টা আসলে তা নয়। আমি যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডায় থিতু হয়েছি বেশ আছে। কেন হয়েছি, তারও একটা কারণ আছে। অভিমান-টভিমান এসব কিছু নয়।
এনায়েত: আমার কাছে ফুটবলের গল্প নেই। আমি কারও সঙ্গে খেলার গল্প করি না। কার সঙ্গে করব, কেন করব? আমি বলব, আমি খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম? আপনি আমার বাসায় বেড়াতে গেলে আমি কি ফুটবলের গল্প করব? আমি আপনার বেড়ানো নিয়ে কথা বলব। আপনি যদি কিছু জানতে চান, তাহলে হয়তো কিছু বলতে পারি। এমনি নিজ থেকে বলা একটু নীচু মনের পরিচয় হয় না?
এনায়েত: আমি আসলে এ রকমই। অনেকে আমার কাছে ফুটবল নিয়ে নানা কিছু জানতে চায়। কিন্তু আমি ফুটবল নিয়ে কী বলব? ফুটবল থেকে দূরে আছি ২৭ বছর। যদি কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে দেখা হয়, তখন হয়তো দু-একটা কথা হয়। কিন্তু আমি ফুটবল খেলতাম, আমার অনেক স্মৃতি আছে—এগুলো তো বলে বেড়ানোর বিষয় নয়, তাই না?
এনায়েত: না, সেভাবে রাখতাম না। রেখে আসলে করবটা কী? আমার তো এই সময়ের ফুটবলের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এনায়েত: আমিও বলি সালাউদ্দিনই সেরা। আপনি যদি ভোট নেন, সেই তো সব ভোট পাবে।
এনায়েত: তাহলে তো হলোই। উত্তর তো পেয়ে গেছেন। আমাকে আর জিজ্ঞাসা করে লাভ কী? তার (সালাউদ্দিন) পপুলারিটি অনেক বেশি। এতে আমার কী করার আছে। আপনি বলছেন, অমুক বলছে, আমিও বলছি, সে-ই সেরা। জরিপে যদি জনপ্রিয় হয়ে থাকে, তাহলে আমি এ নিয়ে কথা বলব কেন? আপনাকেই-বা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে কী উত্তর দেবেন? আপনিই বললেন, জরিপে সে সবচেয়ে জনপ্রিয়, তাহলে আর তো সমস্যা নেই। ১০০ জনে ৫১ জন বললে সেই তো জনপ্রিয়।
এনায়েত: খারাপ লাগবে কেন? আমার ঈর্ষা হতে পারে। আর ঈর্ষা ছাড়া মানুষ উন্নতি করতে পারে না। তাহলে সে একটা গাধা। বলতে পারেন আমি সালাউদ্দিনকে ঈর্ষা করেছি। আমার কাছে এগুলোর উত্তর খুব সোজা।
এনায়েত: আমি যে মানের খেলোয়াড়, সেই মানের জনপ্রিয়তা পেয়েছি। জনপ্রিয়তা বলতে কী বোঝায়, ১০ জনে ৬ জন যাকে ভোট দেবে, সে-ই জনপ্রিয়। আমি এটা বদলাব কীভাবে? এখন আমি যদি বলি আমাকে ভোট দিল না কেন, এটা আমাকে মানায় না।
এনায়েত: অনুতপ্ত হওয়ার মতো কিছু করিনি। সব খেলোয়াড়ের মধ্যেই উত্তেজনা আসতে পারে। তবে প্রেক্ষাপটটা দেখতে হবে। সেদিন মাঠে কিছু করা দরকার ছিল। ম্যাচের প্রথম ২০ থেকে ২২ মিনিটে ১৮টা ফাউল হয়েছে। কিন্তু রেফারি দিচ্ছেন না। তাঁর সিদ্ধান্তে অনেক ভুল ছিল। তিনি বলেন, অ্যাডভানটেজ দিচ্ছেন। অ্যাডভানটেজ মানে কী? খেলোয়াড় ফাউলের শিকার হয়ে পড়ে গেছে, তবু অ্যাডভানটেজ দেবেন? এটা কি মানানসই? ফলে আমি মনে করি, আমি কোনো অন্যায় করিনি। খেলোয়াড়ি জীবনে আমাকে কেউ বড় ধরনের ফাউল করতে দেখেনি। ফুটবলারকে রক্ষা করবেন রেফারি। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্তে মারাত্মক ভুল থাকলে কী বলার আছে।
এনায়েত: (হাসি) পুরোনো জাল এমনিও ছিঁড়তে পারে। আপনি মারলেও ছিঁড়তে পারে। হয়তো জাল আগে থেকে ছেঁড়া ছিল। তবে এটা ঠিক, আমার শটে জোর ছিল।
এনায়েত: অবশ্যই মনে পড়ে। সান্টুর বিপক্ষে অনেকে গোল করেছে। আমিও করেছি। সেটা ছিল পটপরিবর্তনের প্রথম প্রেক্ষাপট।
এনায়েত: স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম ঢাকা লিগ পরিত্যক্ত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের লিগের প্রথম পর্বে ওয়ান্ডারার্সের কাছে আমরা (বিআইডিসি) ৪-০ গোলে হেরেছি। ফিরতি লেগে লিগের শিরোপা-নির্ধারণী ম্যাচ দুই দল মুখোমুখি। ওয়ান্ডারার্স ড্র করলে চ্যাম্পিয়ন। বিআইডিসি জিতলে চ্যাম্পিয়ন। আমরা ২ গোল খেয়ে গেছি। তার পরও আমার মনে হয়েছে কিছু হওয়ার আছে।
এনায়েত: ফ্রি কিকে বেকহামের গোলের কথা সারা দুনিয়ার মানুষ বলে। অমন গোল আমি ঢাকার মাঠে ১৯৭৩ সালে করেছি। গোলকিপার সান্টু ভেবেছে, বল অনেক বাইরে দিয়ে যাবে। বলটা বাঁক খাইয়ে জালে পাঠাই। পরে ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে ওই ম্যাচে দ্বিতীয় গোলও করি। ড্রিবল করে তৃতীয় গোলও করেছিলাম। কিন্তু রেফারি মুনীর হোসেন অফসাইড দিলেন। তারপর গাজী ভাইকে দিয়ে আরেকটি গোল করিয়ে আমরা জিতলাম। চ্যাম্পিয়ন হলাম।
এনায়েত: প্রস্তাব অবশ্যই পেয়েছি। তবে সেটাকে একটা পর্যায়ে নেওয়ার মতো অবস্থায় আসেনি। ফলে, আবাহনীতে খেলা হয়নি আমার।
এনায়েত: এটা গর্বের ব্যাপার। তবে আমার জায়গায় অন্য কেউ করতে পারত। গোলটা করেছিলাম ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা টুর্নামেন্টে থাইল্যান্ডের সঙ্গে। বাংলাদেশের ২-২ গোলে ড্রয়ে প্রথম গোলটি আমার (দ্বিতীয় গোলটি কাজী সালাউদ্দিনের)।
এনায়েত: সত্যি বলতে, ফুটবলের জন্য কিছু করার যোগ্যতা আমার আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। আমার যদি যোগ্যতা থাকে বা কেউ মনে করে যোগ্যতা আছে, তাহলে ভিন্ন কথা। আমি মনে করলে তো হবে না।
এনায়েত: সেটা কেমন?
এনায়েত: কোচিং করানোর বয়স আমার নেই। এখনকার ক্লাবের যে সিস্টেম, তাতে আমাকে কেউ ডাকেনি। তবে ভবিষ্যতের কথা কেউ বলতে পারে না।
এনায়েত: মানুষের অন্তরে তখন ফুটবল বিরাট অংশজুড়ে ছিল।
এনায়েত: এমনিতে দেখা হয় না। তবে দু-চারটা হয়তো দেখেছি।
এনায়েত: ভক্তদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। তাদের ভালোবাসার প্রতিদান কখনো শোধ করার মতো নয়।