বরফে ঢাকা রানওয়ে, বুনো লিভারপুল এবং শেষ গর্জন

মিউনিখ বিমানবন্দরে বিস্ফোরিত বিমান। ছবিঃ সংগৃহীত
মিউনিখ বিমানবন্দরে বিস্ফোরিত বিমান। ছবিঃ সংগৃহীত

কোবে ব্রায়ান্টের মৃত্যুশোক এখনো পুরোনো হয়নি। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে, তবু শাপেকোয়েনস দলটার জন্য এখনো হয়তো কাঁদেন অনেক ফুটবলপ্রেমী। খেলা যুগে যুগে আনন্দ যেমন দিয়েছে, কষ্টও যে কম দেয়নি! কখনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন প্রিয় খেলোয়াড়, প্রিয় দল, কখনো ভক্তরা প্রাণ দিয়েছেন খেলার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে। কেউ বেঁচে ফিরেছেন অবিশ্বাস্যভাবে, কারও কারও মৃত্যু রয়ে গেছে চিরদিনের রহস্য হয়ে। খেলার জগতে ঘটে যাওয়া এমন স্মরণীয় কিছু ট্র্যাজেডি নিয়েই এবারের আয়োজন। ধারাবাহিকের আজ দ্বিতীয় পর্ব—

দুঃস্বপ্নের মিউনিখ

স্যার ম্যাট বাসবির নিজের হাতে গড়া ছিল দলটা। একেবারে যুবদল থেকে বেছে বেছে নেওয়া ফুটবলারদের দিয়ে সাজানো। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকেরাও তাই ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন ‘বাসবি বেবস’। ছয় বছরের মধ্যে দলটাকে নিয়ে তিনবার ইংলিশ লিগ জেতেন বাসবি, তিনবার চ্যারিটি শিল্ড। স্বপ্নের সেই দলটা ভেঙে গিয়েছিল দুঃস্বপ্নের মতো এক ট্র্যাজেডিতে।

রেড স্টার বেলগ্রেডের বিপক্ষে ইউরোপিয়ান কাপের একটা ম্যাচ খেলে দেশে ফিরছিলেন তাঁরা। দিনটা ১৯৫৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। ব্রিটিশ ইউরোপিয়ান এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ৬০৯-এর যাত্রাপথ ছিল তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেড থেকে সরাসরি ম্যানচেস্টার পর্যন্ত। কিন্তু জ্বালানি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ায় বাধ্য হয়ে মিউনিখে বিরতি নিতে হয় পাইলটকে। নামলেন, তেল নেওয়া হলো। কিন্তু পুরো বরফে ঢাকা রানওয়েতে আর কিছুতেই টেক অফ করতে পারছিলেন না তিনি। বিমানে তখন ম্যানচেস্টারের পুরো দল, ক্লাব কর্মকর্তা, ইংল্যান্ডের নামীদামি পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিকসহ ৪৪ জন যাত্রী। দ্বিতীয়বার চেষ্টার পরও যখন পাইলট ক্যাপ্টেন জেমস থাইন টেক অফ করতে পারলেন না, তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ফ্লাইট বাতিল করে বিকল্প কিছুর জন্য অপেক্ষা করার। যাত্রীদের বলা হলো নেমে যেতে। কিন্তু বাইরে তখন প্রচণ্ড তুষার। তাই নামলেন না কেউ। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন ফুটবলার পাইলটের কাছে অনুরোধ করলেন আরও একবার টেক অফের চেষ্টা করতে। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্তটা নিলেন ক্যাপ্টেন জেমস থাইন।

বিমান দুর্ঘটনায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যাদের হারিয়েছিল। ছবিঃ সংগৃহীত

তৃতীয়বার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গেই বিমান বিস্ফোরিত হলো। আটজন ফুটবলারসহ ২০ জনের মৃত্যু হলো সঙ্গে সঙ্গে। টমি টেইলর, মাত্র তিন মৌসুম খেলার পর আজও যাঁকে ম্যান ইউনাইটেডের ইতিহাসের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন ভাবা হয় (১৬৬ ম্যাচে ১১২ গোল) বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগে ধূমপান করার জন্য জায়গা বদল করে গিয়েছিলেন পেছনের দিকে। মৃত্যু লেখা আছে জানলে হয়তো যেতেন না। তাঁর জায়গায় যিনি এসে বসেছিলেন, বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি!

বেঁচে ছিলেন ম্যান ইউনাইটেডের তখনকার গোলরক্ষক হ্যারি গ্রেগ। বিমান থেকে কোনোরকমে বেরিয়ে এসেও সতীর্থদের টানে আবার ফিরে গিয়েছিলেন ভেতরে। ভাগ্যিস গিয়েছিলেন। আহত হয়ে পড়ে থাকা কোচ ম্যাট বাসবিকে নইলে কে বাঁচাত? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রেগ বের করে এনেছিলেন আরও একজনকে। জীবিত নয়, মৃত মনে করেই। কিন্তু বাইরে আনার পর দেখা গেল বেঁচে আছেন তিনিও।

গ্রেগের কাছে চলুন আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। মানুষ হিসেবে, ফুটবল সমর্থক হিসেবে। দ্বিতীয়বার তিনি যাঁকে বের করে এনেছিলেন, তাঁর নাম ববি চার্লটন!

হেইসেলের ধ্বংসযজ্ঞ

‘উয়েফার ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার একটি ঘণ্টা’—হেইসেল স্টেডিয়ামে সেদিনের ঘটনাটি বর্ণনা করতে গিয়ে নিজের আত্মজীবনীতে ঠিক এ কথাটিই লিখেছিলেন তখনকার জুভেন্টাস সভাপতি জিয়ামপিয়েরো বোনিপেরতি। মাত্র এক ঘণ্টায় তাঁর চোখের সামনে প্রাণ হারান ৩৯ জন ফুটবল সমর্থক, গুরুতর আহত হয়েছিলেন ছয় শতাধিক! কিছুই করতে পারেননি বোনিপেরতি।

ধ্বংসযজ্ঞের পর হেইসেল স্টেডিয়াম। ছবিঃ সংগৃহীত

শুধু জুভেন্টাস সভাপতি কেন, কারওরই কিছু করার ছিল না। হেইসেল সেদিন ছিল নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য। বিশৃঙ্খলা হতে পারে—এ আশঙ্কা ছিল আগে থেকেই। আগের মৌসুমেও রোমা-লিভারপুল ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে ছোটখাটো গন্ডগোল হয়েছে। ১৯৮৫ সালে যখন আবার ফাইনালে উঠল ‘অল রেড’রা এবং তাদের প্রতিপক্ষ ইতালিয়ান পরাশক্তি জুভেন্টাস, তখন বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার কথা ভাবলেন আয়োজকেরা।

ফাইনালের ভেন্যু বেলজিয়ামের ব্রাসেলস স্টেডিয়ামে দেয়াল তোলা হলো। এক পাশে লিভারপুল–সমর্থকেরা বসবে, অন্য পাশে জুভেন্টাসের। কিন্তু আগেরবার অতিথি হয়ে রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে গিয়ে হেনস্তা হয়ে আসার স্মৃতিটা বোধ হয় ভোলেনি লিভারপুল সমর্থকেরা। দেয়ালের দুই পাশেই হই-হুল্লোড় শুরু হলো। ম্যাচ শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে গর্জে ওঠা লিভারপুল–সমর্থকেরা ভেঙে ফেলল সুরক্ষা দেয়াল। ওপাশে এর গা ঘেঁষে বসে থাকা জুভেন্টাস–সমর্থকদের অনেকে মারা গেল তৎক্ষণাৎ। কিন্তু তাদের মৃতদেহ পাশে রেখেই হাতাহাতি-হানাহানি শুরু হলো দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে। এক ঘণ্টা ধরে চলা ধ্বংসযজ্ঞের পর আর চেনার উপায় ছিল না হেইসেল স্টেডিয়ামকে।

যে কারণে উয়েফার তখনকার কর্তাব্যক্তিরা সমালোচিত হয়েছিলেন তা হচ্ছে, এরপরও খেলা হয়েছে। ফুটবলের স্বার্থেই নাকি ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও ম্যাচ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। এবং সেই ম্যাচে জুভেন্টাস জিতেছে ১-০ ব্যবধানে। জীবনে বহুবার ফুটবলের জাদু দেখিয়ে প্রশংসিত সাবেক জুভেন্টাস তারকা মিশেল প্লাতিনি সেই ম্যাচে একমাত্র গোল করেও নিন্দিত হয়েছিলেন অনেকের কাছে। গোল করার পর কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া দুঃসহ ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে নাকি উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিলেন তিনি!

লিভারপুল–সমর্থকদের বন্য আচরণের খেসারত দিতে হয়েছিল পুরো ইংল্যান্ডকে। পরের পাঁচ বছরের জন্য ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের সমস্ত প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সব ইংলিশ ক্লাবকে!

মার্শাল ইউনিভার্সিটির এই পুরো দলটা মারা গিয়েছিল বিমান দুর্ঘটনায়। ছবিঃ সংগৃহীত


মার্শাল ট্র্যাজেডি

নর্থ ক্যারোলিনার ফিকলেন স্টেডিয়াম খুব একটা দূরে নয় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে। মার্শাল ইউনিভার্সিটির ‘থান্ডার হার্ড’ ফুটবল ক্লাবের তাই যাওয়ার কথা ছিল বাসে করেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বদলাল। সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যারোলিনা পাইরেটসের বিপক্ষে খেলতে যাওয়ার জন্য একটা চার্টার্ড বিমান ভাড়া করল তারা। ওই বিমানই যে তাদের সমাধি হবে, তা কে জানত?

যাওয়ার সময় গিয়েছিল ঠিকঠাক। ১৭-১৪ ব্যবধানে হারের কারণে ফেরার পথে সবারই মন খারাপ ছিল কিছুটা এবং এই বিষণ্নতাই জীবনের শেষ সময়ের সঙ্গী হয়ে থাকল তাদের। বৃষ্টি, কুয়াশা, রানওয়ের বরফ—সব মিলিয়ে ভার্জিনিয়ার ট্রাই স্টেট বিমানবন্দরে অবতরণ করা কঠিন হয়ে গেল পাইলটের জন্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিরাপদ সংকেত পাওয়া গেল কন্ট্রোল রুম থেকে; কিন্তু কাজ হলো না। অবতরণ করতে গিয়েই রানওয়ের একটু দূরে থাকা ফুয়েল ট্যাংকের সঙ্গে ধাক্কা খেল সাউদার্ন এয়ার ওয়েজের ফ্লাইট ৯৩২। গড়িয়ে গড়িয়ে যখন রানওয়েতে এসে পৌঁছাল, ততক্ষণে জ্বলে ছাই হয়ে গেছে পুরো বিমান।

মার্শালদের বহনকারী বিমানের ধ্বংসাবশেষ। ছবিঃ সংগৃহীত

এতে ছিলেন খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, বিমানকর্মীসহ ৭৫ জন। বিমানের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল তাঁদের দেহভস্মও। ছয়জনের কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল; কিন্তু তাঁদেরও শনাক্ত করা যায়নি কোনো দিন।

১৪ নভেম্বর, ১৯৭০ যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল ইউনিভার্সিটির ফুটবল দলটা হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে। শোকের আঘাতে এমনই ভেঙে পড়েছিল তারা, পরের ২০ বছর আর ফুটবলই খেলেনি সেই ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা।

আরও পড়ুন: 

কালো মেঘ, মৃত্যু আর ফিরে আসার গল্প