দলের অনুশীলনে বাংলাদেশের কোচ জেমি ডে।
দলের অনুশীলনে বাংলাদেশের কোচ জেমি ডে।

শুধু টাকার কথা মাথায় রেখেই সুপার লিগ

ইউরোপিয়ান সুপার লিগ নিয়ে ফুটবল বিশ্ব রীতিমতো টালমাটাল। ইতালি, স্পেন ও ইংল্যান্ডের ১২টি ক্লাবসহ ১৫টি ক্লাবকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য করে ইউরোপিয়ান সুপার লিগের জন্ম হচ্ছে। রোববার রাতে ১২ ক্লাব একযোগে ইউরোপিয়ান সুপার লিগে যোগ দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে।

ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোর এই অবস্থান নিয়ে নানা ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ফুটবলের জন্য ক্ষতিকর উদ্যোগই বলছেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ জেমি ডেও ‘ক্ষতিকর’ শব্দটার সঙ্গে একমত। ইংল্যান্ড থেকে আজ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি না এটা  ইংল্যান্ড ফুটবলের তথা সামগ্রিক ফুটবলের জন্যই ভালো কিছু। কারণ, এটা করা হয়েছে শুধুই টাকার কথা মাথায় রেখে। অন্য দলগুলো বা সমর্থকদের কথা এখানে ভাবা হয়নি।’

শুধু আর্থিক নয়, এই সুপার লিগের কাঠামোয়ও গলদ দেখেন জেমি। তাঁর কথা, ‘এই লিগে উত্তরণ বা অবনমন নেই। তাহলে কেন ক্লাবগুলো এখানে খেলবে?’ এই প্রশ্ন তুলে জামাল ভূঁইয়াদের কোচ যোগ করেন, ‘আসলে সুপার লিগের মাধ্যমে এসব ক্লাব তাদের আর্থিক দিকটা দ্বিগুণ করতে পারে। সেই বন্দোবস্তই করা হচ্ছে।’

সেলফিশিকারি তরুণ রেফারিদের সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ জেমি ডে।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সব অর্থ ২০টি ক্লাবের মধ্যেই বণ্টন হয়। কিন্তু এই লিগের মাধ্যমে সব অর্থই সীমিত কয়েকটা ক্লাব নিয়ে নেবে। যেটা সমর্থনযোগ্য নয় বলে জেমি যোগ করেন, ‘...তা ছাড়া দেখুন, এই লিগের কিছু ক্লাব সুপার ক্লাব নয়। টটেনহাম, আর্সেনাল সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কিছু জেতেনি। সুতরাং তারা কীভাবে সুপার ক্লাব হয়, আমি বুঝতে পারছি না।’ জেমি বলেন, ‘আসলে ক্লাব মালিকেরা আলাদা লিগের জন্ম দিয়ে তাঁদের অর্থ আয়ের ধারাটা বজায় রাখতে চান। এটা খুবই হতাশাজনক।’

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোনের মতে, এই ক্লাবগুলো আসলে চ্যাম্পিয়নস লিগের বর্তমান কাঠামোয় খুশি নয়। তারা উয়েফা থেকে আরও লভ্যাংশ বেশি চাইছিল। এ নিয়ে গত বছর ক্লাবগুলো উয়েফার সঙ্গে আলোচনা করলেও তাতে কাজ হয়নি। গত বছর কোভিডের কারণে অনেক ক্লাবই চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। এ কারণেই হয়তো নিজেরা আলাদা একটা লিগের জন্ম দিতে চায়।

রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও আতলেতিকো মাদ্রিদ—তিন স্প্যানিশ পরাশক্তির এই লিগে যোগদান সমর্থন করেন কি না প্রশ্নে অস্কারের কথা, ‘অবশ্যই এটা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ আমি বলব, ফুটবল উন্নয়নের জন্য এটা কোনো পথ হতে পারে না। ফুটল কাঠামো পিরামিডের মতো। আপনি এই পিরামিডের বাইরে চলে যেতে পারেন না। ফুটবল কাঠামো প্রমোশন যেমন আছে, রেলিগেশন আছে। এই লিগে সেটা নেই।’

বসুন্ধরা কিংসের খেলোয়াড়দের সঙ্গে কোচ অস্কার ব্রুজোন

স্প্যানিশ ফুটবলের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ ভালো নয় বলে মনে করেন বসুন্ধরা কিংসের এই স্প্যানিশ কোচ। তবে ক্লাবগুলো কেন এমনটা করল, তা বুঝতে পারছেন না, ‘দেখুন, স্প্যানিশ ক্লাবগুলো কোভিডকালে দর্শক, স্পনসর সবই হারিয়েছে। এখন এই আর্থিক দিকটা শক্তিশালী করাই তাদের বড় লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য পূরণে আমার মনে হয়, উয়েফার সঙ্গে দর–কষাকষিতে নামল ক্লাবগুলো। কারণ আগেই বলেছি, উয়েফার বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ কাঠামোয় তারা খুশি নয়।’

বাংলাদেশের অন্যতম কোচ মারুফুল হকের ধারণা, উয়েফার সঙ্গে শীর্ষ ক্লাবগুলোর অভ্যন্তরীণ ঝামেলার কারণেই এটা হয়েছে। সেই ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দুতে হয়তো রয়েছে আর্থিক দিকটা। যে কারণে ক্লাবগুলো এমন পথ বেছে নিয়েছে। তবে মারুফুল আশাবাদী, সংকট মিটে যাবে এবং সবকিছু আগের অবস্থানেই থাকবে।’

উয়েফা, ফিফার বাইরে গিয়ে ফুটবলাররা কিছু করতে পারবেন না। কেননা, সবার লক্ষ্য থাকে চার বছর পরপর দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সেটা হয়তো সম্ভব হবে না বিশ্বাস মারুফুল হকের। অবশ্য ভারতে যেমন বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) হয়েছিল এবং দু–এক বছর হয়ে পরে বন্ধ হয়ে যায়, ইউরোপিয়ান সুপার লিগ শুরুও যদি হয়, আইসিএলের মতোই পরিণতি দেখছেন মারুফুল হক। তাঁর কথা, ‘আইসিএলে অনেকে হয়তো টাকার জন্য গিয়েছিল, কিন্তু অচিরেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ইউরোপিয়ান সুপার লিগ হলেও সেটির ভাগ্য আইসিএলের মতোই হতে পারে। এটা টেকসই হবে না। যেমন আইসিএল হয়নি।’

চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ মারুফুল হক।

ফুটবল বিশ্বে ঝড় তোলা এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি ফুটবলাররাও। ঢাকা আবাহনীর আফগান ডিফেন্ডার মাসিহ সাইগানি বললেন, ‌‘বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন তার সঙ্গে আমিও একমত। আমার মনে হয় এই উদ্যোগ নিয়ে শীর্ষ ক্লাবগুলো উয়েফা ও ফিফার ওপর একটা চাপ তৈরি করছে। আমি বলব, এটা শুধুই অর্থের জন্য করা হচ্ছে। আমি মনে করি না, ফুটবল উন্নয়ন বা ফুটবলের স্বার্থে শীর্ষ ক্লাবগুলো এটা চিন্তা করেছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরও বেশি টাকা আয়ের একটা রাস্তা তৈরি করতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলো। বেশি বেশি মুনাফাই তাদের লক্ষ্য। ফুটবল সমর্থকদের জন্য যা খুবই হতাশার মনে করেন মাসিহ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবগুলো এমনটা ভাবতে পারে, আশা করেননি এই ডিফেন্ডার। আর্সেনাল, লিভারপুল, বার্সেলোনা, জুভেন্টাস, এসি মিলান এই ক্লাবগুলো অনেক বেশি সমর্থকনির্ভর। এটা তাদের সমর্থকদের জন্য খুবই হতাশার উল্লেখ করে আবাহনীর এই ফুটবলার যোগ করেন, ‘আমি এই ধারণাকে কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারছি না। এটা আমার ভালো লাগছে না।’

ঢাকা আবহনীর ডিফেন্ডার মাসিহ সাইগানি

এই ধরনের উদ্যোগ ক্লাবগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে নানা সংকট তৈরি হবে। মাসিহরও একই ধারণা, ‘ইউরোপিয়ান সুপার লিগ খেললে সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলোকে ফিফা ও উয়েফা অবশ্যই শাস্তি দেবে। হয়তো এই ক্লাবগুলোকে নিজ নিজ ঘরোয়া লিগে নিষিদ্ধ করা হবে। একই লিগে খেলে কয়েকটি ক্লাব নিজেদের জন্য আরেকটা লিগ নিজেরা তৈরি করবে, সেটা হতে পারে না। অন্য ক্লাবগুলোর প্রতি এটা বঞ্চনা।’

এই ক্লাবগুলো যদি সুপার লিগের দিকেই এগিয়ে যায় এবং সেটা আয়োজনে বদ্ধপরিকর থাকে, তাহলে ফুটবলের ভবিষ্যৎ কী? মাসিহ সাইগানির কথা, ‘ভবিষ্যৎ খারাপ। ক্লাবগুলো নিজেদের পরিকল্পনায় অটল থাকলে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে নিষিদ্ধ হতে পারে। ফলে এটা ফুটবলের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়।’ একই সঙ্গে তাঁর মনে প্রশ্ন, ‘সুপার লিগে কারা খেলবে, সেটা মোটামুটি আগে থেকেই ঠিক করা। এটা কীভাবে হয়? এটা অন্যদের প্রতি অবিচার। আমি এ ধরনের উদ্যোগকে সমর্থন করি না।’

সুপার লিগে খেলা ক্লাবগুলোর ফুটবলাররা নিজ নিজ জাতীয় দলে নিষিদ্ধ হতে পারেন, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে মাসিহ সাইগানি মনে করেন, এখানে ফুটবলারের কোনো দোষ নেই। সুপার লিগ আয়োজন ক্লাবের সিদ্ধান্ত। কাজেই তাঁর বিশ্বাস, ফুটবলারদের জাতীয় দলে নিষিদ্ধ করার পথে যাবে না ফিফা। সেটা সঠিক হবে না। উদাহরণও দেন জার্মানিতে বড় হওয়া এই ফুটবলার, ‘ধরুন, আবাহনী ও বসুন্ধরা কিংস ফেডারেশনের অমতে কোনো লিগ খেলল। এখন দুই দলের খেলোয়াড়েরা নিষিদ্ধ হলে ফেডারেশন জাতীয় দল গড়বে কীভাবে? এখানে তো ফেডারেশনের দোষ নেই। সুতরাং আমি মনে করি জাতীয় দলে খেলার অধিকার থাকবে ফুটবলারের।’