>ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৭-তে বাংলাদেশ। কেবল অবনতিই হচ্ছে এর। প্রশ্ন হয়, ক্রমাবনতির এই রেখচিত্রে কি ফুটবল কর্তারা চোখ বোলান?
ফিফা ডটকমের বাংলাদেশ পেজে গেলে একটি গ্রাফে আপনার চোখ আটকে যাবে। ফিফার সদস্য প্রতিটি দেশের পেজেই এ ধরনের গ্রাফ দেওয়া থাকে। এই গ্রাফ দিয়ে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে নির্দিষ্ট সেই দেশটির ইতিহাস এক নজরে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের পেজে গ্রাফটি যেন এ দেশের ফুটবলের ক্রমাবনতির চিত্র। প্রশ্ন জাগে মনে, বাংলাদেশের ফুটবল কর্তারা এই গ্রাফের দিকে কখনো তাকিয়ে দেখেছেন কি না!
মাঝখানে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটি রসিকতা চালু হয়েছিল। অনেকেই প্রশ্ন করতেন বাংলাদেশের ফুটবলের ডবল সেঞ্চুরি কত দূর! র্যাঙ্কিংয়ে পেছাতে পেছাতে ২০১৭ সালের মার্চে বাংলাদেশের ফুটবল যখন ১৯৩-তে এসে দাঁড়াল, তখন থেকেই এ রসিকতা চালু। এটিতে মিশে আছে অনেক দুঃখ, অনেক আর্তনাদ! দেশের ফুটবলপ্রেমীরা এখন হাল ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষায় আছেন কবে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং ২০০-তে গিয়ে ঠেকবে। গত এক বছরে সেই র্যাঙ্কিংয়ের কোনো উন্নতি তো হয়ইনি বরং সেটি গিয়ে ঠেকেছে ১৯৭-এ। ডবল সেঞ্চুরির তাহলে আর বেশি বাকি নেই!
ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৭তম অবস্থান এ দেশের ফুটবলের ধারাবাহিক পরিকল্পনাহীনতারই ফসল। এর চেয়ে নিচে নামা কি যায়? ফিফার সদস্য দেশের সংখ্যা ২১১। আর র্যাঙ্কিংয়ে আছে ২০৭টি দেশ। আমাদের পেছনে আছে জিবুতি, ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ড, ইরিত্রিয়া, যুদ্ধবিধ্বস্ত সোমালিয়া প্রমুখ। আমাদের ফুটবল কর্তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারেন এই ভেবে, যে আমাদের পেছনে সাফের অন্তত দুটি দেশ আছে—পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা।
ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের নিজেদের সর্বনিম্ন স্থানে নেমে গেল দেশের ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকাকে ফেডারেশনের শীর্ষপদে বসিয়েই। ২০০৮ সালের এপ্রিলে দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির পদে আছেন কাজী সালাউদ্দিন। অথচ দশ বছর আগে সালাউদ্দিন যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ছিল ১৫০-এর নিচে।
গত দশ বছরে অনেক পরিকল্পনা তিনি করেছেন, অনেক স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন। কিন্তু অবস্থার কেবল অবনতিই হয়েছে। তিনি তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, দশ বছরে ঘরোয়া ফুটবল নিয়মিত মাঠে গড়িয়েছে বলে। কিন্তু নতুন খেলোয়াড় তৈরির কোনো উদ্যোগ ফেডারেশন বা দেশের কোনো ক্লাবের কাছ থেকে পাওয়া গেছে কি না—এসব প্রশ্নে কর্তারা নিশ্চুপ। ২০১৬ সালে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনের আগেও বেশ কিছু স্বপ্ন বা পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু দুই বছর পার হয়ে গেলেও সেই পরিকল্পনাগুলো আলোর মুখ দেখেনি।
২৫ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল সালাউদ্দিনের প্যানেল। তাতে প্রধান বিষয়গুলো ছিল সব বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ফুটবল একাডেমি গড়ে তোলার বিষয়টি। ছিল আন্তর্জাতিক মানের জিমনেসিয়াম তৈরি, ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবল লিগ আইএসএলের আদলে একটি লিগ চালু করা, আর্থিক সহায়তা দিয়ে নিয়মিত জেলা লিগের আয়োজন করা। কিন্তু কিছুই হয়নি।
কয়েক মাস আগে জেলা প্রতিনিধিদের হাতে লাখ খানিক টাকা তুলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করে দেখাতে পারেনি ফেডারেশন। সিলেট বিকেএসপিতে ফুটবল একাডেমির কার্যক্রম শুরু করেও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। জেলা লিগ অনিয়মিত। অনেক জেলায় লিগ হয় নামকাওয়াস্তে। সব মিলিয়ে তৃতীয় মেয়াদেও প্রথম দুই মেয়াদের চেয়ে অবস্থার কোনো পার্থক্য চোখে পড়ছে না।
কিছু হয়নি বলেই তো এই সময়ই ভুটানের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের কাছে ৪ ও মালদ্বীপের কাছে খেয়েছে ৫ গোল। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ৮ ম্যাচে ৩২ গোল খাওয়াও দেশের ফুটবলে নতুন এক রেকর্ড। অথচ ২০১১ সালেও জাতীয় দল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ঢাকায় লেবাননের মতো শক্তিশালী দলকে ২-০ গোল হারিয়েছিল। সালাউদ্দিন-জমানায় ফুটবল যে উল্টো পথে হাঁটছে, সেগুলো বোঝাতে এই কয়টা তথ্যই তো যথেষ্ট।
সব মিলিয়ে শেষ ২২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১৪ গোল করার বিপরীতে মামুনুল-জামালরা গোল হজম করেছে ৬০টি। ৪ জয়ের বিপরীতে ৪ ড্র, ১৪ হার। র্যাঙ্কিংয়ে বড় পতনটা শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের ভুটানের বিপক্ষে হারের পর থেকে। এর পরে আর উন্নতির কোনো উপায়ই ছিল না আসলে—জাতীয় দলই তো ছিল নিষ্ক্রিয়। প্রায় ১৭ মাস পর গত মার্চে মাঠে নেমে লাওসের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করলেও সেটা র্যাঙ্কিংয়ের উন্নতির জন্য যথেষ্ট কিছু নয়।
র্যাঙ্কিংয়ের চক্র পাক থেকে বের হওয়ার কোনো পেছনের দরজা নেই। একটাই উপায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ জেতা। কিন্তু জয়-পরাজয় তো দূরের কথা, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলছে কালে-ভাদ্রে। বেশি বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, বেশি বেশি জয়—র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতিতে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এর জন্য জাতীয় দলকে নিয়ে তো পরিকল্পনা থাকতে হবে! সেটা কী আছে ফুটবল কর্তাদের?