যে সময়ে হওয়ার কথা, করোনা সেই সময়ে ইউরো হতে দেয়নি। এক বছর পিছিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত হতে যাচ্ছে, করোনা তখনো বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। তাতে কী! করোনার ভয়ে তো সব বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। ১১ জুন থেকে তাই মাঠে গড়াচ্ছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে জাতীয় দলগুলোর সবচেয়ে মর্যাদার আসর। তবে আনুষ্ঠানিক নামটা থাকছে আগের মতোই—ইউরো ২০২০। আরও একবার ইউরোপিয়ান ফুটবলের উন্মাদনায় মেতে ওঠার আগে স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে ফিরে দেখা যাক আগের আসরগুলো।
বিশ্বকে টোটাল ফুটবল শেখানো নেদারল্যান্ডসের সেই সোনালি প্রজন্মও পারেনি। সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হয়েও তাই জাতীয় দলের হয়ে ইয়োহান ক্রুইফের অর্জন শূন্য। টোটাল ফুটবল ধারণার জন্ম যাঁর মাথা থেকে, সেই রাইনাস মিশেলসকে অবশ্য একেবারে খালি হাতে কোচিং ক্যারিয়ার শেষ করতে হয়নি। ক্রুইফদের নিয়ে যা পারেননি ১৯৭৪ বিশ্বকাপে, সেটাই করে দেখিয়েছেন পরে আবার নেদারল্যান্ডস দলের কোচ হয়ে ফিরে ১৯৮৮ ইউরোতে।
এর মাঝে খুব খারাপ সময় কেটেছে ডাচদের। ১৯৮২ ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপে জায়গাই পায়নি নেদারল্যান্ডস, খেলতে পারেনি দুই বিশ্বকাপের মাঝে ১৯৮৪ ইউরোতেও। অথচ ডাচদের আক্রমণাত্মক, আকর্ষণীয় ফুটবলে তখনো মুগ্ধ ইউরোপ এবং ফুটবল–বিশ্ব। অবশেষে ১৯৮৮ ইউরোতে নিজের ফুটবল ইতিহাসের সেরা সাফল্যের গল্পটা লিখে ডাচরা।
রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) বিপক্ষে ১-০ গোলের হার দিয়ে টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয় নেদারল্যান্ডসের। আট দলের টুর্নামেন্টে দুটি গ্রুপ, প্রতি গ্রুপে চারটি করে দল। গ্রুপের সেরা দুই দলের মধ্যে থেকে সেমিফাইনালে যাওয়ার জন্য তাই বাকি দুই ম্যাচ জেতার বিকল্প ছিল না রাইনাস মিশেলসের দলের। ডাচরা ঘুরে দাঁড়াল দারুণভাবে।
সবকিছু বদলে গেল আসলে মার্কো ফন বাস্তেন একাদশে ঢোকার পর। ডান পায়ের ডাচ স্ট্রাইকার উদ্বোধনী ম্যাচে দলের একাদশে ছিলেন না। কিন্তু পরের ম্যাচে আর তাঁকে বেঞ্চে রেখে শুরু করার ঝুঁকি নিলেন না মিশেলস। দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারায় ডাচরা, তিনটা গোলই ফন বাস্তেনের। ওই জয়ে বদলে যায় দলের মানসিকতাও, বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাস।
সেমিফাইনালে যেতে হলে শেষ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডকে হারাতেই হবে, এমন সমীকরণ মাথায় নিয়ে নেমে ডাচরা জিতল উইম কিয়েফতের একমাত্র গোলে। সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ জার্মানি, যাদের কাছে ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরেছিল নেদারল্যান্ডস। লোথার ম্যাথাউসের পেনাল্টি থেকে জার্মানি এগিয়ে যায় ৫৫ মিনিটে। নেদারল্যান্ডস সমতা ফেরায় রোনাল্ড কোমানের পেনাল্টি গোলে, ৭৪ মিনিটে। তারপর ৮৮ মিনিটে মার্কো ফন বাস্তেনের গোল। প্রতিশোধ নিয়ে ফাইনালে ওঠে নেদারল্যান্ডস।
যে রাশিয়ার কাছে হার দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল ডাচদের, ফাইনালে আবার তারাই প্রতিপক্ষ। ফাইনালের ভেন্যুও মিউনিখের অলিম্পিয়া স্টেডিয়াম, যেখানে ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরেছিল নেদারল্যান্ডস।
৩৩ মিনিটেই ফন বাস্তেনের পাস থেকে অধিনায়ক রুদ খুলিতের গোলে এগিয়ে যায় নেদারল্যান্ডস। ৪ গোল করে তখন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা মার্কো ফন বাস্তেন। তবে তাঁর পঞ্চম গোলটা ডাচ ফুটবল ইতিহাসেরই সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় গোল হয়ে থাকবে। ২৩ বছর বয়সী এসি মিলান স্ট্রাইকারের দুর্দান্ত এক ভলি পরে ব্রিটিশ এক জরিপে ফুটবলের সেরা ১০০ মুহূর্তের তালিকায় জায়গা পায় ২১ নম্বরে। বাস্তেনের সেই অসাধারণ গোলই নেদারল্যান্ডসকে এনে দেয় এখন পর্যন্ত তাদের ফুটবল ইতিহাসের একমাত্র ট্রফি।
স্বাগতিক: জার্মানি
ফাইনালের ভেন্যু: অলিম্পিয়া স্টেডিয়াম, মিউনিখ
চ্যাম্পিয়ন: নেদারল্যান্ডস
রানার্সআপ: রাশিয়া
সর্বোচ্চ গোলদাতা: মার্কো ফন বাস্তেন (৫ গোল)
১৯৮৮ ইউরো বৈশ্বিক ফুটবলের বিরল কয়েকটি টুর্নামেন্টের একটি, যেখানে কেউ লাল কার্ড দেখেননি, কোনো ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়নি এবং নকআউট পর্বে কোনো ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে বা টাইব্রেকারে যায়নি। ওই আসরেই শেষবারের মতো পশ্চিম জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া নামের দেশগুলো অংশগ্রহণ করেছিল। দুই বছর পরই দুই জার্মানি এক হয়ে শুধু জার্মানি নামে খেলা শুরু করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি আলাদা দেশ হয়ে যায় ১৯৯১ সালে। নব্বইয়ের দশকে যুগোস্লাভিয়া ভেঙেও হয় ছয়টি আলাদা দেশ। ওই ইউরো দিয়েই বড় কোনো টুর্নামেন্টে অভিষেক হয় আয়ারল্যান্ডের।
ডাবল জয়
পিএসভিরহয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশের হয়ে ইউরো জয়ের স্বাদ পান চার ডাচ তারকা হানস ফন ব্রুকেলেন, বেরি ফন এরলে, জেরার্ড ফেনেনবার্গ ও রোনাল্ড কোমান।
হরিষে বিষাদ
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে চতুর্থ ইংলিশ খেলোয়াড় হিসেবে নিজের শততম ম্যাচটা খেলেছিলেন ইংল্যান্ড গোলরক্ষক পিটার শিলটন। দুর্ভাগ্য তাঁর, সেদিন মাঠ ছাড়তে হয়েছিল ফন বাস্তেনের হ্যাটট্রিকের শিকার হয়ে।
নৌকাডুবি
ট্রফি নিয়ে ডাচ দল দেশে ফেরার পর তাদের স্বাগত জানাতে জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছিল আমস্টারডামের পথঘাট ও শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা খালগুলো। প্রায় এক লাখ মানুষ নৌকা নিয়ে খালে নেমেছিল আনন্দ উদ্যাপন করতে। মানুষের ওজন নিতে না পেরে ডুবে গিয়েছিল অনেক নৌকা।