১৯৮৪ ইউরোজয়ী ফ্রান্স দল
১৯৮৪ ইউরোজয়ী ফ্রান্স দল

প্লাতিনির মহাতারকা হওয়ার মঞ্চ এবং ফ্রান্সের প্রথম ট্রফি

যে সময়ে হওয়ার কথা, করোনা সেই সময়ে ইউরো হতে দেয়নি। এক বছর পিছিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত হতে যাচ্ছে, করোনা তখনো বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। তাতে কী! করোনার ভয়ে তো সব বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। ১১ জুন থেকে তাই মাঠে গড়াচ্ছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে জাতীয় দলগুলোর সবচেয়ে মর্যাদার আসর। তবে আনুষ্ঠানিক নামটা থাকছে আগের মতোই—ইউরো ২০২০। আরও একবার ইউরোপিয়ান ফুটবলের উন্মাদনায় মেতে ওঠার আগে স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে ফিরে দেখা যাক আগের আসরগুলো।

মিশেল প্লাতিনির আবির্ভাব

ইউরোর ট্রফি হাতে মিশেল প্লাতিনি

ইউরোপিয়ান ফুটবল তখন এমন ছিল না, এমন ছিল না ইউরোপের মানচিত্রও। স্নায়ুযুদ্ধ তখনো চরমে, বার্লিনের দেয়াল তখনো দাঁড়িয়ে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ব্লকের বিভাজন তখনো ছয় বছরের দূরত্বে। উয়েফার সদস্যদেশের সংখ্যাও তখন এখনকার (৫৫টি) চেয়ে ২২টি কম। ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে তখন খেলে মাত্র ৮টি দল। তারপরও ১৯৮৪ ইউরোকে বলা হয় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং তর্কযোগ্যভাবে সেরা ইউরোর আসর।
সেটা অনেক কারণেই। তবে প্রধান কারণ অবশ্যই দারুণ রোমাঞ্চকর সব ম্যাচ এবং মিশেল প্লাতিনি নামের এক মহাতারকার আবির্ভাব হয়েছিল ওই টুর্নামেন্টে।
ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত মা–বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া মিশেল ফ্রঁসোয়া প্লাতিনির ফুটবলার হওয়াটা সম্ভবত নিয়তিই ছিল। জীবনে প্রথমবার কোনো ফুটবল ক্লাবে ট্রায়াল দিতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন এবং পরে শুনেছিলেন, তাঁর হৃৎপিণ্ডে সমস্যা আছে, খেলাধুলা তাঁকে দিয়ে হবে না। সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে ১৯৭৬ সালে যে প্লাতিনির ফ্রান্সের জার্সিতে অভিষেক হয়ে গেল, সেটা ভাগ্যের লিখন ছাড়া আর কী!

অভিষেক বেশ আগে হলেও তিনি মিশেল প্লাতিনি হয়ে উঠলেন আসলে ১৯৮৪ ইউরোতে। প্লাতিনি, আলেঁ জিরেস, লুই ফার্নান্দেজ ও জঁ তিগানাকে নিয়ে গড়া ফ্রান্সের মাঝমাঠের ‘ম্যাজিক স্কয়ার’ আশির দশকে উপহার দিয়েছিল মনমাতানো ফুটবল। কিন্তু প্লাতিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সবাইকে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ যেমন শুধুই ডিয়েগো ম্যারাডোনার, ১৯৮৪ ইউরোটা তেমনি শুধুই প্লাতিনির।
ওই টুর্নামেন্টে মাত্র ৫ ম্যাচে ৯ গোল করেছিলেন প্লাতিনি, যা এখনো ইউরোর এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। ডেনমার্কের বিপক্ষে ফ্রান্সের উদ্বোধনী ম্যাচে প্লাতিনির এক গোল, গ্রুপে বেলজিয়াম ও যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে দুই ম্যাচে দুটি হ্যাটট্রিক, পর্তুগালের বিপক্ষে সেমিফাইনালে এক গোল, স্পেনের বিপক্ষে ফাইনালেও একটি।

ফ্রি-কিক থেকে প্লাতিনির গোল

শুধু গোলের সংখ্যাই নয়, বৈচিত্র্যেও অনন্য ছিলেন প্লাতিনি। একটা গোল পেনাল্টি থেকে, ডান পায়ে তিনটি, বাঁ পায়ে একটি, দুটি অসাধারণ হেডে ও দুটি ফ্রি-কিক থেকে। প্লাতিনির এমন নৈপুণ্যের পর ফ্রান্স ওই ইউরোতে চ্যাম্পিয়ন না হলে সেটাই অঘটন হতো, তা হয়নি। প্যারিসে স্পেনকে ২-০ গোলে হারিয়েই প্রথমবারের মতো কোনো বড় আসরের ট্রফি পেয়েছিল স্বাগতিকেরা।

একনজরে ইউরো ১৯৮৪

স্বাগতিক: ফ্রান্স
ফাইনালের ভেন্যু: পার্ক দো প্রিন্সেস
চ্যাম্পিয়ন: ফ্রান্স
রানার্সআপ: স্পেন
সর্বোচ্চ গোলদাতা: মিশেল প্লাতিনি (৯ গোল)

১৯৮৪ ইউরোতে দুর্দান্ত খেলেছিল ডেনমার্ক

চার বছর আগে ইতালিতে ইউরোটা হয়েছিল খুব ম্যাড়মেড়ে। এর দুই বছর পর স্পেনে দুর্দান্ত এক বিশ্বকাপ। ফ্রান্সের ইউরো কতটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে, সেই শঙ্কা তো কিছুটা ছিলই। তার ওপর ওই আসরের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা হয়নি ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও পোল্যান্ডের মতো দলের। কিন্তু বড় দলগুলোর এই অনুপস্থিতি ইউরোর রোমাঞ্চ কমাতে পারেনি। ফ্রান্স, পর্তুগাল, ডেনমার্ক ও স্পেন সব পুষিয়ে দিয়েছে দুর্দান্ত সব ম্যাচ উপহার দিয়ে।
বাছাইপর্ব থেকে ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দেওয়া ডেনমার্ক তো পেয়ে গিয়েছিল ‘ড্যানিশ ডিনামাইটস’ নাম। মাইকেল লাউড্রপ ও মর্টেন ওলসেনদের পথচলা পরে শেষ হয়েছিল সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে স্পেনের কাছে হেরে। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো অন্য সেমিফাইনালে ফ্রান্স ৩-২ গোলে হারিয়েছিল পর্তুগালকে।
১৯৮৪ ইউরোতেই সম্ভবত স্মরণকালের সবচেয়ে দুর্বল জার্মানি দলটা খেলেছিল। গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচের মাত্র একটি জিতেই বিদায় নিয়েছিল তখনকার ইউরো চ্যাম্পিয়ন জার্মানি ও রানার্সআপ বেলজিয়াম।

আরও যত গল্প

অপ্রতিরোধ্য ফ্রান্স
ইউরো জয়ের বছরে অবিশ্বাস্য ফর্মে ছিল ফ্রান্স। সব মিলিয়ে ১৯৮৪ সালে ১২টি ম্যাচ খেলেছেন মিশেল প্লাতিনিরা, জিতেছেন সব কটিতেই। ১৯৮০ সালে দলের সংখ্যা বাড়ানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রান্সই একমাত্র দল, যারা স্বাগতিক হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

গোলের পর প্লাতিনির উল্লাস

তিগানার ভয়
সেমিফাইনালের অতিরিক্ত সময়ে একপর্যায়ে ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকা ফ্রান্স কোনোভাবেই ম্যাচটা হারতে বা টাইব্রেকারে নিতে চায়নি। ওই জেদ থেকেই শেষ পর্যন্ত প্লাতিনিরা ৩-২ গোলে জিতেছিলেন ম্যাচটা। টাইব্রেকার পর্যন্ত না নিতে চাওয়ার একটা কারণ আছে। প্লাতিনিই পরে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘জঁ তিগানা আমাকে বলেছিল, সে কখনো পেনাল্টি শুটআউটে কোনো ম্যাচ জেতেনি। ভয় পাচ্ছিল, পেনাল্টিতে গেলে আমরা হেরে যাব। আমরাও তাই ঠিক করলাম, পেনাল্টিতে যাওয়ার আগেই ম্যাচটা জিততে হবে।’