>কত কত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় এখন ফুটবল মাঠে। এসব প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। প্রযুক্তি-সাহায্য নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনও বিশ্বকাপের বড় ও আলোচিত ম্যাচগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছে। নতুন ধারাবাহিক ‘প্রযুক্তির চোখে’র তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো। বিশ্বকাপের আলোচিত জার্মানি-মেক্সিকো ম্যাচের বিশ্লেষণ পড়ে নিন। লিখেছেন নিশাত আহমেদ
ফুটবল খেলার সংজ্ঞা দিতে দিয়ে গ্যারি লিনেকারের উক্তি ‘বাণী চিরন্তনী’ হয়ে আছে। ফুটবল সেই খেলা, ২২ জন এক বলের পিছে দৌড়ায় আর শেষে জেতে জার্মানি! বিশ্বকাপ মানে যেন সেই কথা আরও বেশি করে সত্যি হয়ে ওঠে। জার্মানির ফুটবল সিস্টেমে যেন সেটি ঢুকিয়ে দেওয়া আছে। জার্মানরা হয়তো খেলার ধরনে এখন আর আগের মতো যন্ত্র নয়। কিন্তু মানসিকতায়? এত এত চাপের মুখেও জার্মানদের ভেঙে পড়তে দেখা যায় না কখনো। সেই জার্মানি এবার প্রথম ম্যাচে হেরে গেল মেক্সিকোর কাছে!
জার্মানরা তো কৌশলগত ভুল করে অভ্যস্ত নয়। তাহলে এ রকম অবস্থা কেন হলো? ৪-২-৩-১ ফরমেশনে খেলা জার্মানদের ডিফেন্সের ডান দিকে ছিলেন নতুন ‘লাম’ খ্যাত জোশুয়া কিমিখ, বাঁ দিকে মারভিন প্ল্যাটেনহার্টকে রেখে মাঝে জুটি বেঁধেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের দুই সেন্টারব্যাক ম্যাটস হামেলস ও জেরোম বোয়েটেং। দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের মধ্যে স্যামি খেদিরার দায়িত্ব ছিল যথারীতি রক্ষণাত্মক, আর টনি ক্রুসকে যথারীতি বলা হয়েছিল আক্রমণ রচনা করার জন্য।
মেক্সিকোর খেলোয়াড়েরা জানতেন, লাম-শোয়াইনস্টাইগারবিহীন এই জার্মানিকে আটকানোর একমাত্র উপায় ক্রুসকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা। খুবই চতুরভাবে ক্রুসের আশপাশে পাস দেওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তাঁরা, সঙ্গে মেক্সিকোর হিরভিং লোজানো, আন্দ্রেয়া গুয়ার্দাদো ও মিগেল লায়ুনদের দুর্ধর্ষ কাউন্টার তো ছিলই। পুরো ম্যাচে ক্রুসের দেওয়া পাসগুলোর মধ্যে ৯২.৯ শতাংশ সফল হলেও তার মধ্যে মাত্র একটা পাসই গোলের সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছে। এতেই বোঝা যায় মেক্সিকোর মিডফিল্ডে থাকা হেক্টর হেরেরা আর আন্দ্রেস গুয়ার্দাদো কতটা কার্যকরী ছিলেন ক্রুসকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার ব্যাপারে। মেক্সিকোর ডি–বক্সে একবার মাত্র ঢুকতে পেরেছিলেন ক্রুস। ছয়টা শট মারার চেষ্টা করেছেন, ছয়টাই বক্সের বাইরে থেকে। দলের মূল প্রাণভোমরার এ রকম হাঁসফাঁস অবস্থা হলে দল ধারহীন খেলা খেলবেই, এটাই স্বাভাবিক!
তবে দলটা জার্মানি, তাদের দলে কখনো সে রকম মহাতারকা থাকেন না, তারা দল হিসেবেই খেলে। সেই হিসেবে ক্রুস তাঁর স্বাভাবিক খেলাটা না খেলতে পারলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তারপরও এই অঘটনটা ঘটার সবচেয়ে বড় কারণ, জার্মান ডিফেন্সের তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়া। দুই ফুলব্যাক জোশুয়া কিমিখ আর মারভিন প্ল্যাটেনহার্ট প্রথম খেলতে নেমেছিলেন বিশ্বকাপে। প্রথম ম্যাচের উত্তেজনার সঙ্গে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও অতি–আক্রমণ প্রবণতা—সবকিছু মিলিয়ে প্রায়ই দেখা যাচ্ছিল পুরো ডিফেন্সে শুধু হামেলস আর বোয়েটেংই দাঁড়িয়ে আছেন।
দুই পাশ দিয়ে বিদ্যুতের গতির মতো একের পর এক পাল্টা আক্রমণ করে গেছেন মেক্সিকোর উইঙ্গার ও স্ট্রাইকাররা। ওদিকে হামেলসের সঙ্গে রসায়নটা ভালো না থাকার কারণে মাঝে মাঝে ওপরে উঠে গেছেন বোয়েটেংও। ফলে অনেক সময়েই বেহুলার বাসরের মতো দেখতে অটল কিন্তু আদলে সর্বনাশা এক রক্ষণ হয়ে পড়ছিল জার্মান ডিফেন্স।
বিপজ্জনক জায়গা থেকে একবারের জন্যও বল ক্লিয়ার করতে পারেননি বোয়েটেং। তিনবার বল ক্লিয়ার করলেও মেক্সিকোর গতিময় কাউন্টারের জবাব জানা ছিল না হামেলস বা বোয়েটেং কারোরই। তার ওপর যে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের অপেক্ষাকৃত রক্ষণাত্মক থেকে ডিফেন্সকে আগলে রাখার কথা ছিল, সেই খেদিরাও ছিলেন চরম ব্যর্থ। পুরো ম্যাচে তাঁর মতো একটা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার একটাও ট্যাকল করতে পারেননি, আক্রমণ আটকাতে পারেননি, ভাবা যায়?
সবচেয়ে জঘন্য ছিল দুই ফুলব্যাক কিমিখ ও প্ল্যাটেনহার্টের ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকতে না পারা। তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ হানা দিয়েছে জার্মান ডিফেন্সের ডান দিক থেকে। যে জায়গাটা জোশুয়া কিমিখের সামলানোর কথা। এই দিক থেকেই বারবার মেক্সিকান লেফট উইঙ্গার হিরভিং লোজানো আক্রমণ করে গেছেন, করেছেন জয়সূচক গোলটাও। মাঝমাঠে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হেক্টর হেরেরা যখনই বল পেয়েছেন, এই লোজানোর দিকেই পাঠিয়ে দিয়েছেন অধিকাংশ সময়ে। কিমিখের সেদিকে খেয়াল ছিল না মোটেও, তিনি রক্ষণ না করে আক্রমণের দিকেই মনোযোগী ছিলেন বেশি।
ডিফেন্ডারের আসল কাজ যেখানে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া, বিপজ্জনক জায়গা থেকে বল সরিয়ে দেওয়া বা সফল ট্যাকল করা, কিমিখ এর কোনো কাজই করেননি; বরং আক্রমণে উঠে গিয়ে গোল বরাবর দুটো শট মেরে এসেছেন ঠিকই। আর এই সুযোগটাই দুই হাত ভরে নিয়েছেন লোজানো। কিমিখ আক্রমণে উঠে গেলেও সমস্যা হতো না, যদি স্যামি খেদিরা ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য ভালোভাবে রক্ষণের দিকটা লক্ষ রাখতেন। সেটাও হয়নি। তার চড়া মাশুলই দিয়েছে জার্মানরা। ওদিকে মেসুত ওজিলকে তো বলতে গেলে মাঠে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। স্ট্রাইকার টিমো ভেরনারের সঙ্গে রসায়নটা ঠিক জমে ওঠেনি এই মিডফিল্ডারের।
জার্মান কোচ জোয়াকিম লো যথেষ্ট বুদ্ধিমান। মূল একাদশের খেলোয়াড়দের ব্যর্থতা দেখে দ্রুতই অপশন বি-তে চলে গিয়েছিলেন তিনজন বদলি নামিয়ে। লোয়ের হাতে বিকল্প আছে যথেষ্ট। সামনের ম্যাচগুলোতে তাই প্রথম ম্যাচের জার্মানিতে না দেখার সম্ভাবনাই বেশি।
আরও পড়ুন:
প্রযুক্তির কাটাছেঁড়া: আর্জেন্টিনা-আইসল্যান্ড ম্যাচ
প্রযুক্তির কাটাছেঁড়া: কেন পারল না ব্রাজিল?