>ফুটবল মাঠে এখন কত ধরনের প্রযুক্তিরই না ব্যবহার হয়। এসবের সাহায্য নিয়ে চলে খেলার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। প্রযুক্তি-সাহায্য নিয়ে প্রথম আলো অনলাইনও বিশ্বকাপের বড় ও আলোচিত ম্যাচগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছে। নতুন ধারাবাহিক ‘প্রযুক্তির চোখে’র পঞ্চম পর্বে থাকছে ব্রাজিল-কোস্টারিকা ম্যাচের বিশ্লেষণ। লিখেছেন নিশাত আহমেদ
এবার নেইমারের ওপর পুরো ব্রাজিলের প্রত্যাশার ভার। ছিল না কবে! পেলে, রোনালদো, রোমারিও, রোনালদিনহো, কাকাদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ব্রাজিলীয়রা নেইমারকে পছন্দ করেছেন ২০১৪ বিশ্বকাপ থেকেই। কিন্তু সেই প্রত্যাশার ভার কি ঠিকমতো বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারছেন এই তারকা?
চাইলে এ নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। ২৬ বছর বয়সেই দেশের জার্সিতে ৮৭ ম্যাচ খেলে ৫৬টি গোল করে ফেলেছেন; আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোল করা ব্রাজিলীয়দের মধ্যে তাঁর স্থান তিনে। এই একটি রেকর্ডের দিকে তাকালেই বোঝা যায় ব্রাজিলীয়রা তাদের প্রত্যাশার ভার বইবার জন্য বেছে নিয়েছেন ঠিক খেলোয়াড়টিকেই। এই রেকর্ডে নেইমার নিজেও প্রমাণ করেছেন, দেশের মানুষদের প্রত্যাশার ভার তিনি বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারছেন না—কথাটা পুরোপুরিই অবান্তর।
কিন্তু ব্রাজিলীয়রা কি তাঁদের আসল খেলোয়াড়ের কাছ থেকে শুধু গোলই চায়? অবশ্যই না। ব্রাজিলের মতো ফুটবল-কুলীন জাতির দর্শকদের শুধু গোল দিয়ে সন্তুষ্ট করা যায় না, সন্তুষ্ট করতে হয় ট্রফি দিয়ে, আরও স্পষ্ট করে বললে বিশ্বকাপ ট্রফি দিয়ে। ব্রাজিলের আগের বেশির ভাগ মহাতারকারাই বিশ্বকাপ জিতেছেন; রোনালদো, পেলে, রিভালদো, রোমারিও, রোনালদিনহো, কাকা—সবাই! ২০০২ সালের পর থেকে আর বিশ্বকাপ না জেতা ব্রাজিলের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ বা ‘হেক্সা’ জেতার আকাঙ্ক্ষাটা তো গত ষোলো বছর ধরে পরিণত হয়েছে রীতিমতো হাহাকারে।
নেইমার কি ব্রাজিলকে তাদের সেই আরাধ্য ‘হেক্সা’ এনে দিতে পারবেন?
অন্তত এই বিশ্বকাপে তাঁর খেলা দেখে তো সেটি মনে হচ্ছে না। গোল করা বা করানোর চাইতে মাঠে চোটের ভান করে রেফারির সুবিধা নেওয়াতেই যেন তাঁর সব আগ্রহ! প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে এই ‘ডাইভ’ দেওয়ার কারণে অনেক সমালোচিত হয়েছিলেন নেইমার, গতকালকেও একই কারণে আলোচনায় এসেছেন তিনি। যদিও ম্যাচের শেষ গোলটা করে এই বিশ্বকাপে গোলের খাতা খুলেছেন, কিন্তু তাতে নিন্দুকদের মুখ বন্ধ হচ্ছে কোথায়?
পুরো নব্বই মিনিট গোলশূন্য থাকার পর যোগ করা সময়ের দুই গোলে কোস্টারিকাকে হারিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ব্রাজিল। এই দুই গোলেরই একটি নেইমারের, অন্য গোলটি ফিলিপ্পে কুতিনহোর। কিন্তু কেমন খেলেছেন এই ম্যাচে নেইমার? ব্রাজিলই–বা খেলেছে কেমন?
পুরো ম্যাচে ৯৭ বার বল স্পর্শ করা নেইমারের সফল পাস দেওয়ার হার ছিল ৮৯.৮ %, গোল করার জন্য শট নিয়েছেন ৫টি, যার মধ্যে ৩টি ছিল গোলমুখে। গোলে সহায়তা করার জন্য ‘কি পাস’ দিয়েছেন তিনটি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে নেইমারের ‘ডাইভ’ বিতর্কই সব আলো কেড়ে নিচ্ছে যেন।
মাঠের বাঁ প্রান্তেই মূলত দেখা গেছে নেইমারকে। বাঁ প্রান্ত থেকেই থেকে থেকে ডি-বক্সের মধ্যে আসার চেষ্টা করেছেন নেইমার, কখনো সফল হয়েছেন, কখনো ব্যর্থ।
দেখে নিন নেইমারের গোলটা-
ওদিকে মোটামুটি নেইমারের মতোই খেলেছেন কুতিনহো। প্রথম গোল করে কোস্টারিকার ডিফেন্সের বাঁধও ভেঙেছেন তিনিই। ৯০ মিনিটে ৯৮ বার বল স্পর্শ করা কুতিনহোর সফল পাস দেওয়ার হার ছিল ৯২%, যা নেইমারের তুলনায় বেশিই। গোল করার জন্য শট নিয়েছেন মোট ৬টি, ৩টি ডি-বক্সের ভেতর থেকে, ৩টি বাইরে থেকে।
দেখে নিন কুতিনহোর গোলটা-
তবে সবচেয়ে হতাশাজনক খেলা ছিল মূল স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল জেসুসের। বক্সের মধ্যে প্রথাগত ব্রাজিলীয় স্ট্রাইকারদের সেই আগ্রাসী মনোভাবটাই যেন নেই তাঁর মধ্যে। রোনালদো, রোমারিও, টোস্টাওদের সেই কিংবদন্তি ৯ নম্বর জার্সির ধারক এবার জেসুস, কিন্তু পূর্বসূরি খেলার সেই ঝলকটা এখনো দেখাতে পারছেন না তিনি, কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচেও ছিলেন বেশ নিষ্ক্রিয়। পুরো ম্যাচে মাত্র ১৯ বার বল স্পর্শ করতে পারা জেসুসের সফল পাস দেওয়ার হারও ছিল মাত্র ৭০%। কোনোরকমে দুটো শট নিতে পেরেছেন গোল করার জন্য, একটা শটও গোলমুখে ছিল না।
গতকাল আরেকটু হলে ব্রাজিলকে আটকেই দিচ্ছিল কোস্টারিকা। এ রকম যাতে আর না হয়, সেই পরাক্রমশালী ব্রাজিলকে যাতে দেখা যায়, তা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব এই নেইমারের কাঁধেই! নেইমার কি পারবেন নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করতে?