আন্দ্রেয়া পিরলো, নামটা শুনলে এক ঝটকায় কি মনে পড়ে? মাঝ মাঠে দাগের ওপাশে দাড়িওয়ালা ছিপছিপে এক খেলোয়াড়। তীক্ষ্ণ চোখদুটোয় অতল গভীরতা ঠিক তাঁর খেলার ছন্দের মতোই।
মিডফিল্ডের একদম পেছন থেকে ঋষিদের মতো দুরদৃষ্টিতে এমন সব পাস দেন যে তাক লেগে যায়। এভাবেও চিরে দেওয়া সম্ভব! ফ্রি কিকেও সেই একই ব্যাপার। ফাঁকটা বের করে ফেলেছেন। বয়সকে ওয়াইনের বোতলে আটকে পিরলো হয়ে উঠেছিলেন 'চিরসবুজ' মিডফিল্ডার।
৩৮ বছর বয়স পর্যন্ত খেলেছেন পেশাদার ফুটবল। দিন যত কেটেছে ধার তত বেড়েছে তবে সবকিছুই হতো ঠান্ডা মাথায়। মাঠে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তে ওটুকু ভিত্তি। জিয়ানলুইজি বুফনকেও গোলপোস্টের নিচে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। কিন্তু গোলরক্ষকদের সেটি একমাত্র কাজ না।
তিন কাঠির নিচে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে যেহেতু গোটা মাঠ দেখা যায়, তাই গলাটা চরানো অবশ্যকর্তব্য। বুফনকে তাই দেখা যায়, গোলপোস্ট থেকে চেঁচিয়ে রক্ষণভাগে সতীর্থদের অবস্থান ঠিক করতে। স্থির চিত্রার্পিত মূর্তির মতো বুফনকে কখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়নি যেটা দাগের ওপাশে দেখা যেত পিরলোর ক্ষেত্রে। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি চরিত্র কিন্তু দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন নদী হয়ে মিলেছেন এক মোহনায়। বন্ধুত্বের মোহনা!
বুফন-পিরলোর পরিচয় আলাদা করে দেওয়ার কিছু নেই। দুজনেই ইতালিয়ান ফুটবলের কিংবদন্তি, বিশ্বকাপজয়ী, ক্লাব ফুটবলেও সাফল্য অসামান্য। আর এই পথেই গাঢ় থেকে গাঢ় হয়েছে দুজনের বন্ধুত্ব। ২০০২ থেকে ২০১৫ ইতালি জাতীয় দলে একসঙ্গে খেলেছেন বুফন-পিরলো। জুভেন্টাসে প্রথম মেয়াদে বুফনের ১৭ বছরে পিরলোকে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন চার মৌসুম। এখন চলছে দ্বিতীয় মেয়াদ। হ্যাঁ, ৪২ বছর বয়সী বুফনও চিরসবুজ ফুটবলার। এখনো সামলে যাচ্ছেন 'তুরিনের বুড়ি'দের পোস্ট। আর এই দ্বিতীয় মেয়াদেই চমকপ্রদ ঘটনাটা ঘটে গেল।
কী সেই ঘটনা তা এতক্ষণে নিশ্চয়ই আন্দাজ করে ফেলেছেন? সে কথায় পরে আসা যাবে। আগে পিরলোর সঙ্গে বুফনের বোঝাপড়ার রূপটা দেখা যাক। ২০১৫ সালে পিরলো জুভেন্টাস ছেড়ে নিউইয়র্ক সিটিতে যোগ দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি পোস্ট করেন বুফন, 'সবাই তোমাকে নানা ভাষায় বিদায় ও শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আমি শুধু একটি শব্দ বলতে চাই, যা দিয়ে আমাদের একসঙ্গে জীবন কাটানোকে ধারণ করা সম্ভব। বন্ধুত্ব। শুভ কামনা আমার বন্ধু, তোমার বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য।'
আচ্ছা, বুফন তাঁর এই কাছের বন্ধুকে কি এখন ক্লাব সতীর্থদের সামনে 'বন্ধু' বলে ডাকতে পারবেন? প্রশ্নটা উঠছে কারণ, বুফনকে তো এখন খেলতে হবে পিরলোর অধীনে। ইতালির কিংবদন্তি এই গোলরক্ষক তিন কাঠির নিচে থাকবেন কি না তা ঠিক করবেন পিরলো। কোন ম্যাচে খেলবেন, কোনটা খেলবেন না এসব আরকি। বুফনের চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোট পিরলো যে এখন তাঁর-ই কোচ।
পেশাদার ফুটবলে এ নতুন কিছু না। কিন্তু বুফনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। বলতে গেলে 'মানিকজোড়'সুলভ সম্পর্ক। পিরলোর ওয়াইনের কারখানার সুরায় দুজন হয়তো একে-অপরের স্বাস্থ্য পানও করেছেন এন্তার। হাসি-ঠাট্টা, তামাশা ও স্মৃতিচারণ তো সবার জীবনেরই অংশ। বুফনের জীবনে পিরলোকে নিয়ে এই অধ্যায়টুকু কাল থেকে একটু হলেও পাল্টে যেতে শুরু করেছে।
জুভেন্টাস গোলরক্ষক তাই জানতে চেয়েছেন তাঁর নতুন কোচের কাছে, তাহলে তোমাকে এখন থেকে 'মিস্টার' বলে সম্বোধন করতে হবে? বুফনের টুইট, 'এখন থেকে তাহলে তোমাকে “মিস্টার” সম্বোধন করতে হবে!?!?! আন্দ্রেয়া, নতুন চ্যালেঞ্জে শুভ কামনা রইল।'
পেশাদার ফুটবলে গুরু-শিষ্যের মধ্যে অলিখিত সব নিয়ম মানতেই হয়। শিথিলতা যে নেই তাও নয়। বুফনের প্রশ্নের জবাবটা তাই এখন দিতে হবে পিরলোকে। সেটি কীভাবে দেবেন তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত পিরলোর কিন্তু ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ার কথা। তিন বছর আগে খেলা ছাড়ার পর কোচিং শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পিরলো। সপ্তাহখানেক আগে প্রথম দায়িত্বটা পেয়েছিলেন জুভেন্টাস অনূর্ধ্ব-২৩ দলের। সেখান থেকে ভোজবাজির মতো তাঁকে তুলে এনে কাঁধে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে জুভেন্টাস।
এই আশ্চর্য প্রাপ্তির ওজন সামলানোর মতো ক্ষমতা পিরলোর নিশ্চয়ই আছে। তবু যেহেতু কোচিং অভিজ্ঞতা নেই তাই শুরুটা কঠিন হয়ে ওঠার কথা। আর সমস্যায় পড়লে বন্ধু তো আছেই। মাঠে অভিজ্ঞতা ও সাফল্যে বুফন কোথাও তাঁর চেয়ে পিছিয়ে নেই। বরং ক্যারিয়ারের বয়স বিচারে এগিয়ে। তাই টোকা মারতে দোষ কী! দৈনন্দিন অনুশীলনে হয়তো তেমন দেখা যাবে না, কিন্তু সবার অগোচরে পিরলো ঠিকই জবাব দেবেন বুফনের টুইটের, বন্ধু কী করি বলো তো!