বিশ্ব ফুটবলে গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাক্য সম্ভবত ‘নেইমারকে কিনতে চায় রিয়াল মাদ্রিদ।’ ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড বারবারই ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের হাত ফসকে বেরিয়ে গেছেন। ২২২ মিলিয়ন ইউরোতে বার্সেলোনা থেকে পিএসজিতে ঠাঁই নিয়েছেন নেইমার। কিন্তু সে দলবদলের মাত্র তিন মাসের মাথায়ও নেইমারকে রিয়ালে আসার আহ্বান জানিয়েছেন পেরেজ। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডকে পাওয়ার সুযোগ পেলে আগামীকালই হয়তো ২৫০ মিলিয়ন খরচ করতে রাজি হয়ে যাবেন পেরেজ, অবস্থাটা এখনো এমন!
রিয়ালে সভাপতিত্বের প্রথম ধাপে দলকে তারকাপুঞ্জ বানিয়ে ফেলেছিলেন পেরেজ। রবার্তো কার্লোস, রাউল, ক্যাসিয়াস, ম্যাকম্যানাম্যান, হিয়েরো, মরিয়েন্তেস, গুতি, সোলারিদের মতো খেলোয়াড় ছিল লস ব্লাঙ্কোসদের। এরপরও দলে এনেছেন লুইস ফিগো, জিনেদিন জিদান, রোনালদো, বেকহাম ও মাইকেল ওয়েনের মতো মহাতারকাদের। কাগজে-কলমে বিশ্বসেরা সে দল মাত্র একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লিগ জিতেছিল।
দ্বিতীয় পর্বে এসেও সে পথে হাটতে চেয়েছিলেন পেরেজ। প্রথম মৌসুমেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, কাকা, জাবি আলোনসো ও করিম বেনজেমাদের হাজির করেছেন। তাদের দেখানো পথে এসেছেন ডি মারিয়া, ওজিল, মদরিচ, টনি ক্রুস, গ্যারেথ বেল ও হামেস রদ্রিগেজরা। বিশেষ করে বেল আর হামেসকে আনতে বেশ খরচ করতে হয়েছে পেরেজকে, বেলের জন্য ১০১ মিলিয়ন ও হামেসের জন্য ৮০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছেন তিনি। এবারেও সাফল্যের কলামে শুধু একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ও একটি লা লিগা।
নেইমার আর এমবাপ্পেদের পিছু ধাওয়া করতে করতেই নতুন এক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন পেরেজ। সে প্রক্রিয়ার নতুন সংযোজন ব্রাহিম ডিয়াজ। স্প্যানিশ পত্রপত্রিকার কথা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তবে জানুয়ারিতেই রিয়াল আসছেন এই উইঙ্গার। ১৯ বছর বয়সী এই ফুটবলারের জন্য ১৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করবে রিয়াল। মৌসুমে মাত্র ২০৪ মিনিট মাঠে থাকা এক ফুটবলারের জন্য অঙ্কটা বড়। আবার রিয়ালের ইদানীংকালের দলবদলের কথা চিন্তা করলে এ কিছুই নয়। তরুণ প্রতিভা পেলেই যে উদারহস্তে খরচ করছে এ ক্লাব, এমনকি দর-কষাকষিতেও যাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রিলিজ ক্লজ দিয়েই আনা হচ্ছে তাদের। ভবিষ্যৎ ‘নেইমার’ যেন কোনোভাবেই হাতছাড়া না হয় সে ব্যবস্থা।
২০১৪ সালে হামেসকে কেনার সময়ই আরেক মিডফিল্ডার হাজির হয়েছিলেন রিয়ালে। ব্রাজিলে বিস্মৃতপ্রায় প্রজাতির এক ফুটবলার খুঁজে পাওয়া গেছে শুনেই হাজির হয়েছিল রিয়াল। উইঙ্গার আর উইংব্যাকে ভর্তি দেশে অবশেষে দেখা মিলেছিল এক মিডফিল্ড জেনারেলের। ২১ বছর বয়সী লুকাস সিলভাকে নিতে ১৪ মিলিয়ন খরচ করেছিল রিয়াল। মাত্রই আলোনসোকে বিক্রি করে দেওয়া রিয়াল নতুন ‘আলোনসো’ পাওয়ার জন্য অঙ্কটা কমই ভেবেছিল। ক্রুজেইরো থেকে আসা সিলভা চার বছর পর সেই ক্রুজেইরোতেই আছেন। হৃদ্যন্ত্রের সমস্যার পর ফর্ম হারিয়ে ফেলার পর এখন ব্রাজিলেই আছেন সিলভা। রিয়ালে ফেরার সম্ভাবনা দিন দিন কমছে তাঁর।
২০১৪ এর শেষভাগেই আরেকটি দলবদল করেছিল রিয়াল। বিশ্বে তোলপাড় ফেলা ১৫ বছরের ড্যানিশ তরুণ মার্টিন ওডেগার্ডকে নিয়েছিল দলে। সেটাও ২.৩ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে। খেলোয়াড়ের পরিবারকে চুক্তি স্বাক্ষরের উপহার হিসেবে বাড়তি কয়েক মিলিয়ন ইউরোও দিয়েছিল রিয়াল। ভবিষ্যতের তারকাকে দলে আনার এ চেষ্টার ফল যদিও এখনো পায়নি তারা। ২০ বছর বয়সে এসেও ডাচ এক ক্লাবে ধারে খেলছেন ওডেগার্ড। বার্নাব্যু আলোকিত করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি, কিন্তু এতে বাজি ধরার লোক খুব কম।
রিয়াল তবু কেন এ প্রক্রিয়া চালু রেখেছে? কারণ, মার্কো অ্যাসেনসিও। ওডেগার্ড ও সিলভাকে দলে নেওয়ার মাঝেই রিয়াল কিনে নিয়েছে এই মায়োর্কানকে। ৩.৯ মিলিয়ন ইউরোর সে খেলোয়াড় এরই মাঝে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। ইউরোপের দুটি ফাইনালে গোল করার কীর্তি হয়ে গেছে তাঁর। ভবিষ্যৎ ব্যালন ডি’অর জয়ী হিসেবে কদিন আগেও জোরেশোরে তাঁর নাম উচ্চারিত হতো। গুঞ্জন আছে এক মৌসুম আগেই তাঁকে কিনতে ১৫০ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাব দিয়েছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই ক্লাব, অন্তত খেলোয়াড়ের এজেন্টের ভাষ্য অনুযায়ী। এক অ্যাসেনসিও রিয়ালকে ওডেগার্ড-সিলভার কথা ভুলিয়ে দিচ্ছে।
এরই পথ ধরে রিয়ালে হাজির হয়েছেন থিও হার্নান্দেজ, জেসুস ভায়েহো, দানি সেবায়োস, আলভারো ওদ্রিওসোলা, ফেডরিকো ভালভার্দে, আন্দ্রিয়া লুনিন। এদের সবার মধ্যে একটাই মিল, সবার বয়স বিশের এদিক না হলে ওদিক। এদের সঙ্গে আরও দুটি নাম যোগ করে নিতে হচ্ছে একটু আলাদা করে—ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও রদ্রিগো গোয়েস। সান্তোসে খেলা রদ্রিগোর বয়স এখনো ১৮ ছোঁয়নি। এর মাঝেই ২০১৮ কোপা ট্রফিতে (অনূর্ধ্ব-২১ ব্যালন ডি’অর) চতুর্থ হয়েছেন । ১৭ বছরের রদ্রিগোর জন্য রিয়াল ৪০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে।
রদ্রিগো তবু সান্তোসের হয়ে মাঠে নেমে রিয়ালের নজরে পড়েছেন। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করার আগেই রিয়ালে নাম লিখিয়েছেন। ফ্ল্যামেঙ্গোর বয়স ভিত্তিক দলে খেলেই এতটাই নাম কামিয়েছিলেন যে ৪৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছে রিয়াল। দেড় বছর পর মাদ্রিদে হাজির হয়েছেন। এরই মাঝে রিয়ালের হয়ে দুটি গোলও পেয়ে গেছেন এই ব্রাজিলিয়ান। ১৭ বছরের দুই কিশোরের জন্য রিয়ালের এত খরচের কারণ? এদের দুজনকেই যে ‘ভবিষ্যৎ নেইমার’ বলা হচ্ছে ব্রাজিলে।
এভাবেই গত চার বছরে তরুণ ফুটবলারের পেছনে ২০২.২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে রিয়াল। ব্রাহিম ডিয়াজকে যদি পেপ গার্দিওলার হাত থেকে ছিনিয়ে আনতেই পারে তবে সেটা দাঁড়াবে ২১৭.২ মিলিয়নে। ১২ জন খেলোয়াড়ের জন্য এই অর্থ ব্যয় করেছে রিয়াল। পিএসজি যেখানে শুধু নেইমারের জন্যই খরচ করেছে ২২২ মিলিয়ন ইউরো। রিয়ালের এই দলবদলগুলোর মাঝে বেশ কিছু ব্যর্থতা আছে। ভায়েহো কিংবা থিওরা হয়তো সিলভার মতোই পথ হারাতে বসেছেন। কিন্তু অ্যাসেনসিও, সেবায়োস কিংবা ভালভার্দেদের অভিজ্ঞতা ফুটবলের সঙ্গে আর্থিক লাভেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রিয়ালের অনভিজ্ঞ কিন্তু প্রতিভাবান কেনার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি ফল আনতে পারে কি না সেটা দেখার অপেক্ষায় সবাই। না হলে পেরেজকে তাঁর প্রিয় তারকা কেনার নীতিতেই ফিরতে হবে। নেইমার, এমবাপ্পে, হ্যাজার্ডদের দিকে এমনিতেও তো কদিন পর পরই তো নজর দিচ্ছেন এই সভাপতি।
খেলোয়াড় | দেশ | পজিশন | দলবদল |
ভিনিসিয়ুস | ব্রাজিল | ফরোয়ার্ড | ৪৫ মিলিয়ন |
রদ্রিগো* | ব্রাজিল | ফরোয়ার্ড | ৪০ মিলিয়ন |
ওদ্রিওসোলা | স্পেন | ফুলব্যাক | ৩০ মিলিয়ন |
থিও* | ফ্রান্স/স্পেন | ফুলব্যাক | ২৭ মিলিয়ন |
সেবায়োস | স্পেন | মিডফিল্ডার | ১৬.৫ মিলিয়ন |
সিলভা* | ব্রাজিল | মিডফিল্ডার | ১৪ মিলিয়ন |
লুনিন* | ইউক্রেন | গোলরক্ষক | ১৩.৫ মিলিয়ন |
ভায়েহো | স্পেন | রক্ষণ | ৫ মিলিয়ন |
ভালভার্দে | উরুগুয়ে | মিডফিল্ডার | ৫ মিলিয়ন |
অ্যাসেনসিও | স্পেন | উইঙ্গার | ৩.৯ মিলিয়ন |
ওডেগার্ড* | নরওয়ে | মিডফিল্ডার | ২.৩ মিলিয়ন |
ডিয়াজ# | স্পেন | উইঙ্গার | ১৫ মিলিয়ন |
# এখনো দলবদল হয়নি | |||
* ধারে অন্য ক্লাবে |