>আর্জেন্টিনা কি ক্রিকেটের ওয়েস্ট ইন্ডিজ? ব্যাপার তো অনেকটা তা-ই! ব্রায়ান লারা যেমন ছিলেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের মুকুটহীন সম্রাট, মেসি তেমনই।
আর্জেন্টাইন ফুটবলের সৌরভ কি তাহলে ফুরিয়ে যাচ্ছে?
গুইলার্মো স্তাবিল, মারিও কেম্পেসের পর সেই সৌরভ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। মোহগ্রস্ত হয়েছিল গোটা ফুটবল বিশ্ব। ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্রে শেষ বিশ্বকাপ খেললেন ম্যারাডোনা। দীর্ঘ এক যুগ পর এলেন ম্যারাডোনার ‘সবচেয়ে যোগ্য’ উত্তরসূরি। সবচেয়ে যোগ্য বলার কারণ মাঝের এই সময়ে ন্যূনতম হাফ ডজন ‘নতুন ম্যারাডোনা’ এসেছেন। কেউ টিকতে পারেননি। মেসি এখনো টিকে আছেন। কিন্তু আকাশি-সাদা জার্সিতে ম্যারাডোনার মতো সৌরভ ছড়াতে পারছেন কোথায়!
আর্জেন্টিনা দল যে পুরোপুরি মেসিকেন্দ্রিক, তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে যখন ব্রায়ান লারা ছিলেন অনেকটাই সেই সময়ের মতো। উইকেটে লারা নেই তো মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজও নেই! একই রকমভাবে মেসি রং ছড়াতে না পারলে আর্জেন্টিনাও সাদামাটা। লারা থাকতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের রাজত্ব অস্তগামী ছিল। যেমনটা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের শেষ ‘কাগুজে’ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সময়। তবে লারা যেমন ‘কাগুজে বাঘ’ নন, তেমনি মেসিও কোনো খেলো তারকা নন। কিন্তু মিলটা হলো লারার চোখের সামনেই ক্রিকেটে তাঁর দেশের বৈশ্বিক রাজত্বের অবসান ঘটেছে। আর মেসির ক্ষেত্রে তা হতে চলেছে।
হ্যাঁ, এই অবনতি এখনো প্রকাশ্য না হলেও চোরাস্রোত তো বইছেই। সাম্প্রতিক অতীত থেকে শুরু করা যায়। গত এক বছরের মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে অপেক্ষাকৃত নিচের দলের সঙ্গে খাবি খেয়েছে আর্জেন্টিনা। এবারের বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব স্মরণ করে দেখুন। ইকুয়েডরের বিপক্ষে বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে মেসি হ্যাটট্রিক না করলে কাল হয়তো ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হতো অন্য কোনো দল। এখানেই শেষ নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের মতো আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নিয়েও রয়েছে এন্তার দুর্নীতির অভিযোগ। মেসিদের এই ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ হিসেবে যোগ হয়েছে দেশটির চরম অর্থনৈতিক মন্দা। এ যেন ফুটবলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ!
প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে? আর্জেন্টিনা তো গত বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে! সর্বশেষ দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনালেও উঠেছে। কিন্তু শিরোপা কি জিততে পেরেছে? আর্জেন্টিনা সর্বশেষ কবে বড় কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছে, তা খুঁজে বের করতে হলে এই একবিংশ শতাব্দীতে থাকলে চলবে না। ১৯৯৩ সালে কোপা জিতেছিলেন বাতিস্তুতা-ক্যানিজিয়ারা। সেটাই সর্বশেষ সাফল্য।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এর মাঝে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে। কিন্তু ক্রিকেটের বিশ্বকাপ বলতে লোকে এখনো ওয়ানডে বিশ্বকাপকেই বুঝে থাকে। যেখানে ভিভ রিচার্ডসরা সর্বশেষ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন ১৯৮৩ সালে। তারপর থেকে খরা চলছেই। একইভাবে বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনাকে দেখুন—সত্তর দশকের শেষ ভাগ থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুর্দান্ত দাপট দেখিয়েছে তারা। এর মধ্যে শিরোপা জিতেছে দুবার (১৯৭৮ ও ১৯৮৬)। ক্যারিবীয় ক্রিকেটও বিশ্বকাপ (ওয়ানডে) জিতেছে দুবার।
কাকতালীয় ব্যাপার হলো, সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও দাপট ছিল। সোবার্সরা শুরু করার পর থেকে ক্লাইভ লয়েড থেকে মাইকেল হোল্ডিং, ম্যালকম মার্শাল, আলভিন কালিচরণ, কোর্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ; এমনি আরও কত সব নাম! ঠিক একই সময়ে প্রতিভায় ভাস্বর হয়েছে আর্জেন্টাইন ফুটবলও—কেম্পেস, ভালদানো, বুরুচাগা, ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতা, ওর্তেগা, ক্লদিও লোপেজ...ও ম্যারাডোনা। আর এখন মেসি। তিনি একাই, আর কেউ নেই!
মূল সমস্যাটা আর কেউ না থাকাতেই। একটা সময় ছিল যখন বয়সভিত্তিক বড় টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার একাধিপত্য ছিল। আর এখন সেই একই মঞ্চের চূড়ান্তপর্বে আর্জেন্টাইনদের খুঁজে পাওয়াই দায়! নতুন প্রতিভা উঠে আসার রাস্তাটাও তাই ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। ক্যারিবীয় ক্রিকেটে যেভাবে অ্যামব্রোস-ওয়ালশ কিংবা লারা-হুপারদের প্রজন্ম শেষে সেভাবে আর কেউ উঠে আসেনি। আর তাই ক্রিকেটের বয়োবৃদ্ধ ভক্তরা আজও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেই পুরোনো সময়কে মনে মনে ধন্যবাদ জানান, দারুণ কিছু স্মৃতি উপহার দেওয়ার জন্য।
ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারের ব্যবধান হিসাব করলে বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে দীর্ঘ ৬০ বছর পর এত বড় ব্যবধানে হারল আর্জেন্টিনা। আর গত ৪৮ বছরে এই প্রথম বিশ্বকাপ গ্রুপপর্বের প্রথম দুই ম্যাচের অন্তত একটি জিততে ব্যর্থ হলো লাতিন দলটি। এই সংকট আর্জেন্টাইন ফুটবলের ‘নস্টালজিক’ সমর্থকদের শুধু ম্যারাডোনা-ক্যানিজিয়াদেরই মনে করিয়ে দেয় আর অজান্তেই বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস—ধন্যবাদ, আর্জেন্টিনা। দারুণ কিছু স্মৃতি উপহার দেওয়ার জন্য!