বহুদিন পর জমজমাট এক প্রিমিয়ার লিগ দেখল দেশের ফুটবল। মানসম্পন্ন কিছু বিদেশি খেলোয়াড় ও দেশি তরুণদের দুর্দান্ত উপস্থিতি প্রিমিয়ার লিগের খেলার মান এবার অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন দল হিসেবে বসুন্ধরা কিংস সবাইকে চমকে দিয়েছে, তারুণ্যনির্ভর আরামবাগের উত্থান দেখা গেছে। মোহামেডানের মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত দলকে হোঁচট খেতে দেখা গেছে।
দুর্দান্ত সব গোল আর নানা আলোচনার জন্ম দেওয়া এই প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে যদি কোনো আক্ষেপ থেকে থাকে সেটা হলো দেশি ফুটবলারদের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এবারও গোলের জন্য বিদেশিদের দিকেই তাকিয়ে ছিল দলগুলো। এবারের লিগে ৪২৯টি গোল উদ্যাপন করেছেন ফুটবলাররা। এর মধ্যে ২৭১টি গোল করেছেন বিদেশিরা। বাকি ১৫৮টি গোল দেশি ফুটবলারদের। বিদেশিদের সঙ্গে লড়াই করে আলো কেড়েছেন বাংলাদেশের দুই ফুটবলার নাবিব নেওয়াজ ও মতিন মিয়া। আবাহনীর স্ট্রাইকার নাবিবের গোল ১৭টি, বসুন্ধরা কিংসের ফরোয়ার্ড মতিনের ১১টি। কিন্তু এঁদের বাদ দিলে গোল করার পরিসংখ্যানে বরাবরের মতোই পিছিয়ে দেশি ফুটবলাররা।
পেশাদার ফুটবল লিগ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১১টি আসরে বলতে গেলে একই দৃশ্যই মঞ্চস্থ হচ্ছে। লিগ শেষে কোনো না কোনো বিদেশি পাচ্ছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার। এবারও যেমন ২২ গোল করে পুরস্কারটি জিতেছেন শেখ রাসেলের নাইজেরিয়ান ফরোয়ার্ড রাফায়েল। শুধু ২০০৯-১০ মৌসুমটাই ছিল ব্যতিক্রম। বিদেশিদের টপকে সেবার ২১ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জেতেন আবাহনীর স্ট্রাইকার এনামুল হক। এরপর টানা ৯ মৌসুম বিদেশিদের আধিপত্য। নাবিব ও মতিন ছাড়া গোলদাতাদের শীর্ষ দশে কোনো দেশি ফুটবলার নেই। শীর্ষ পনেরোতে আছেন আরও দুজন-মান্নাফ রাব্বি (৮) ও তকলিচ আহমেদ (৭)। শীর্ষ ২০-এও এই চারজনই ছিল বাংলাদেশের পতাকাধারী!
গোলদাতা | দল | গোল |
রাফায়েল ওদোইন (নাইজেরিয়া) | শেখ রাসেল | ২২ |
সানডে সিজোবা (নাইজেরিয়া) | ঢাকা আবাহনী | ২০ |
নাবিব নেওয়াজ (বাংলাদেশ) | ঢাকা আবাহনী | ১৬ |
মার্কোস ভিনিসিয়ুস (ব্রাজিল) | বসুন্ধরা কিংস | ১৪ |
সিও জুনাপিও(কঙ্গো) | রহমতগঞ্জ | ১৩ |
ইসমাইল বাঙ্গুরা (গিনি) | নোফেল | ১২ |
দানিয়েল কলিন্দ্রেস (কোস্টারিকা) | বসুন্ধরা কিংস | ১১ |
দেইনের করদোবা (কলম্বিয়া) | সাইফ স্পোর্টিং | ১১ |
বালো ফামুসা (আইভরি কোস্ট) | মুক্তিযোদ্ধা | ১১ |
মতিন মিয়া (বাংলাদেশ) | বসুন্ধরা কিংস | ১১ |
গোল করাটাই সব সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গোলদাতার তালিকার শীর্ষ তিনে চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরার কারও নাম না থাকা সেটারই ইঙ্গিত দেয়। বরং সবাই দল হিসেবে খেলে যদি গোল আদায় করে নেওয়া যায়, তবে সেটিই বেশি ভালো। এবার বসুন্ধরার ফুটবলাররা সেটাই করেছেন। গোল করার চেয়ে সবাই মিলে দলকে গোল এনে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ কারণেই বিশ্বকাপ খেলার কলিন্দ্রেস নিজে যত গোল করেছেন, ঠিক ততটি (১১) গোল করিয়েছেন সতীর্থদের দিয়ে। বল পায়ে অতটা স্বচ্ছন্দ না হয়েও ১০ গোল করতে সহযোগিতা করেছেন ব্রাজিলের মার্কোস ভিনিসিয়ুস। ১০টি এসিস্ট করেছেন দলটির মধ্যমাঠের বখতিয়ার দুশবেকভও। তবে এ তিনজনকেই টপকে গেছেন আরামবাগের ম্যাথু চিনেদু। ১২টি গোলে সহযোগিতা করেছেন নাইজেরিয়ার এই খেলোয়াড়।
বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ দেখা যাচ্ছে খেলার এ দিকটাতেও। শীর্ষ গোলদাতাদের শীর্ষ পাঁচে অন্তত একজন বাংলাদেশি থাকলেও গোল বানিয়ে দেওয়ার কাজে সেরকম দক্ষতা দেখাতে পারেননি কেউ। পাঁচে থাকা বেলফোর্টের চেয়ে তিন ব্যবধানে ছয়ে আছেন নাবিব (৬)। শীর্ষ দশে নেই আর কেউ। চারটি করে এসিস্ট করে শীর্ষ বিশে অবশ্য আছেন পাঁচজন। স্বস্তির বিষয় শীর্ষ পনেরোতে থাকা ইয়াসির আরাফাত, বিপলু আহমেদ ও খন্দকার আশরাফ—এরা সবাই বাংলাদেশের বিভিন্ন যুব দলের সদস্য। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়।
গোলে সহায়তা করায় এগিয়ে যারা:
ফুটবলার | দল | এসিস্ট |
ম্যাথু চিনেদু (নাইজেরিয়া) | আরামবাগ | ১২ |
দানিয়েল কলিন্দ্রেস (কোস্টারিকা) | বসুন্ধরা কিংস | ১১ |
মার্কোস ভিনিসিয়ুস (ব্রাজিল) | বসুন্ধরা কিংস | ১০ |
বখতিয়ার দুশবেকভ (কিরগিজস্তান) | বসুন্ধরা কিংস | ১০ |
কেরভেন্স বেলফোর্ট (হাইতি) | ঢাকা আবাহনী | ৯ |
নাবিব নেওয়াজ (বাংলাদেশ) | ঢাকা আবাহনী | ৬ |
ল্যান্ডিং ডারবো (গাম্বিয়া) | রহমতগঞ্জ | ৫ |
সোলিমান ডিয়াবাতে (মালি) | মোহামেডান | ৫ |
সোলোমন কিং (গাম্বিয়া) | শেখ জামাল | ৫ |
সানডে সিজোবা (নাইজেরিয়া) | ঢাকা আবাহনী | ৫ |
রাফায়েল ওদোইন (নাইজেরিয়া) | শেখ রাসেল | ৫ |
গোল করে ও করিয়ে দলের প্রাণভোমরা বনায় এবার কলিন্দ্রেসের জুড়ি ছিল না। ২২ গোলে অবদান রেখে লিগের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন কোস্টারিকার হয়ে বিশ্বকাপ খেলা এই ফরোয়ার্ড। শুধু পরিসংখ্যানকে মাথায় রাখলে তাঁর চেয়েও ভালো খেলোয়াড় এবার আরও তিনজন ছিলেন গোল বেশি করে অবদান রাখায় তাঁকে টপকে গেছেন দুই নাইজেরিয়ান ওদোইন (২৭), সানডে (২৫) ও ক্লাব সতীর্থ ভিনিসিয়ুস (২৪)। এমনকি বাংলাদেশের নাবিবও ২২ গোলে অবদান রেখে তাঁর পাশে আছেন। কিন্তু পরিসংখ্যান দিয়ে যে ফুটবলের বিচার হয় না সেটা তো সবাই জানেন। এবারের লিগের সেরা উদীয়মান রবিউলেরই যেমন গোল মাত্র দুটি। তাঁর চেয়ে গোল ও এসিস্টে বহু এগিয়ে চিনেদু। নাইজেরিয়ার এই ফরোয়ার্ড ১২ এসিস্টের পাশে ৭ গোল করেছেন। কিন্তু শেষ দিকে আরামবাগের ম্যাচগুলোতে দেখা না পাওয়া রবিউলই যে দলটির সেরা খেলোয়াড় ছিলেন এটাও তো সবার জানা।