>গ্রানিত শাকা আর জেরদান শাকিরির দুই গোলে প্রথমে পিছিয়ে পড়েও পরে সার্বিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছে সুইজারল্যান্ড। সুইজারল্যান্ডের এই দুই গোলের পেছনে আছে অন্য ইতিহাস।
যুগোস্লাভিয়ার জাতিগত দাঙ্গায় কত হাজার–নিযুত শরণার্থী যে মাতৃভূমি ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন তার হিসাব নেই। দেশদ্রোহী হওয়ার অপরাধে কসোভো ও আলবেনিয়ার অগুনতি মানুষকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হতো সার্বিয়ার কারাগারগুলোতে।
নব্বই দশকের শেষ দিকে যুগোস্লাভিয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনে আর দশজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের মতো মতো রাগিপ শাকাও যোগ দিয়েছিলেন। বাইশ বছর বয়সী সদ্য বিবাহিত রাগিপ শাকা তখন তারুণ্যদীপ্ত। উদ্যমী তরুণেরা যে চাইলেই ইতিহাস বদলে দিতে পারেন, সে ব্যাপারে ভালোই ধারণা ছিল যুগোস্লাভ সরকারের। তারা দমননীতির আশ্রয় নিল। সেই দমননীতিতে পিষ্ট করার চেষ্টা করা হলো রাগিপ শাকার মতো আন্দোলনকারী সব তরুণকে। সার্বিয়ার এক জেলে বন্দী হলেন শাকা।
ছাড়তে হবে দেশ। নিজের আর নিজের পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কথা চিন্তা করে নিজের দেশপ্রেমের আর্তিকে দমিয়েই দেশ ছাড়লেন রাগিপ। স্ত্রী এলমাজকে নিয়ে পাড়ি জমালেন সুইজারল্যান্ডে, যুদ্ধ শুরুর আগেই।
নামের শেষ অংশ দেখেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন আগেই, গ্রানিত শাকার বাবার জীবন সম্পর্কেই বলা হচ্ছে এখানে। নিজের দেশ থেকে উৎখাত হওয়া রাগিপ আর এলমাজ সুইজারল্যান্ডেই সবকিছু ভুলে নিজেদের জীবন নতুন করে শুরু করতে চাইলেন। তত দিনে ঘর আলো করে চলে এসেছে দুই সন্তান—তলান্ত ও গ্রানিত।
জেরদান শাকিরির কাহিনিটাও ভিন্ন কিছু নয়। জন্ম কসোভোতে হলেও জাতিগত বিদ্বেষের দাঙ্গার হাত থেকে পরিবারকে বাঁচাতে শাকিরির বাবা-মা চলে এসেছিলেন এই সুইজারল্যান্ডেই।
এই এক বিন্দুতেই মিলে গিয়েছিলেন শাকা-শাকিরি। কাল যেমন আবারও আরেক বিন্দুতে মিলে গেলেন এই দুজন। ‘চিরবৈরী’ সার্বিয়ার বিপক্ষে গোল করে ছিনিয়ে আনলেন অমূল্য এক জয়, ফুটবল মাঠেই প্রমাণ করলেন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব। সঙ্গে নিজেদের উদযাপনে এনেছিলেন আলবেনিয়ান জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক ইগলের ছোঁয়া, দুই হাত উল্টে বুকের কাছে এনে ‘ক্রস’ বানিয়ে ইগলের ডানার মতো করে শাকা-শাকিরি যেন নিঃশব্দেই প্রমাণ করেছিলেন কালকে, সুইজারল্যান্ড তাঁদের নতুন জীবন দান করলেও, এই জীবনের সূচনা কিন্তু হয়েছিল আলবেনিয়া-কসোভোতেই!
নিজেদের কসোভো-আলবেনিয়ান পরিচয়ের শিকড়টা কখনোই ভুলতে পারেন না শাকা-শাকিরিরা। যে কারণে প্রায় সময়ই দেশের মানুষের কাছ থেকে শুনতে হয় ‘যথেষ্ট দেশপ্রেমী নয়’ এই খোঁটাও! গ্রানিতের ভাই তলান্ত তো আবার এক কাঠি সরেস, এই ‘দ্বৈত’ জাতীয়তাবাদের ঝামেলা এড়াতেই নিজের জন্মস্থানকেই বেছে নিয়েছেন তিনি, সুইজারল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলগুলোতে ফুটবলের পাঠ নিলেও এখন আলবেনিয়ার মূল দলের খেলোয়াড় হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি! তবে সুইসরাও জানে, নিজেদের দলের প্রায় অধিকাংশ খেলোয়াড়ের সঙ্গেই এমন জুড়ে আছে শরণার্থীর পরিচয়টা। অধিকাংশ খেলোয়াড়েরই টান আছে কসোভো-আলবেনিয়ার প্রতি, তাই এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়িও করে না তেমন তারা।
ম্যাচ শেষে নিজের উদ্যাপন সম্পর্কে মুখ খোলেননি শাকা-শাকিরিরা, কিন্তু প্রতিবার সার্বিয়ার বিপক্ষে গোল করার পর তাঁদের হৃদয় যেভাবে উন্মুক্ত হয়ে কসোভো-আলবেনিয়ার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে, সেই ভালোবাসায় কীভাবে বাঁধ দেবেন তাঁরা?