দাসপ্রথা ফিরিয়ে আনছে ফুটবল

আফ্রিকান তরুণ খেলোয়াড়দের প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয় ইউরোপে। ছবি সংগৃহীত।
আফ্রিকান তরুণ খেলোয়াড়দের প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয় ইউরোপে। ছবি সংগৃহীত।

কয়েক বছর আগে বার্সা-রিয়ালের দলবদলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ফিফা। অনেকের কাছেই অদ্ভুত ঠেকেছিল নিষেধাজ্ঞার কারণ। নিয়মবহির্ভূতভাবে ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড় কেনার অভিযোগ ছিল বিশ্বসেরা দুই ক্লাবের ওপর। অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল, কম বয়সী খেলোয়াড় কেনার কারণে কেন দলবদলের মৌসুম থেকে নিষিদ্ধ করা হবে? ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে ১৮ বছরের কম বয়সী খেলোয়াড় কেনাও কি দোষের? না তা দোষের নয়, তবে ফিফার এই নিয়মের পেছনে রয়েছে এক মহতী উদ্যোগ। ‘মডার্ন ফুটবল ট্র্যাফিকিং’ প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে যাচ্ছে লাখো আফ্রিকান শিশু-কিশোরের জীবন।

আফ্রিকার অর্থনৈতিক অবস্থা বরাবরই নিদারুণ। দারিদ্র্যের কারণে প্রায় সবারই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। বেঁচে থাকার জন্য দাস হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিল আফ্রিকানরা। কর্মঠ হওয়ায় কম মূল্যে আফ্রিকা থেকে দাস খাটিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা। শেষ পর্যন্ত বিংশ শতকের মাঝামাঝি দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে আড়ালে আবডালে চলা প্রথার নতুন পদ্ধতি হলো ফুটবল!

অবাক হলেও সত্যি, যে ফুটবল আমাদের আনন্দে ভাসায়, মুখে এনে দেয় হাসি; সেই খেলাই হয়ে উঠেছে এই দাস প্রথার গোপন অস্ত্র। ফুটবলকে ব্যবহার করা হচ্ছে স্বার্থ হাসিলে। আফ্রিকানদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে কম বেতনে বেশি খাটানোর ইচ্ছা কমেনি লোভীদের। আর সেই পথটা হলো ফুটবল ক্লাব।

২০০৭ সাল, টেরিনফে সমুদ্রসৈকত। নৌকাভর্তি এক দল আফ্রিকান অধিবাসীর দেখা মিলল সেখানে। ১৫ জনের সেই দলটির লক্ষ্য ফুটবল ক্লাবে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করা। প্রত্যেকেরই বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছর। দলের নাম শুনে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা, মায়োর্কা ও রিয়াল মাদ্রিদ। এ তো একটি ছোট্ট ঘটনা। এ রকম হাজারো ছোট ছোট ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে স্পেন, ফ্রান্স ও ইতালির সমুদ্রসৈকতে।

বহু আফ্রিকান তরুণের স্বপ্ন দ্রগবা-ইতোর মতো হওয়ার। ছবি: টুইটার

আফ্রিকায় বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন থাকে ফুটবলকে ঘিরে। কেউ স্বপ্ন দেখে দ্রগবা-ইতোর মতো স্ট্রাইকার হওয়ার, কেউ স্বপ্ন দেখে ইয়াইয়া তোরের মতো মাঝমাঠ সামলানোর। তখন তাদের সামনে ‘দেবদূত’-এর ভেক ধরে হাজির হন এজেন্টরা। তাদের খেলা দেখে ইউরোপের বড় ক্লাবে ট্রায়াল দেওয়ানোর সুযোগ দেখান তাঁরা। ভাগ্য পাল্টাতে তাই এজেন্টের হাত ধরে ইউরোপের পথ ধরে আফ্রিকার শিশু-কিশোররা।

এই এজেন্টরাই মূল ফাঁদ, নামমাত্র কিছু অর্থ মা-বাবার হাতে দিয়ে শিশু-কিশোরদের উঠিয়ে দেওয়া হয় ইউরোপের নৌকায়। কিন্তু ইউরোপে এসে ভাগ্য পাল্টানোর পথ ফুটবল মাঠে নয়, বেঁকে যায় কোনো কলকারখানায়। কলকারখানার শিল্পপতিরাও মানব পাচারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। কোনো না কোনো ক্লাবের সঙ্গে ওঠাবসা থাকেই। ক্লাবের একাংশ বা গভর্নিং বডির অংশও হন অনেকে। এই সুযোগে দলের নাম ভাঙিয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা হয়। এরপর কম পয়সায় এসব কচিকাঁচাকে দিয়েই করিয়ে নেওয়া হয় শিল্পকারখানার কঠিন সব কাজ। আর তাতে শুরুতেই ফুটবলের সবুজ স্বপ্ন ঝরে যায় মৃত পাতার মতো।

২০০৫ থেকে ২০১৪—এই ৯ বছরে ফ্রান্সের উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া ৭ হাজার আফ্রিকান শিশুর খোঁজ মেলেনি এখনো। কেউ জানে না কী ঘটেছে সেসব শিশুর কপালে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানো এসব শিশু ফুটবলার হওয়ার বদলে কোথায় হারিয়েছে, কে জানে! বড় বড় ক্লাবে খেলানোর লোভ দেখিয়ে মা-বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসা এসব শিশুকে আদৌ চেনেও না এসব ক্লাব।

পরিসংখ্যান চোখে পড়তে সময় নেয়নি ফিফার। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এসব শিশুকে বাঁচানোর জন্য। ‘মোর দ্যান আ গেম’ স্লোগানের ফুটবল নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য খড়্গ বসায় দলবদলের ওপর। নতুন আইনের সূচনা করেন ফুটবলের হর্তাকর্তারা, ‘মডার্ন ফুটবল ট্র্যাফিকিং’। ফিফার ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে সরাসরি কেনা যাবে না।

নিয়মের কারণেই ভিনিসিয়ুসকে কিনে দুই বছর সাবেক দলে ধারে রাখতে হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদকে। ছবি: এএফপি

অনূর্ধ্ব-১৮ খেলোয়াড় কিনে বেশ ভালো লাভ করে দলগুলো। কম বয়সে উঠতি ছেলেদের কিনে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে চায় অনেকে। আর তাই বেশির ভাগ দলই নারাজ হয় ফিফার নিয়মে। কিন্তু ফিফা আরও অতিরিক্ত কিছু ধারা সংযোজন করে এই নিয়মে। খেলোয়াড়ের সঙ্গে যদি তার পরিবারকেও আনা হয়, তবেই সেই খেলোয়াড়কে কেনা যাবে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশের খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করেই কেনা যাবে খেলোয়াড়। তবে খেলোয়াড়ের পড়াশোনা ও ফুটবল অনুশীলনের ব্যবস্থা করা এবং যথাযথ রেকর্ড না থাকলে ব্যবস্থা নিতে পারবে ফিফা।

ফিফার এই নিয়ম বেশ ভালো বাধাই দিয়েছে মানব পাচারে। এ কারণে আফ্রিকা থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে খেলোয়াড় কিনতে পারে না কেউ। এজেন্ট সেজে গেলেও তাঁকে ক্লাবের সম্পূর্ণ কাগজপত্র দেখিয়ে নিশ্চিত করতে হবে দলবদল। নিয়মবহির্ভূত কেনাকাটার ওপর বেশ বড় খড়্গ চাপিয়েছে এই নিয়ম। নিয়ম না মেনে খেলোয়াড় কেনায় রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা আর চেলসির ক্লাব নিষিদ্ধ হয়েছে দলবদলের মৌসুমে। ইংলিশ ক্লাবটি তার সবশেষ উদাহরণ। তবে বাঁচার উপায়ও বের করেছে দলগুলো। খেলোয়াড় কিনে আগের দলে ধারে দিয়ে রাখা হয়। তাতে খেলোয়াড়েরও পরিপূর্ণ বিকাশ হয়, সঙ্গে সঙ্গে নিয়মও ভাঙা হয় না। ১৮ বছর হওয়ার পর তাঁদের আনা হয় দলে। যেমনটি ঘটেছে রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান তারকা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের ক্ষেত্রে, ভবিষ্যতে রদ্রিগোর ক্ষেত্রেও হবে।

আপনি যখন এই লেখাটি পড়ছেন, তখন হয়তো আফ্রিকার এক কোণে এজেন্ট স্বপ্ন দেখাচ্ছে কোনো শিশু-কিশোরকে; ইউরোপের বড় ক্লাবের জার্সি গায়ে বিশ্বজয়ের। তাকে সুযোগ করে দিতে চাইছে বড় কোনো দলে। ট্রায়াল দেওয়ার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হবে ইউরোপ, সেই গল্প ফাঁদছে। এই ফাঁদে পা দেওয়ার আগে ভাবছেও না সেই তরুণ। নিয়মের বেড়াজালে হয়তো দলগুলো আটকানো গেছে, বাড়ানো হয়েছে সতর্কতা; কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এই ‘দাসপ্রথা’।