স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কাছে এটা ‘বিশ্বকাপের চেয়েও বড়’ টুর্নামেন্ট। জোসে মরিনিওর কাছে বিশ্বকাপের চেয়েও আনন্দময়। রোনালদো নাজারিও-জিয়ানলুইজি বুফন-জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের কাছে আবার এ এক চির আক্ষেপের নাম। পেপ গার্দিওলা অবশ্য এখন বলেন, এর চেয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জেতা কঠিন। শুনে সমালোচকেরা বলেন, আঙুর ফল নাকি টক লাগছে গার্দিওলার! বার্সা ছেড়ে আসার পর ১১ বছর ধরে যে এই ট্রফির জন্য সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে (পড়ুন জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে) ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাতালান কোচ! জিনেদিন জিদানের কাছে আবার এটা টক লাগার কোনো কারণই নেই, বরং তাঁর কাছে এটা সম্ভবত ‘মধু’র অন্য নাম। তিনি মাঠে থাকতেও জিতেছেন, ডাগআউটে দাঁড়িয়ে জিতেছেন আরও বেশি। আনন্দ-বেদনা-টক-মিষ্টি এই টুর্নামেন্টের নাম—চ্যাম্পিয়নস লিগ।২৮ মে প্যারিসে সেই চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের ফাইনালে মুখোমুখি রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। ভালোবাসার শহর কাকে বরমাল্য দেয়, সেটা জানতে এখন সবার অধীর অপেক্ষা। এই ফাইনাল উপলক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিদিন থাকছে বিশেষ আয়োজন। আজ পড়ুন টুর্নামেন্টের চমকপ্রদ সব কীর্তি ও অর্জনের গল্প—
চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল কী? উত্তরের জন্য কান পাতলে মাদ্রিদে এক পাশ থেকে ভেসে আসবে উল্লাসধ্বনি, অন্য পাশ থেকে আক্ষেপ মেশানো দীর্ঘশ্বাস। শোকেসে ১৩টা ট্রফি সাজিয়ে রাখা রিয়াল মাদ্রিদ ১৪ নম্বরটার জন্য নামবে ২৮ মে। আর ওদিকে আতলেতিকোর ড্রেসিংরুমে তিন ফাইনাল থেকে খালি হাতে ফেরার হাহাকার। সবচেয়ে বেশি ফাইনাল খেলে ট্রফিহীন থাকার রেকর্ডটা যে এখন তাদেরই।
আবার অন্য রকম গল্পও আছে। ফাইনাল যাদের কাছে শুধু আনন্দের নাম। নটিংহাম ফরেস্টের কথাই ধরুন। দুইবার ফাইনাল খেলে দুইবারই চ্যাম্পিয়ন! ব্রায়ান ক্লফ নামের এক জাদুকর লিখেছিলেন নটিংহামের সেই গৌরবের গল্প। ক্লফের নামটা অবশ্য একা উচ্চারিত হয় না। পিটার টেলর নামে অসাধারণ এক সহকারী না পেলে ক্লফ ইংলিশ ফুটবলের ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম সেরা কোচ হতে পারতেন কি না, সন্দেহ আছে। দ্বিতীয় বিভাগের একটা দলকে দুজন মিলে ইংলিশ চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছেন, দুবার করেছেন ইউরোপ-সেরা (১৯৭৮-৭৯, ১৯৭৯-৮০)।
দুইবার ফাইনাল খেলে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব আরও একটা ক্লাবের আছে। তবে তাদের সেই গল্পের নায়ক ক্লফের মতো একজন নন, দুজন। ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে পোর্তোকে ট্রফি এনে দিয়েছিলেন আর্তুর জর্জ। ১৭ বছর পর আরও একবার ফাইনালে ওঠা পোর্তোকে ট্রফি এনে দিয়ে ফুটবলের দুনিয়ায় নিজেকে আলাদা করে চিনিয়েছিলেন যিনি, তাঁর নামটা এখন সময়ের সেরা কোচদের তালিকায় ওপরের দিকে লিখতে হয়—জোসে মরিনিও।
একাধিকবার ফাইনালে উঠে শতভাগ সাফল্যের রেকর্ড শুধু এই দুই ক্লাবেরই। তবে একবারই ফাইনাল খেলে শিরোপা জেতার স্বাদ পেয়েছে আরও চারটি ক্লাব—ফেইনুর্দ (১৯৭০), অ্যাস্টন ভিলা (১৯৮২), পিএসভি আইন্দহফেন (১৯৮৮) ও রেড স্টার বেলগ্রেড (১৯৯১)। শতভাগ সাফল্যের রেকর্ডধারী এই ৬টি ক্লাবের মধ্যে নটিংহাম ও অ্যাস্টন ভিলা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টুর্নামেন্টে অভিষেকেই।
চ্যাম্পিয়নস লিগে শিরোপার স্বাদ পাওয়া ২২টি ক্লাবের মধ্যে একমাত্র নটিংহামকেই নিজের দেশে তৃতীয় বিভাগেও খেলতে হয়েছে।
পরপর দুই বছর চ্যাম্পিয়ন লিগ জেতার আগের বছরই ইংলিশ লিগ জিতেছিল নটিংহাম। ক্লাবটির ১৫৭ বছরের ইতিহাসে ওটাই একমাত্র লিগ শিরোপা। আর কখনো লিগ জিততে না পারা নটিংহাম তাই হয়ে গেছে অদ্ভুত এক রেকর্ডের মালিকও। ওরাই ইউরোপের একমাত্র ক্লাব, যাদের লিগের চেয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি বেশি! সঙ্গে একটা লজ্জার রেকর্ডও আছে নটিংহ্যাম্পশায়ারের ক্লাবটির। চ্যাম্পিয়নস লিগে শিরোপার স্বাদ পাওয়া ২২টি ক্লাবের মধ্যে একমাত্র নটিংহামকেই নিজের দেশে তৃতীয় বিভাগেও খেলতে হয়েছে।
লেভানডফস্কি-মুলারদের আসলে ওই মৌসুমে এতগুলো ম্যাচ না জিতলেও চলত। কিন্তু হান্সি ফ্লিকের সেই দলটাকে যেন জয়ের নেশায় পেয়েছিল ২০১৯-২০ মৌসুমে। করোনার কারণে মাঝপথে বিরতি পড়া টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনাল এক লেগ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উয়েফা। ফাইনালের দুই দলকে তাই ১৩টা নয়, ম্যাচ খেলতে হয়েছিল ১১টা। সেই ১১টা ম্যাচই জিতে চ্যাম্পিয়নস লিগে নতুন এক ইতিহাস গড়ে বায়ার্ন। ইউরোপ-সেরার টুর্নামেন্টে ৬৭ বছরের ইতিহাসে শতভাগ জয়ের রেকর্ড নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া একমাত্র দল এখন পর্যন্ত ফ্লিকের বায়ার্নই।
ইউরোপ-সেরার টুর্নামেন্টে ৬৭ বছরের ইতিহাসে শতভাগ জয়ের রেকর্ড নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া একমাত্র দল এখন পর্যন্ত ফ্লিকের বায়ার্নই।
তবে চ্যাম্পিয়ন হতে যে এত ম্যাচ জেতার দরকার পড়ে না, সেটা দেখিয়েছিল পিএসভি আইন্দহফেন। ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে গাস হিডিঙ্কের পিএসভি ইউরোপের সেরা হয়েছিল মাত্র দুটি ম্যাচ জিতে! প্রথম রাউন্ডে একটি, দ্বিতীয় রাউন্ডে দুটি। ব্যস, আর দরকার পড়েনি। বোর্দোর বিপক্ষে দুই লেগের কোয়ার্টার ফাইনাল পিএসভি পেরিয়েছিল অ্যাওয়ে গোলে, রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও তা-ই। বেনফিকার সঙ্গে ফাইনাল গোলশূন্য শেষ হওয়ার পর রোনাল্ড কোমানরা উচ্ছ্বাসে ভেসেছিলেন টাইব্রেকারে। এত কম ম্যাচ জিতে আর কোনো দল এর আগে-পরে কখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেনি। ৯ ম্যাচে পিএসভি গোল করেছিল ৯টি। এত কম গোল করেও কোনো দল আর কখনো চ্যাম্পিয়ন হয়নি। কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে কোনো ম্যাচ না জিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিরল কীর্তিও একমাত্র পিএসভিরই।
এখন এটা কল্পনা করা কিছুটা কঠিন। ইউরোপের বড় ক্লাবগুলো এখন অনেক বেশি বহুজাতিক। একই ক্লাবে কত দেশের খেলোয়াড়েরা খেলেন। তবে তিনটা ক্লাব ইউরোপ-সেরা হয়েছিল সম্পূর্ণ নিজের দেশের খেলোয়াড়দের দিয়ে গড়া দল নিয়ে। ১৯৬১ ও ১৯৬২, পরপর দুই বছর ইউরোপিয়ান কাপ জেতা বেনফিকার সব খেলোয়াড়ই ছিলেন পর্তুগিজ। কারও কারও জন্ম অবশ্য হয়েছিল সেই সময়ে পর্তুগালের আফ্রিকান উপনিবেশে। এখন সেই উপনিবেশগুলো স্বাধীন দেশ হয়ে গেছে। তবে তখন পর্তুগালেরই অংশ ছিল।
১৯৬৭ সালের চ্যাম্পিয়ন সেল্টিকের সব খেলোয়াড়ের তো জন্মই হয়েছিল ক্লাবের মাঠ সেল্টিক পার্কের ৩০ মাইলের মধ্যে। ১৯৮৬ সালে স্টুয়া বুখারেস্টও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সব রোমানিয়ান খেলোয়াড় নিয়ে।
আবার এর উল্টোটাও আছে। কখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ না জেতা আর্সেনাল ২০০৬ সালে হামবুর্গের বিপক্ষে এক ম্যাচে একাদশ সাজিয়েছিল ১১ দেশের ১১ খেলোয়াড় দিয়ে।
দুজনের মধ্যে মিল যেখানে—সেটাই একটা রেকর্ড। ফ্রান্সিসকো জেন্তো ও পাওলো মালদিনি দুজনেই খেলেছেন ৮টি করে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। এই কীর্তি নেই অন্য কোনো খেলোয়াড়ের। তবে জেন্তো এখানেও অনন্য। আটবারের মধ্যে ছয়বারই শিরোপা জিতেছেন—প্রথমটি ১৯৫৬ সালে, শেষটা ১৯৬৬ সালে অধিনায়ক হিসেবে। ছয়বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা একমাত্র খেলোয়াড় রিয়াল মাদ্রিদের এই স্প্যানিশ কিংবদন্তি।
মালদিনি জিতেছেন পাঁচবার। ১৯৮৯ সালে প্রথমবার রাইকার্ড-খুলিত-ফন বাস্তেনদের সঙ্গে। ২০০৭ সালে যখন শেষবার জেতেন, তখন তাঁর সতীর্থ কাকা-কাফু-পিরলো-নেস্তারা। প্রথম ও পঞ্চম, এই দুই জয়ের মধ্যে ব্যবধান ১৮ বছরের। প্রথম ও শেষ জয়ের মধ্যে এত দীর্ঘ ব্যবধান নেই ইতিহাসের অন্য কোনো খেলোয়াড়ের। থাকবে কী করে, সবাই তো আর মালদিনির মতো ‘ওল্ড ওয়াইন’ নয়!
পাদটীকা: ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তাঁর পাঁচ ট্রফির প্রথমটি জিতেছেন ২০০৮ সালে, সর্বশেষটি ২০১৮ সালে। মালদিনি হওয়া কত কঠিন বোঝা যাচ্ছে তো!
বাবা-ছেলে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, এমন কীর্তি আছে চার পরিবারের। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত মিলানের মালদিনি পরিবার—সিজার (১৯৬৩) ও পাওলো মালদিনি (১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯৪, ২০০৩, ২০০৭)। রিয়াল মাদ্রিদের ম্যানুয়েল সানচিজ মার্তিনেজ (১৯৬৬) জিতেছেন জেন্তোর সেই দলের হয়ে, পরে তাঁর ছেলে ম্যানুয়েল সানচিজ হুনতিয়েলো (১৯৯৮, ২০০০) জিতেছেন ক্যাসিয়াস-রবার্তো কার্লোস-রাউলদের সঙ্গে। বার্সেলোনার হয়ে তিনটি ট্রফি জেতা সের্হিও বুসকেতসের (২০০৯, ২০১১, ২০১৫) বাবা কার্লেস বুসকেতস ছিলেন ইয়োহান ক্রুইফের সেই ‘ড্রিম টিমে’ (১৯৯২)। ২০০২ সালে যাঁর বিখ্যাত ভলি রিয়াল মাদ্রিদকে নবম চ্যাম্পিয়নস লিগ এনে দিয়েছিল, সেই জিনেদিন জিদান কোচ হয়ে ফেরার পর তাঁর দুই ছেলে এনজো (২০১৭) ও লুকাকেও (২০১৮) সুযোগ দিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য হওয়ার।
তবে গল্পটা যদি দুই প্রজন্ম ছাড়িয়ে তিন প্রজন্মে নিয়ে যাওয়া হয়, আলোনসো পরিবারের কথা আসবে। মার্কোস আলোনসো ইমাজ ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের সেই প্রথম পাঁচ চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দলের ডিফেন্ডার। তাঁর নাতি মার্কোস আলোনসো দাদার মতো পাঁচটা ট্রফি জিততে পারেননি, গত বছর চেলসির হয়ে জেতা একমাত্র চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিটাই শুধু সম্বল তাঁর। এ দুজনের মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের যিনি, চেলসির আলোনসোর বাবা ও রিয়ালের আলোনসোর ছেলে, সেই মার্কোস আলোনসো পেনা খেলেছেন বার্সেলোনায়। ১৯৮৬ সালের ফাইনালে পেনার বার্সেলোনা অবিশ্বাস্যভাবে স্টুয়া বুখারেস্টের কাছে হেরে না গেলে আলোনসো পরিবার ফুটবল ইতিহাসে অনন্য এক রেকর্ডের মালিক হয়ে যেত।
অনন্য অবশ্য এখনো বলা যায়। একই পরিবারে দাদা-বাবা-নাতি তিনজনেরই চ্যাম্পিয়ন লিগের ফাইনাল খেলার কীর্তি যে শুধু আলোনসোদেরই।