একসময় যাঁরা মাঠে মোহামেডানের হয়ে আলো ছড়াতেন, সেই তারকারাই এখন হাল ধরেছেন ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির।
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অনুশীলনে যেন তারার মেলা বসে। কয়েক দিন আগে ক্লাবের ছোট্ট মাঠটিতে সার্কিট অনুশীলন চলছিল। শুরুর ধাপে স্টিকের মধ্যে দিয়ে ফুটবলারদের দৌড়ানোর দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন প্রধান কোচ শফিকুল ইসলাম, পরের ধাপ কোণের ওপর দিয়ে লাফিয়ে ওঠার নির্দেশনায় সহকারী কোচ আলফাজ আহমেদ আর শেষের ধাপে গোল পোস্টে শট নেওয়ার জায়গায় গোলকিপার কোচ ছাঈদ হাসান কানন।
মাঠের পাশে চেয়ারে বসেই অনুশীলন দেখছিলেন ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব ও টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম সদস্য রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির। তাঁরা ছাড়াও টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য হিসেবে দলটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন জাকারিয়া পিন্টু, হাসানুজ্জামান বাবলু, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, কায়সার হামিদ, জসিমউদ্দিন জোসি, রিয়াজদের মতো সাবেক তারকারা।
তাঁদের নাম বাংলাদেশের ফুটবলে এখনো সুরভি ছড়ায়। খেলোয়াড়ি জীবনে মোহামেডানের জার্সিতে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে তাঁরা ফুটবলের রঙে রঙিন করে রেখেছিলেন শহর থেকে জনপদ। ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির জার্সিতে প্রায় সবারই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধুর স্মৃতি আছে।
কয়েক বছর আগেও ক্লাবে যাওয়া আসা ছিল না তাঁদের। ২০১৯ সালে ক্যাসিনো–কাণ্ডে মোহামেডানের টালমাটাল অবস্থা হলে সাবেক খেলোয়াড়েরা এসে হাল ধরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রিয় ক্লাবটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার মিশনে নেমেছেন। একটি তথ্য দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে বর্তমান মোহামেডানের খেলোয়াড়দের অবস্থা। ২৩ সদস্যের জাতীয় দলে সাদা–কালোদের খেলোয়াড় শুধু জাফর ইকবাল, একাদশ জায়গা হয় না তাঁর। উত্তরসূরিদের শোচনীয় অবস্থায় ক্লাবটির নামের শোভাবর্ধন করে যাচ্ছেন সাবেকেরাই।
মৌসুমের শুরু থেকেই ছিলেন আলফাজ, কানন ও নকীব। কয়েক দিন আগে প্রধান কোচ হিসেবে লিগের বাকি সাতটি ম্যাচের জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন শফিকুল। সাবেক সতীর্থ খেলোয়াড়দের পেয়ে প্রিয় দলের অনুশীলন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে আসছেন সাব্বির, জনিরা। এঁদের মধ্যে শফিকুল ছাড়া বাকি সবারই মোহামেডানের অধিনায়কত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে কাননের সঙ্গে একমাত্র শফিকুলেরই আছে ১৯৮৬, ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে হ্যাটট্রিক লিগ শিরোপা জেতার সুখস্মৃতি। ১৯৮৭ সালের দলে একই সঙ্গে খেলেছেন সাব্বির, কানন ও শফিকুল।
৮৫ থেকে টানা ৯৪ সাল পর্যন্ত মোহামেডানের গোলপোস্ট সামলেছেন কানন। গোলকিপিংয়ে ‘লেভেল টু’ সনদ নিয়ে এবার প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ আসরে কোচিং করানো সাবেক তারকা এই গোলরক্ষক মোহামেডান ক্লাবে বসে বলছিলেন, ‘আমরা দলের সঙ্গে এখন যারা আছি, সবাই সমর্থকদের কাছে পরিচিত মুখ। মোহামেডান ক্লাবে আমাদের অনেক শ্রমও আছে সাফল্যও আছে। পাঁচটি লিগ শিরোপা আছে আমার। টাকাপয়সার চিন্তা ছাড়াই দলটার সঙ্গে আছি।’
গোলপোস্টের নিচে কানন আর তাঁর সামনে রক্ষণ সামলাচ্ছেন লেফটব্যাক জনি, মোহামেডানের সমর্থকদের কাছে হিরণ্ময় স্মৃতি হয়ে থাকার কথা। ক্লাবে নিজের কর্মপন্থা সম্পর্কে ধারণা দিলেন ছয় মৌসুম মোহামেডানে খেলে তিনটি লিগ শিরোপা জেতা জনি, ‘আমাদের কাজটি চ্যারিটি হলেও কোচিংয়ের সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁরা পেশাদার। দল গঠনের সময় পরামর্শ দিই। ম্যাচ দেখে কোনো পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন হলে সেগুলো কোচিং স্টাফ ও খেলোয়াড়দের জানাই। খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের বিষয়গুলোও দেখে থাকি।’
১৯৮৬ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত টানা মোহামেডানে খেলে খেলোয়াড় থাকা অবস্থাতেই ১৯৯৬ সালে দলটির ট্রেনার হয়ে ওঠা শফিকুলের। মাঝে কয়েক দফা কোচের দায়িত্ব পালন করে প্রায় ১১ বছর পর আবার মোহামেডানের প্রধান কোচ হয়ে ফিরেছেন। কোচিং স্টাফে সতীর্থ খেলোয়াড় কাননের সঙ্গে পেয়েছেন প্রাক্তন দুই ছাত্র আলফাজ ও নকীবকে। সাবেক স্ট্রাইকার নকীব শফিকুলের সঙ্গে খেলেছেন, আবার তাঁর কোচিংয়ে অধিনায়কত্ব করে জিতেছেন শিরোপাও।
শফিকুলের সঙ্গে আলফাজের খেলার সৌভাগ্য না হলেও শফিকুলের কোচিংয়ে এক মৌসুম করে মোহামেডান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলেছেন। সব মিলিয়ে শফিকুলের কাছে পরিবেশটা হয়ে উঠেছে খুবই আন্তরিক, ‘আমরা সবাই পুরোনো মানুষ। একে অন্যকে সম্মান করি। এ ছাড়া মোহামেডান ক্লাবে সব সময়ই সাবেক খেলোয়াড়দের অবস্থান ভালো।’
বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম দুই সেরা স্ট্রাইকার নকীব ও আলফাজ জুটি বেঁধে দুই মৌসুম একসঙ্গে খেলে মোহামেডানকে এনে দিয়েছেন কত জয়। বল নিয়ে এঁকেবেঁকে আলফাজের ছুটে চলা, তারপর তাঁর কোনো ক্রসে নকীবের মাথা ছোঁয়ানো গোল—এ রকম কত স্মৃতি মোহামেডান সমর্থকদের। মোহামেডান যে ২০০২ সালে সর্বশেষ লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সে দলের সদস্য ছিলেন তাঁরা।
এর আগের বছর নকীবের ১৬ গোলের সঙ্গে আলফাজ ১৪ গোল করেও দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেননি, হয়েছিল রানার্সআপ। ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম লিগে মোহামেডানের হয়ে এই জুটির গোল ৩২টি। আলফাজের গোল ১৮, নকীবের ১৪। নকীবের সঙ্গে জুটির স্মৃতি মনে করে আলফাজ বলছিলেন, ‘ওকে (নকীব) আমি বুঝতাম। ও কী করতে চায়। আমি সেভাবেই বল দিতাম। ও আমাকে দিয়ে অনেক গোল করিয়েছে।’ মোহামেডানকে তিন মৌসুম নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৯৯ সালে মোহামেডানকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন আলফাজ।
লিগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে মোহামেডানের হয়ে একমাত্র হ্যাটট্রিকের রেকর্ড নকীবের, সেই ২০০০ সালে। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে খেলা এই স্ট্রাইকার এখন নিয়েছেন মোহামেডানের হারানো সুনাম ফেরানোর দায়িত্ব, ‘বিভিন্ন কারণে মাঝে দলের ওপর থেকে খেলোয়াড়দের আস্থা চলে গিয়েছিল, ভালো খেলোয়াড়েরা এই দলে খেলতে চাইত না।
তিন বছর ধরে খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ঠিকমতো দিচ্ছি। এখন আবার খেলোয়াড়েরা মোহামেডানে খেলতে আসতে চাচ্ছে।’
সাবেক তারকাদের হাত ধরে এভাবেই হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছে মোহামেডান।
২০১৯ সালে ক্যাসিনো–কাণ্ডে লন্ডভন্ড হয়ে যায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার হন ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। সে বছর মোহামেডান নামে ফুটবল দল প্রিমিয়ার লিগে থাকবে কি না, তৈরি হয়েছিল সে শঙ্কাও। ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড় প্রয়াত বাদল রায়ের নেতৃত্বে হাল ধরেন সাবেক খেলোয়াড়েরা। পরবর্তী সময়ে ক্লাবের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হিসেবে অ্যাডভোকেট এম এ আমিন উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয় হাইকোর্ট।
তাঁর অধীন গত বছর মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল মুবীন। আবদুল মুবীনের ইউনাইটেড গ্রুপই এখন মোহামেডান ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এ ছাড়া ক্লাবের বোর্ড পরিচালকেরাও দল পরিচালনায় অর্থের জোগান দিয়ে থাকেন। যেমন ফুটবল কমিটির দায়িত্বে আছেন বোর্ডের পরিচালক ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর।
ক্লাবের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ফুটবল দলের বাজেট ১২ কোটি টাকার মতো। ক্লাবের পরিচালক ও ফুটবল কমিটির সম্পাদক আবু হাসান চৌধুরী দলের আর্থিক জোগান সম্পর্কে বলছিলেন, ‘আমাদের মূল পৃষ্ঠপোষক ক্লাবের সভাপতি (আবদুল মুবীন)। এ ছাড়া ফুটবল দল গঠনে ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যানের বড় অবদান আছে। ক্লাবের আরেক পরিচালক মোস্তফা কামালের কোম্পানি স্পনসর করেছে দলের জার্সি। এ ছাড়া ক্লাবেরই সব পরিচালক দল গঠনে অর্থের জোগান দিয়ে থাকেন।’
বর্তমানে ক্লাবে সাবেক ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেনের আসা–যাওয়া নেই। তবে বাইরে থেকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে থাকেন বলে জানালেন ক্লাবের ঘনিষ্ঠ একজন। বিশেষ করে ক্লাবের সঙ্গে ক্রিকেট বোর্ড–সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তাঁর প্রভাব থাকে বলে জানা গেছে।