শতাব্দীর সেরা গোল।
শতাব্দীর সেরা গোল।

জীবনটা যেভাবে কাটিয়েছেন ম্যারাডোনা

সবাইকে হতভম্ব করে চলে গেছেন কিংবদন্তি। সবাইকে কাঁদিয়ে মাত্র ৬০ বছর বয়সে বিদায় নিয়েছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। একজীবনে যা করা সম্ভব, সবই করেছেন। সবাইকে ফুটবল–প্রেমে বুঁদ করেছেন। হাসি ফুটিয়েছেন মানুষের মুখে। একনজরে দেখে নেওয়া যাক কেমন কেটেছে এই কিংবদন্তির জীবন—

৩০ অক্টোবর ১৯৬০: বুয়েনস এইরেসে জন্ম। লানুসের এভিতা হাসপাতালেই প্রথম পৃথিবীর আলো দেখা তাঁর।

১৯৬৮: পাড়ার ক্লাব এত্রেয়া রোহার হয়ে খেলার সময় প্রথম এক স্কাউটের নজরে পড়েন।

১৯৭২: আর্জেন্টিনোস জুনিয়র ক্লাবের একাডেমি দলে খেলতেন। মূল দলের খেলার বিরতিতে ফুটবলশৈলী দেখে মুগ্ধ করতেন দর্শকদের। এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে মাঝেমধ্যে বিরতি শেষে খেলা শুরুর চেষ্টায় বিরক্ত হতেন দর্শকেরা। ম্যাচের চেয়ে ছোট ম্যারাডোনার স্কিল দেখাটাই যে বেশি আনন্দদায়ী ছিল!

সেই মুহূর্ত। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা।

২০ অক্টোবর ১৯৭৬: ১৬ বছর হওয়ার আগেই পেশাদার ফুটবলে অভিষেক। আর্জেন্টিনোস জুনিয়রের হয়ে অভিষেকের কয়েক মিনিটের মধ্যেই হুয়ান ক্যাব্রেরাকে ‘নাটমেগ’ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের উল্লাস, ওলে!

১৪ নভেম্বর ১৯৭৬: সান লরেঞ্জোর বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম গোল।

২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭: আর্জেন্টিনার জার্সিতে অভিষেক।

১৯৭৮: বয়স কম, এই অজুহাতে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলে ম্যারাডোনাকে নেননি কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ না খেলার এ দুঃখ আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন ম্যারাডোনা।

২ জুন ১৯৭৯: আর্জেন্টিনার জার্সিতে প্রথম গোল।

৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯: আর্জেন্টিনাকে যুব বিশ্বকাপ জিতিয়ে ফিরলেন ম্যারাডোনা।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১: জুনিয়র্সের হয়ে ১৬৭ ম্যাচে ১১৫ গোল করে বোকা জুনিয়র্সে যোগ দিলেন। অন্য ক্লাবের কাছ থেকে আরও বেশি বেতনের প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছেন। কারণ, এ ক্লাবের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেই বড় হয়েছেন।

১০ এপ্রিল ১৯৮১: রিভার প্লেটের বিপক্ষে এল ক্লাসিকোতে গোল।

১৩ জুন ১৯৮২: বিশ্বকাপে প্রথম মাঠে নামা। বেলজিয়ামের কাছে হেরে বিশ্বকাপ অধ্যায় শুরু তাঁর।

১৫ জুন ১৯৮২: হাঙ্গেরির বিপক্ষে জোড়া গোল।

১ জুলাই ১৯৮২: সে সময়কার বিশ্ব রেকর্ড (৫০ লাখ পাউন্ড) গড়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যারাডোনা।

২ জুলাই ১৯৮২: ব্রাজিলের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরে বিদায় আর্জেন্টিনার। লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লেন ম্যারাডোনা।

২৬ জুন ১৯৮৩: রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে গিয়ে অবিশ্বাস্য এক গোল করলেন ম্যারাডোনা। রিয়াল গোলরক্ষক অগাস্তিন ও ডিফেন্ডার হুয়ান হোসেকে রীতিমতো অপদস্থ করে করা সেই গোলের পর পুরো বার্নাব্যুতে তালিতে ফেটে পড়েছিল। সেবারই প্রথম বার্সেলোনার কোনো খেলোয়াড়কে এভাবে সম্মান জানিয়েছে রিয়াল–সমর্থকেরা।

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩: অ্যাথলেটিক বিলবাওর আন্দোনি গয়কয়চিয়া ভয়ংকর এক ট্যাকল করে ম্যারাডোনার ক্যারিয়ার হুমকির মুখে ফেলে দেন। তিন মাসের বেশি বসে থাকতে হয়েছিল তাঁকে।

৫ মে ১৯৮৪: বার্নাব্যুতে কোপা দেল রে ফাইনালে আবারও গয়কয়চিয়ার ট্যাকল। সে সঙ্গে বিলবাও সমর্থক ও খেলোয়াড়দের জাতিবিদ্বেষী মন্তব্যে খেপে ওঠেন ম্যারাডোনা। এক ভয়ংকর মারামারির সূত্রপাত। যাতে দুই দলের সবাই জড়িয়ে পড়েন। স্পেনের রাজার সামনে হওয়া সে ঘটনায় গ্যালারিতে ৬০ জন আহত হয়েছিলেন। বার্সেলোনার জার্সিতে এটাই তাঁর শেষ ম্যাচ।

৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা।

১ জুলাই ১৯৮৪: আবারও বিশ্ব রেকর্ড গড়ে দলবদল। এবার গন্তব্য নাপোলি।

২ জুন ১৯৮৬: মেক্সিকো বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে দলের তিনটি গোলেই ছিল তাঁর অবদান।

৫ জুন ১৯৮৬: বিশ্বকাপে প্রথম গোল ম্যারাডোনার।

২২ জুন ১৯৮৬: কিংবদন্তির জন্ম। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি গোলে অমরত্ব মিলল ম্যারাডোনার। প্রথম ঈশ্বরের হাত দেখল বিশ্ব। এরপর ঐশ্বরিক ক্ষমতায় করা এক গোল। ৬৬ গজ দৌড়ে পাঁচ ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে করা সে গোল শতাব্দীর সেরা বলে নির্বাচিত হয়েছিল। একই দিনে নন্দিত ও নান্দনিকের অর্থ বুঝল ফুটবল।

২৯ জুন ১৯৮৬: বিশ্বকাপ! বেলজিয়ামের বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে সেমিফাইনাল পার করিয়ে এনেছিলেন। ফাইনালে তাঁকে আটকাতে দুজন খেলোয়াড় রেখেছিল জার্মানি। তবু ৩-২ গোলে শেষ হওয়া ম্যাচের শেষ গোলটি বানিয়ে দেওয়া ঠেকানো যায়নি।

১৯৮৭: নাপোলিকে সিরি ‘আ’ জেতালেন। ক্লাবের ইতিহাসের প্রথম ট্রফি।

১৯৮৯: নাপোলিকে প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফির স্বাদ এনে দিলেন। উয়েফা কাপ জিতলেন ম্যারাডোনা।

১৯৯০: নাপোলিকে দ্বিতীয় সিরি ‘আ’ এনে দিলেন ম্যারাডোনা। ক্লাবের ইতিহাসের সর্বশেষ শিরোপা এটি।

১৯৯০ বিশ্বকাপ: চোট নিয়ে ভোগা ম্যারাডোনার সেরাটা দেখা যায়নি। তবু শেষ ষোলোর ম্যাচে এক মুহূর্তের এক জাদুতে ব্রাজিলকে ছিটকে দিলেন বিশ্বকাপ থেকে। তাঁর পাশ থেকে গোল করেন ক্লদিও কানিজিয়া। কোয়ার্টার ও সেমিফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে পার পেলেও ফাইনালে আর রক্ষা পায়নি আর্জেন্টিনা। ৮ জুলাই রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ৮৫ মিনিটে পাওয়া পেনাল্টি থেকে বিশ্বকাপ জেতে জার্মানি।

২৫ মার্চ ১৯৯১: কোকেন ব্যবহার করার ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হলেন ম্যারাডোনা। নিষেধাজ্ঞা শেষে আর নাপোলিতে ফেরেননি।

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৯২: রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সেভিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি এখন বিশ্বসেরা নয়, দশ হাজারতম খেলোয়াড়!

১ জুলাই ১৯৯৩: নিউওয়েল বয়েজ ক্লাব দিয়ে আর্জেন্টিনায় ফেরা।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ: ২১ জুন গ্রিসের বিপক্ষে গোল করলেন ম্যারাডোনা, দলও পেল ৪-০ গলের বড় জয়। দ্বিতীয় ম্যাচে ক্যানিজিয়াকে দিয়ে গোল করালেন। অন্য গোলটিতেও ছিল তাঁর অবদান। আর্জেন্টিনা জিতল ২-১ গোলে। ২৫ জুনের সে ম্যাচের পরই ডোপ টেস্টে ধরা পড়েন ম্যারাডোনা। নিষিদ্ধ এফিড্রিন নেওয়ায় বিশ্বকাপ থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। আর্জেন্টিনার জার্সিতে তাঁকে আর দেখা যায়নি।

আর্জেন্টিনা কোচ হিসেবে ম্যারাডোনা।

১ অক্টোবর ১৯৯৫: নিষেধাজ্ঞা শেষে আবার বোকা জুনিয়র্সে ফেরা। নিজের প্রিয় ক্লাবে ফেরার এ মুহূর্তটা উদ্‌যাপন করেছেন বিখ্যাত এক মন্তব্যে, এ ফেরা অনেকটা ১৪ বছর গর্ভ ধারণ করে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার মতো।

২৫ অক্টোবর ১৯৯৭: আর পারছিলেন না। ৩৭তম জন্মদিনের পাঁচ দিন আগে বিদায় জানিয়ে দিলেন ফুটবলকে।

২০০০: ফিফার জরিপে শতাব্দীর সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলেন। ৫৩.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। পেলে পেয়েছিলেন ১৮.৫৩ শতাংশ ভোট।

২০০৪: অতিমাত্রায় মাদক সেবনের কারণে মৃত্যুর দুয়ারে চলে গিয়েছিলেন।

৬ মার্চ ২০০৫: বাইপাস সার্জারি করা হলো ম্যারাডোনার। মাত্রাতিরিক্ত স্থূল হয়ে যাওয়া ম্যারাডোনা এরপরই ধীরে ধীরে ওজন কমাতে সক্ষম হন।

২৯ মার্চ ২০০৭: অতিরিক্ত মদ্যপান ও খাবার খেয়ে পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।

আর্জেন্টিনার খেলা মানেই গ্যালারিতে ম্যারাডোনা। আর এ দৃশ্য দেখা যাবে না।

২৯ অক্টোবর ২০০৮: আর্জেন্টিনা দলের কোচ হিসেবে ম্যারাডোনার নাম ঘোষণা। ১৯ নভেম্বর তাঁর অধীনে প্রথম ম্যাচ খেলে আর্জেন্টিনা।

১০ অক্টোবর ২০০৯: যোগ করা সময়ে পালের্মোর গোলে বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করে আর্জেন্টিনা। গোল উদ্‌যাপনের কোচ ম্যারাডোনার স্লাইড এখনো চোখে লেগে আছে সবার।

৩ জুলাই ২০১০: দারুণ শুরু করেও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে হার আর্জেন্টিনার।

২৭ জুলাই ২০১০: আর্জেন্টিনার কোচের পদ থেকে বাদ পড়লেন ম্যারাডোনা।

২০১৯: অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে আবার অস্ত্রোপচার করতে হয়।

২ নভেম্বর ২০২০: ম্যারাডোনাকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নেওয়া হলো। প্রাথমিকভাবে বলা হলো, মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক দিন পরই মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হলো তাঁর।

১২ নভেম্বর ২০২০: সফল অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো তাঁকে।

২৫ নভেম্বর ২০২০: বুয়েনস এইরেসে নিজের ঘরে হৃদ্‌রোগে মৃত্যু হলো কিংবদন্তির।