রিয়াল মাদ্রিদ যেন এখন ভাঙা হাট। কোচ জিনেদিন জিদান নেই, দলের অধিনায়ক সের্হিও রামোস নেই। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তো কয়েক বছর আগেই বিদায় নিয়েছেন। গত এক দশকে ক্লাবে অধিকাংশ সাফল্য এই তিনজনের হাত ধরেই এসেছে।
ক্লাবের সোনালি সময়ের সবচেয়ে বড় এই তিন কারিগরকে রাখার জন্য রিয়াল মাদ্রিদ কী একটু চেষ্টাও করতে পারত না? হয়তো পারত। কিন্তু রিয়াল পেশাদারিত্বকেই প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে জিদানরা বিদায় নিয়েছেন, ক্লাবও তাঁদের ছাড়া ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা শুরু করে দিয়েছে।
জিদান-রামোসদের বিদায় ক্লাব সমর্থকদের অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেননি। অনেকে সরাসরি দোষারোপ করেছেন পেরেজকে। জিদান তো সরাসরি ক্লাব ছাড়ার কারণ হিসেবে ক্লাব থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়া, প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ার কথা বলে গিয়েছেন খোলা চিঠি লিখে।
এতদিন এসব ব্যাপারে পেরেজ কিছু না বললেও অবশেষে মুখ খুলেছেন। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ওন্দা চেরো'র ত্রানসিস্তর অনুষ্ঠানে জিদান, রামোসসহ আরও অনেক বিষয়ে মুখ খুলেছেন এই সভাপতি।
তবে জিদান যে চিঠিটা লিখেছেন, সেটা যে তিনি লিখতে পারেন সেটা বিশ্বাসই হচ্ছে না পেরেজের, ‘আমি ওকে চিনি। আমাদের জন্য বছরটা বেশ কঠিন গিয়েছে। তাও আমি চেষ্টা করেছিলাম ওকে দলে রাখার জন্য। ও যে চিঠিটা লিখেছে, সেটা আমি পড়িনি। তবে আমি আমার নাতিপুতিদের কসম খেয়ে বলতে পারি, ওই চিঠি জিদান লেখেনি। আরেকজন লিখেছে।’
তবে যত যা-ই হোক না কেন, জিদানের প্রতি তাঁর সম্মান ও ভালোলাগা কখনই কমবে না বলে জানিয়েছেন পেরেজ, ‘তাঁর ভালো হোক, এই কামনা করি। রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি তিনি। ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ হওয়ার ইচ্ছা আছে তাঁর, আশা করব তিনি যেন ওই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন।’
এর আগে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এএসকে জিদান জানিয়েছিলেন রিয়াল ছাড়ার কারণ, দীর্ঘ এক চিঠির মাধ্যমে। তাঁর ক্লাব ছাড়ার দায়টা একরকম রিয়ালের কাঁধেই চাপিয়েছিলেন এই ফুটবল কিংবদন্তি। জানিয়েছিলেন, প্রিয় ক্লাব তাঁর ওপর আর আস্থা রাখেনি, তাই ক্লাব ছাড়তে বাধ্যই হয়েছেন তিনি, ‘আমি ক্লাব ছেড়েছি, কিন্তু কখনোই অনুশীলন করাতে হাঁপিয়ে উঠিনি। ২০১৮ সালের মে মাসে ক্লাব ছেড়েছিলাম। কারণ, তখন আমার মনে হয়েছিল, আড়াই বছরের সাফল্য এবং এতগুলো শিরোপার পর দলকে উদ্বুদ্ধ করতে নতুন কাউকে দরকার। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এবার আমি ক্লাব ছাড়ছি, কারণ ক্লাব আমার ওপর সেভাবে আস্থা রাখতে পারছিল না ক্লাব।’
রিয়ালকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জিদানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ক্লাবের পক্ষ থেকে তেমন সাহায্য পাননি বলে জানিয়েছিলেন জিদান, ‘একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ক্লাবের পক্ষ থেকে যেমন সমর্থন দরকার, সেটি আমি পাচ্ছিলাম না রিয়ালের কাছ থেকে। আমি ফুটবল বুঝি। বুঝি রিয়ালের কী কী দরকার। আমি জানি, যখন জেতা যায় না, তখন সরে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু এখানে আমার অর্জনগুলোকে ভুলে যাওয়া হয়েছে।’
রিয়ালের হয়ে দুটি লিগ জিতেছেন, টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার অনন্য কীর্তিও গড়েছেন। তাঁর অর্জন এ যুগে অন্য অনেক কোচেরই নেই। এত অর্জনের পরেও ক্লাব থেকে প্রাপ্য সম্মানটা পাননি জিদান বলে আক্ষেপ ছিল তাঁর, ‘প্রতিদিন ক্লাবের প্রত্যেকের সঙ্গে আমি সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। আমি জন্মেছি জেতার জন্যই। এখানে এসেছিলাম শিরোপা জেতার জন্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ, জীবন, আবেগের মতো বেশ কিছু জিনিস থাকে, যেগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হয়। কোনো না কোনোভাবে আমার ঘাড়ে দোষ চাপানোর একটা প্রবণতা দেখেছি। আমরা সবাই মিলে এখানে যে সাফল্য অর্জন করেছি, আমি সবার চোখে শুধু সম্মানের দৃষ্টিটাই দেখতে চেয়েছিলাম।’
পেরেজের অনুষ্ঠানে কথা উঠেছিল রামোসকে নিয়েও। সেখানে রামোসের প্রতি তাঁর অনুরাগের কথাই জানিয়েছেন এই সভাপতি, ‘রামোসকে আমি আমার ছেলের মতো পছন্দ করি। আমি ওকে ২০০৫ সালে এই ক্লাবে এনেছিলাম। এর আগে আমি কোনো খেলোয়াড়ের পরিচিতি অনুষ্ঠানে যাইনি, কিন্তু রামোসেরটায় গিয়েছিলাম। ওর জন্য আমার অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করে। ও আমাদের কিংবদন্তি।’
কিন্তু চুক্তির মারপ্যাঁচে পড়ে সেই রামোসকেও বিদায় জানিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়ালের সঙ্গে রামোসের বর্তমান চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী ৩০ জুন, কিন্তু সেটির নবায়ন নিয়ে রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সঙ্গে বনাবনি হয়নি রামোসের।
রিয়ালে নতুন নিয়ম করেছেন পেরেজ, ৩০ পেরোনো খেলোয়াড়দের চুক্তি নবায়ন করার ক্ষেত্রে এক বছর করে চুক্তি নবায়ন করা হবে। মিডফিল্ডার লুকা মদরিচের ক্ষেত্রে গত দুই বছর ধরে যা করছে রিয়াল। কিন্তু রামোস এভাবে এক বছর করে চুক্তিতে রাজি নন। তিনি দলের অধিনায়ক, এত কিছু এনে দিয়েছেন দলকে, হয়তো একটু বাড়তি সম্মান চেয়েছিলেন রিয়ালের কাছ থেকে।
রামোস অন্তত দুই বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পেরেজ এক বছরের বেশি দিতে রাজি নন। এদিকে অর্থের হিসাব নিয়েও দুই পক্ষে বেধেছিল বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম। সব মিলিয়ে চলেই যেতে হচ্ছে রামোসকে।
তবে এই সিদ্ধান্ত নিতেও যে পেরেজের কষ্ট হয়েছে, সেটাই বোঝা গেছে তাঁর কথায়, ‘আমরা চেয়েছিলাম ও যেন আমাদের ক্লাবে থাকে। ওকে এই জন্য একটা চুক্তির প্রস্তাবও করা হয়েছিল, কিন্তু ও ডেডলাইনের আগে সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি। এই ক্লাব ওর ঘরবাড়ি, ও আমাদের ক্লাবে আবারো ফিরবে, অন্য কোনো ভূমিকায়।’