জিনেদিন জিদানের এমন রূপ কেউ কখনো দেখেননি। সংবাদ সম্মেলনে বরাবরই মেপে কথা বলেন রিয়াল মাদ্রিদ কোচ। কখনো কারও দোষ দিতে চান না। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নেও কখনো রা করেন না। সেই ব্যক্তি গতকাল খেপে উঠেছিলেন। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এখনো লা লিগার চ্যাম্পিয়ন রিয়াল। তাঁকে অন্তত এটুকু সম্মান দেখানো উচিত।
দলবদলে ভুল সিদ্ধান্ত আর চোট সমস্যায় এমনিতেই ভুগছে দল। লিগে শীর্ষে থাকা আতলেতিকো মাদ্রিদের চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলেও ১০ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে রিয়াল। এমন অবস্থায়ও লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে হাল ছাড়তে রাজি হননি জিদান।
কোচের সম্মানটা রাখতে পেরেছে তাঁর দল। সন্দেহ নেই, লিগের তলানিতে থাকা দল উয়েস্কার বিপক্ষে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়তে হয়েছে, অধিকাংশ সময় হারবে বলেই মনে হয়েছে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ৩ পয়েন্ট নিয়েই ফিরেছে রিয়াল। উয়েস্কার মাঠ থেকে ২-১ গোলের জয় নিয়ে ফিরেছে বর্তমান লা লিগা চ্যাম্পিয়ন।
সংবাদ সম্মেলনে রাগ উগরে দেওয়ার পরের ম্যাচটা যেকোনো কোচের জন্যই বিপজ্জনক। সংবাদমাধ্যম আগে থেকেই ওত পেতে থাকে, একটু পা ফসকালেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সবাই। পা ফসকানোর সব উপকরণ প্রস্তুত ছিল। সের্হিও রামোস, ইস্কো, ফেদেরিকো ভালভার্দে, দানি কারভাহাল, লুকাস ভাসকেজ, রদ্রিগোরা সবাই চোটে আগেই বাদ পড়েছেন। এ সপ্তাহ শুরু হয়েছে এডেন হ্যাজার্ডের আরও একবার চোটে পড়ার খবরে।
করোনার কারণে এখন লা লিগায় পাঁচজন বদলি নামাতে পারেন কোচেরা। সেখানে রিয়াল আজ মাঠে নেমেছিল বেঞ্চে চারজন খেলোয়াড় নিয়ে। কাগজে–কলমে ছয়জন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন গোলরক্ষক। বেঞ্চে থাকা চারজনের মধ্যে দুজন দ্বিতীয় দল কাস্তিয়ার খেলোয়াড়। বাকি দুজন মার্সেলো ও মারিয়ানো দিয়াজ, যাঁদের রিয়ালের হয়ে নামার স্বাদই পাওয়া হয় না ইদানীং। জিদান গত কিছুদিনে কাস্তিয়া থেকে দুজনকে ডেকে পাঠাতেন। এমনই দুর্ভাগ্য যে কাস্তিয়ার সূচি ও করোনা মিলিয়ে সেই সের্হিও আরিবাস ও আন্তোনিও ব্লাঙ্কোকেও নেওয়া যায়নি উয়েস্কা ম্যাচে।
লিগে ২০তম দল হলেও গত কিছুদিনে ফর্ম ফিরে পেয়েছে উয়েস্কা। ম্যাচের প্রথম চার মিনিটেই তিনবার শট নিয়ে বুঝিয়েও দিয়েছে সেটা। কিন্তু প্রথমার্ধের পর নিষ্প্রাণই কেটেছে। দুই দল মিলে প্রথম গোলে শট নিয়েছে ৩১ মিনিটে। করিম বেনজেমার সে শটের পরও দুই দলের খেলায় ঘুমঘুম ভাবটি কাটেনি। প্রথমার্ধজুড়ে বৃষ্টিও এতে প্রভাব রেখেছে।
ম্যাচটা জমে উঠেছে দ্বিতীয়ার্ধে। শুরু থেকেই দারুণ সব আক্রমণ। ৪৮ মিনিটেই গোল উয়েস্কার। দারুণ একটা প্রতি আক্রমণে রিয়াল রক্ষণ ফাঁকা হয়ে যায়। তবে জাভি গালানের গোলের সৌন্দর্যে এটা কোনো দাগ কাটতে পারছে না। বক্সের ঠিক বাইরে থেকে গোলা পাঠিয়েছিলেন। ঝাঁপানো থিবো কোর্তোয়াকে ফাঁকি দিতে দুরূহতম এক কোণ দিয়েই যেতে হয়েছে বলকে। এই গোলের আগে–পরে দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম পাঁচ মিনিটেই আরও দুটি গোল পেতে পারত উয়েস্কা। কিন্তু মিকেল রিকো ও রাফা মিরকে হতাশ করেছে গোলবার।
হতভম্ব রিয়াল মাদ্রিদ ম্যাচে ফেরে মার্কো আসেনসিওর সুবাদে। এতক্ষণ বাঁ প্রান্ত দিয়েই শুধু আক্রমণ করছিল রিয়াল। মাঠের মাঝ দিয়ে আক্রমণের ফসল আসেনসিও তুলে নিলেন এক ফ্রি কিক আদায় করে নিয়ে। ফ্রি কিকটা নিয়েছেন বেনজেমা। গোল হয়নি সেখান থেকে। বলটা লেগে ফিরেছে ক্রসবারে। কিন্তু এতটাই চমৎকার বাঁকানো শট ছিল, গোলরক্ষককে ঝাঁপাতেই হয়েছিল। বল নিচে আসতে আসতে উঠে জায়গায় ফেরার চেষ্টাও করেছিলেন গোলরক্ষক আলভারো। কিন্তু দৌড়ে আসা ভারান সে বলে মাথা ছুঁয়ে দেন। আলভারোর গায়ে লেগেই বল যায় জালে। ৫৫ মিনিটে স্কোর ১-১।
৫৯ মিনিটেই রিয়ালকে এগিয়ে দিতে পারতেন ভারান। কিন্তু এবার তাঁর হেড ঠিকই ফেরাতে পেরেছে উয়েস্কা। দুই মিনিট পরই রিয়ালের ত্রাতা হয়ে আসেন কোর্তোয়া। গোলদাতা গালান একটা মাপা ক্রস করেছিলেন। তা থেকে রাফা মির বুলেট গতির এক হেডও নিয়েছেন। কিন্তু কোর্তোয়া বাঁ হাত দিয়ে সেটা ঠেকিয়ে সে যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছেন রিয়ালকে। ৭০ মিনিটে মির আরেকটি সুযোগ নষ্ট করেছেন।
এর মধ্যেই একটি পরিবর্তন এসেছে মাঠে। ওদ্রিওসোলা চোট পাওয়ায় মার্সেলোকে মাঠে নামাতে বাধ্য হন জিদান। এই ব্রাজিলিয়ান মাঠে নামায় রিয়ালের আক্রমণের ধারও বাড়ে। পরের ১০ মিনিটে বেনজেমাকে নিশ্চিত দুটি গোল করতে দেননি উয়েস্কা গোলরক্ষক আলভারো। কিন্তু ভাগ্যের সঙ্গে তো আর লড়া যায় না।
ভাগ্যে লেখা ছিল, আজ শত চেষ্টাতেও গোল পাবেন না দুই দলের মূল দুই স্ট্রাইকার রাফা মির ও বেনজেমা। গোলের ভাগ্য দুই ডিফেন্ডার গালান ও ভারানের। সেই ভাগ্যই দুহাত উজাড় করে দিয়েছে ভারানকে। ১৩ মাস পর রিয়ালের জার্সিতে লিগে গোল করার দিনই পেয়ে গেলেন দ্বিতীয় গোল। ৮৩ মিনিটে দূরপাল্লার এক ফ্রি কিক নেন টনি ক্রুস। সেটা হেড করে ৬ গজের মধ্যে নামিয়ে দেন কাসেমিরো। উয়েস্কা গোলরক্ষক আলভারো ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরতি বল গিয়ে পড়ল ভারানের সামনে। ভারসাম্য হারাতে হারাতেও ঠিকই বল জালে পাঠিয়ে দিয়েছেন এই ডিফেন্ডার।
ম্যাচের বাকি সময়টা এই গোল অগ্রগামিতা ধরে রেখেছে রিয়াল। তাতেই এক দিনের জন্য হলেও লিগে আবার দুইয়ে উঠে এসেছে তারা।