ইংল্যান্ডের এই দলটা অন্য রকম। অন্তত প্রতিবার আমরা যে ধরনের ইংলিশ দল দেখি, তার চেয়ে তো বটেই। কোচ গ্যারেথ সাউথগেট বয়সে তুলনামূলক অনেক তরুণ। একঝাঁক প্রতিশ্রুতিশীল অথচ দুর্দান্ত কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে এবার বিশ্বকাপে এসেছে ইংল্যান্ড। কারও নামের পাশেই নেই মহাতারকার তকমা। তরুণ সাউথগেটের অধীনে এবার কি নিজেদের ভাগ্য বদলাতে পারবে ১৯৬৬-তে একবারই বিশ্বকাপ জেতা দলটি?
গ্যারেথ সাউথগেট যখন পৃথিবীতে এলেন, তার চার বছর আগেই বিশ্বকাপ জেতা হয়ে গেছে ইংল্যান্ডের। ১৯৭০ সালে জন্ম ইংল্যান্ডের বর্তমান কোচের। ববি মুরের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতেছে ১৯৬৬ সালে। বহু বছর পর এবারই ইংল্যান্ড এমন একজন কোচ পেয়েছে, যাঁর জন্ম ছেষট্টির বিশ্বকাপের পর। এই ‘তরুণ’ কোচের হাত ধরেই নতুন শুরুর স্বপ্ন দেখছে ইংল্যান্ড। কাল তিউনিসিয়াকে হারিয়ে দুই বিশ্বকাপ পর প্রথম জয়ের মুখ দেখেছে তারা। এবার লক্ষ্যটা অবশ্যই বড় কিছুর। শেষ মিনিটের গোলে পাওয়া এই জয়ের প্রতিটি মুহূর্তে বোঝা গেছে ইংল্যান্ডের হার-না-মানা মানসিকতা।
এমনটা তো হবেই। তরুণেরাই তো এমন মানসিকতার হয়। এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে তরুণ দল এই ইংল্যান্ডই। সবচেয়ে বড় বিষয়, অধিকাংশ খেলোয়াড়ই বড় কোনো ক্লাবের তারকা নন। আগে বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে দেখা যেত বড় বড় তারকার আধিক্য। বড় ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, চেলসি ও আর্সেনাল থেকেই নেওয়া হতো স্কোয়াডের অধিকাংশ খেলোয়াড়। সেই তথাকথিত তারকারা ইংল্যান্ডকে ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই এনে দিতে পারেননি। এবার সাউথগেটের বিশ্বকাপ স্কোয়াড আগের সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছে লক্ষণীয়ভাবে।
আগের স্কোয়াডগুলোতে খেলোয়াড়েরা কখনোই এককাট্টা হয়ে খেলতে পারেননি। দলে থাকত ব্যক্তিত্বের সংঘাত। স্টিভেন জেরার্ড, ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, জন টেরি, মাইকেল ওয়েন, ওয়েন রুনি, অ্যাশলি কোল এমনকি ডেভিড বেকহাম কিংবা পল স্কোলরাও সেই সমস্যা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে আসতে পারেননি। এবার লিনগার্ড, রাশফোর্ড, ডেলে আলি, রাহিম স্টার্লিং ও হ্যারি কেনদের মধ্যে সেই সমস্যা নেই।
কেন থাকবে? এই দলের অধিনায়কের কথাই ধরুন। টটেনহামের স্ট্রাইকার কেন এই দলের দায়িত্বে আছেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে ধরা হলেও তাঁকে নিয়ে মাতামাতি কিন্তু অনেক কম। অন্তত মেসি, রোনালদো ও নেইমারদের মতো তো নয়ই। নিদেনপক্ষে পগবা, গ্রিজমানদের মতো মাতামাতিও তো হয় না কেনকে নিয়ে।
দলের মূল গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড এভারটনে খেলেন, যে এভারটন সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে খুব একটা ভালো করতে পারেনি। বিকল্প গোলরক্ষকদের আনা হয়েছে বার্নলি (নিক পোপ) ও স্টোক সিটির (জ্যাক বাটল্যান্ড) মতো নিচু সারির দল থেকে। টটেনহাম কয়েক মৌসুম ধরেই সুন্দর ফুটবল উপহার দিয়ে গেলেও তাদের অর্জনের খাতা শূন্য। তবে এই টটেনহামের অধিকাংশ খেলোয়াড়কেই ইংল্যান্ড দলের সুযোগ দিয়েছেন সাউথগেট—এরিক ডায়ার, ডেলে আলি, ড্যানি রোজ, কিয়েরান ট্রিপিয়ের। লিভারপুল থেকে আছেন জর্ডান হেন্ডারসন ও ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড। চেলসি থেকে গ্যারি কাহিলের সঙ্গে আছেন অখ্যাত রুবেন লফটাস-চিক। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে হেসে লিনগার্ড, অ্যাশলি ইয়াং, ফিল জোন্স, মার্কাস রাশফোর্ডের মতো খেলোয়াড়েরা দলকে সমৃদ্ধই করেছেন। সিটি থেকে আছেন কাইল ওয়াকার ও জন স্টোনস। স্টোনসের সঙ্গে মূল একাদশের সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলানো হচ্ছে লেস্টার সিটির হ্যারি ম্যাগুইরেকে। এই খেলোয়াড়দের নিয়ে কখনোই কিন্তু খুব বেশি আলোচনা হয় না। এই খেলোয়াড়েরাই এবার সাউথগেটের তুরুপের তাস। ইংল্যান্ডের আরাধ্য বিশ্বকাপ-স্বপ্নের সারথি। সাউথগেট চান এই দলটাকে ডাকসাইটে ব্রিটিশ মিডিয়ার আলোকচ্ছটা থেকে যত সম্ভব দূরে রাখতে। প্রতিবার ইংল্যান্ডকে নিয়ে যে পরিমাণ মাতামাতি হয়, এবার না হয় একটু কম হলোই।
সাউথগেটের অধীনে ইংলিশদের খেলার ধরনেও এসেছে ভিন্নতা। তথাকথিত ইংলিশ স্টাইল থেকে সরে এসে এই সাউথগেটই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দলকে খেলানোর চেষ্টা করছেন। মরচে পড়া ৪-৪-২ ফরমেশনে না খেলিয়ে দলকে খেলাচ্ছেন ৩-৫-২ ফরমেশনে। যে ফরমেশনে দিয়েই এ মুহূর্তে ফুটবল দুনিয়ায় রাজত্ব করে যাচ্ছেন আন্তোনিও কন্তে, লুই ফন গাল, মরিসিও পচেত্তিনো, ম্যাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির মতো কোচরা। মূল একাদশের অধিকাংশ খেলোয়াড় টটেনহামের হওয়ার কারণে টটেনহাম কোচ পচেত্তিনোর মতো ৩-৫-২ ফরমেশন দিয়েই খেলিয়ে কেন, ডেলে আলী, ট্রিপিয়ের ও রোজদের সামর্থ্যের পুরোটুকু গ্রহণ করার চেষ্টা করছেন।
বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন আটকে গেলেও ইংল্যান্ড নিজেদের মিশন শুরু করেছে জয় দিয়েই। এই জয়যাত্রা তারা ধরে রাখতে পারে কি না, দেখার বিষয় এটিই।