>বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তারুণ্যের ডাক উপেক্ষা করেন কীভাবে! তাই ছুটে গেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের হয়ে খেলতে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে খেলতে খেলতে হয়ে গেছেন অবিস্মরণীয় এক ইতিহাসের অংশ। সেই ইতিহাসের বাঁকে দাঁড়িয়ে একেএম নওশেরুজ্জামান ফিরে গেলেন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ৪৭ বছর আগে কলকাতায় বসে প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীন হওয়ার খবরে নেচে ওঠেন আনন্দে। সে এক অমর গল্প। সত্তর দশকে ঢাকার মোহামেডানের এই নামী স্ট্রাইকার নিজের প্রিয় হাত ঘড়িটি ১০০ টাকায় বিক্রি করে খেলতে যান স্বাধীন বাংলা দলে।এ স্মৃতি চির অম্লান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম
প্রশ্ন: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আপনারা তো কলকাতায় ছিলেন। তা কীভাবে কখন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটা পেলেন?
একেএম নওশেরুজ্জামান: সন্ধ্যার দিকে দেখলাম কলকাতা শহরে...বোমা, পটকা ইত্যাদি ফাটানো হচ্ছে। তখনো বুঝতে পারিনি আসলে ঘটনাটা কি? দেশ এত তাড়াতাড়ি স্বাধীন হয়ে যাবে আমার কল্পনারও বাইরে। তখনই ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে দৌড়ে গেলাম আমরা কয়েকজন, যেখানে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট ছিল। ওখানে গিয়ে অবশ্য আমাদের কাউকেই পেলাম না। সবাই আনন্দ করতে করতে ডিনার বা এদিক-ওদিক চলে গিয়েছে। দেখলাম, ইন্ডিয়ান লোকেরা খুব ফুর্তি করছে। রাস্তাঘাটে নাচছে। কারণ, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।
প্রশ্ন:সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আপনাদের নিশ্চয়ই পাগলপারা অবস্থা। বিজয়ের আনন্দটা-ই বা কীভাবে উপভোগ করলেন?
নওশেরুজ্জামান: আনন্দের খবরটা জেনে আমাদের আর পায় কে! নাচানাচি শুরু। আমরা কিছু প্লেয়ার রাত ২-৩ টা পর্যন্ত কলকাতা শহরে ঘুরলাম, ফিরলাম, খেলাম। তবে আনন্দ করব কী, আমার মনের মধ্যে তখন কীভাবে দেশে যাব সেই আলোড়ন।
প্রশ্ন: এমনিতে ৪৭ বছর আগের সেই গর্বের ১৬ ডিসেম্বর সারা দিন আপনারা কলকাতা শহরে কী করছিলেন?
নওশেরুজ্জামান: ওই দিন আমাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। তাই আড্ডা, এটা-ওটা করে কাটিয়ে দিই। সন্ধ্যার সময়ই হঠাৎ খবর এল, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তখনই কলকাতায় আমার ভগ্নিপতি মেজর জেনারেল শামসুল হকের, (এরশাদ সরকারের সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রী। স্বাধীন বাংলা দলে মেডিকেলের ব্যাপারটা দেখতেন) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পেলাম না। ওনারা চলে গেছেন ডিনারে।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে তখন আর কে কে?
নওশেরুজ্জামান: স্বাধীন বাংলা দলের প্রতাপ দা (প্রতাপ শংকর হাজরা), এনায়েত, খোকন, সালাউদ্দিন, স্বাধীন বাংলা দলের ক্যাম্প কমান্ডার বদিউজ্জামান খসরু, যিনি আমার বড় ভাইও ছিলেন...এই কজনের কথা মনে আছে।
প্রশ্ন: এমন সুখে দিনে কোন স্মৃতিটা আপনার মনে সবচেয়ে বেশি গেঁথে আছে?
নওশেরুজ্জামান: মনে তো হাজারো স্মৃতির ভিড়। তবে সত্যি কথা বলতে পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করেছে শোনার পর থেকে আমার মনে হচ্ছিল, যদি পাখা থাকত তাহলে আমি এখনই উড়ে চলে আসতাম দেশে। এবং খুব দ্রুত চলেও আসি এপারে। যদিও সতীর্থরা বলল, কদিন দেরি করতে। আমি বললাম, ‘‘না ভাই, ঢাকা কোন দিকে আমাকে দেখিয়ে দাও। দরকার হলে হেঁটে চলে আসব।’’ এমন অস্থির হয়ে উঠি।
প্রশ্ন: নিজের স্বপ্নের ঠিকানা, মানে ঢাকায় এসেছিলেন কীভাবে?
নওশেরুজ্জামান: কলকাতা থেকে ট্রেনে বেনাপোল, তারপর বাসে যশোর, ঝিনাইদহ। মনে আছে, গোয়ালন্দে তখন চর। সেই চরের মধ্যে মাথায় সুটকেস নিয়ে হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে আরিচার ওপারে এসেছি। তখন আবার নৌকায় পার হয়েছি। বিরাট এক আরিচা। বাবা রে বাবা। এখন ভাবতেই ভয় লাগে। কী নৌকা দিয়ে আমরা পার হয়েছি আরিচা! আরিচায় এসে ভাত খেলাম। আইড় দিয়ে. এখনো স্পষ্ট মনে আছে। যাই হোক, ঝিনাইদহে এক রাত থেকে পরদিন সন্ধ্যায় ঢাকায়।
প্রশ্ন: অন্যরাও কী আপনার মতো অস্থির হয়ে দেশে এলেন?
নওশেরুজ্জামান: সবাই কম বেশি উতলা হয়ে ওঠে প্রিয় জন্মভূমির মাটির গন্ধ শুঁকতে। যারা দেরি করে এসেছে, তারা কেউ প্লেনে। কেউ বাস-ট্রেনে এসেছে।
প্রশ্ন: ঢাকায় এসেই তো আপনি মুন্সিগঞ্জের বাড়ি চলে গেলেন। সেও এক অনবদ্য গল্প...
নওশেরুজ্জামান: হুম...ঢাকায় সন্ধ্যার সময় এসেই আমার বড় বোনের সায়েন্স ল্যাবরেটরির কোয়ার্টারে গেলাম। তাঁকে বাসায় পাইনি। ছিলেন বড় বোনের দেবর। তো ওই বাসা থেকে রিকশায় বের হয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে যাই। তখন স্টেডিয়ামে ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের বাচ্চুর সঙ্গে দেখা। সে আমার সব কথা শুনে খুশি হলো ভালোভাবে ফিরে আসতে পারায়।জড়িয়ে ধরে কাঁদলও। বাচ্চু বলল, ‘‘নওশের ভাই আপনি চলে যান। এখানে অবস্থা অত ভালো নয়। কে কখন কাকে কী করে! হাইজ্যাকিং-টাইজ্যাকিং হতে পারে।’’ আমি চলে এলাম সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বোনের বাসায়। রাতে আর ঘুম হয়! ভোরে উঠেই মুন্সিগঞ্জের দিকে রওনা হই আমি আর আমার আমার বড় ভাই বদিউজ্জামান খসরু।
প্রশ্ন: প্রিয়জনেরা এত দিন পর কাছে কাছে পেয়েছে আপনাদের। সেই ক্ষণটা কেমন ছিল?
নওশেরুজ্জামান: অনন্য, অসাধারণ। মুন্সিগঞ্জ শহরে আমাদের বাসা ছিল ব্রিজের গোড়ায়। ব্রিজের ওপর থেকেই আমি আম্মা বলে হাঁক দেই। আম্মা তখন অসুস্থ। আমার ডাক শুনে আম্মাকে আব্বা বললেন, ‘‘ওই যে আইস্যা গেছে। আমার মেঝ ছেলের ডাক এটা।’’ তখন আমার বড় বোন ওখানেই ছিল। তো যাই হোক, যে আম্মা ৭ দিন ধরে বিছানায়, তিনি ছেলেদের ফিরে আসার আনন্দে সারা দিন রান্নাবান্না করলেন। সবাই মিলে খেলাম। মুন্সিগঞ্জের লোক যারাই শুনেছে আমাদের ফেরার কথা, দৌড়ে এল বাসায়। এ এক অবিস্মরণীয় এক গল্প।
প্রশ্ন: আপনি আপনার বন্ধুর মুখে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের কথা প্রথম জানতে পারেন। সেটা আসলে কীভাবে?
নওশেরুজ্জামান: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমারই বন্ধু বাবুল আখতারের (মারা গেছেন) কণ্ঠে প্রথম শুনি, ওপারে ফুটবল দল গড়ার ডাক দেওয়া হয়েছে। পরপরই মের শুরুর দিকে চলে যাই আগরতলা। কায়কোবাদ ভাইয়েরা এসে নিয়ে গেলেন।
প্রশ্ন: কীভাবে গিয়েছিলেন? টাকা পয়সা কিছু ছিল?
নওশেরুজামান: টাকা পাব কোথায়! আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি জীববিজ্ঞানে। তখন আমার বিখ্যাত ফেভার লুবা ব্র্যান্ডের একটা একটা ঘড়ি ছিল, পাকিস্তান আমলে যেটির দাম ছিল ২০০/২৫০ টাকা। আমার আব্বার এক বন্ধু মানে কাকার কাছে সেটা ১০০ টাকায় বিক্রি করে স্বাধীন বাংলা দলে খেলতে চলে যাই। ফিরে এসে অবশ্য কাকাকে ১০০ টাকা দিয়ে দেই। কাকা বলেন, ‘‘নে তোর ঘড়ি নে ( হা হা)।’’
প্রশ্ন: ভারতে আপনারা ১৬টি ম্যাচ খেলেন। জয় ১২টিতে। কেমন ছিল সেই গর্বের স্মৃতিগুলো?
নওশেরুজ্জামান: এই যাত্রার প্রথম দিনে কৃঞ্চনগরে ২৪ জুলাই যে খেলাটা হলো, সেটির স্মৃতিই বেশি জ্বলজ্বলে। আমাদের জীবনে তা সত্যিই চির অম্লান থাকবে। আমরাই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ফুটবল দল, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য এভাবে ফুটবল ম্যাচ খেলে খেলে লড়াই করেছে। ভারতের জাতীয় পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলেছে। দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজেছে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। এটাই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমরা মুম্বাই, বেনারশ, কলকাতা ( কলকাতার গোস্টপাল একাদশ) বর্ধমান, মালদহ, পুনে, দূর্গাপুরসহ অনেক জায়গায় খেলেছি। অনেক টাকা উঠেছিল ( সাড়ে তিন লাখ রুপি, ৫ লাখ টাকা)। এখান থেকে কিছু টাকা আমাদের ভরন পোষণে খরচ হয়েছে। বাকিটা মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে গিয়েছে।
প্রশ্ন: দুর্ধর্ষ এক ইতিহাসের উজ্জ্বল চরিত্র হয়ে আছেন আপনারা। কিন্তু আজও স্বাধীন বাংলা দলটি স্বাধীনতা পদক পেল না! এটা ভাবলে কেমন লাগে?
নওশেরুজ্জামান: দুঃখ হয়, কষ্ট লাগে। আমাদের অনেকেই চলে গেছে। বাকিরাও যাওয়ার পথে। সবাই তো সত্তরের কোটায়। আমরা তরুণ বয়সে ইতিহাস রচনা করছি। অথচ আজও স্বাধীনতা পুরস্কারটা পেল না স্বাধীন বাংলা দল। তবে এটুকু বাদে আমরা খুব খুশি দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখতে পেরে। ১৬ ডিসেম্বর এলে আমি আপ্লুত হয়ে যাই। তরুণ বয়সে সেই রক্ত গরম করা দিন, কোনো দ্বিধা না করেই স্বাধীন বাংলা দলে খেলতে চলে যাওয়া...আহা বিজয়ের সেই দিনটাকে খুব মিস করি!