আরামবাগ ক্লাবের সামনে দিয়ে হাঁটলে আগে অস্বস্তি লাগত। নানা ধরনের লোকজন জুয়া খেলায় ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। সাড়ে চার বছর আগে ক্লাবটি ক্যাসিনোর স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর থেকে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের চারপাশ শান্ত। মতিঝিলের ব্যস্ত এলাকায় আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সেলুন, ফটোস্ট্যাট, রড-সিমেন্ট, লোহা-লক্কড়ের দোকানের ফাঁক গলে প্রায় ১৫ কাঠার ওপর তালাবদ্ধ নীরব দোতলা ক্লাব ভবন। ৬২ বছরের পুরোনো ক্লাবটি যেন আজ একরাশ লজ্জায় ন্যুব্জ।
ক্লাবের এই লজ্জার দায় অনেকেরই। তবে মূল ব্যক্তিটি হচ্ছেন সভাপতি মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। ২০১৬ সালে সভাপতি হয়ে ক্লাবটিতে ক্যাসিনো বসান তিনিই। যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে এলাকায় তাঁর দাপট ছিল অনেক। তাঁর আগে আরামবাগের সভাপতি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান। মূলত নেতৃত্ব বদলেই এই পতন আরামবাগের। টাকা হয়ে ওঠে ক্লাবটির কাছে ‘তেজপাতা’।
জুয়া-ক্যাসিনোর অঢেল টাকায় মমিনুলের প্রথম চমক, ফুটবল কোচ সাইফুল বারীকে ৩০ লাখ টাকায় নেওয়া। অথচ আরামবাগে এর আগে কোচের পারিশ্রমিক ছিল বছরে বড়জোর চার-পাঁচ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ৫ কোটি টাকায় ফুটবল দল গড়েন মমিনুল। বড় ম্যাচ জিতলে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা বোনাস, বড় ম্যাচ ড্র করলেও বোনাস-আরও কত-কী! তিনিই ঢাকার ফুটবলে প্রথম আরামবাগের ফুটবলারদের পারফরম্যান্স নির্ধারক জিপিএস মেশিন আনেন বিদেশ থেকে। কোচ মারুফুল হক ২০১৭-১৮ মৌসুমে চুক্তিবদ্ধ হন ৩৫ লাখ টাকায়।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁর ইচ্ছা ক্লাবটাকে লিমিটেড করা। তত দিনে মাঠের সাফল্যও আসছিল। ২০১৬ সালে আরামবাগকে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে তোলেন সাইফুল বারী। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশি ফুটবলারদের টুর্নামেন্ট স্বাধীনতা কাপে আরামবাগ চ্যাম্পিয়ন হয় মারুফুলের হাত ধরে, ক্লাবটির ইতিহাসে যা প্রথম চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। মারুফের সঙ্গে ২০১৯ সালে আরামবাগের চুক্তি হয় ৫০ লাখ টাকায়। কিন্তু ক্যাসিনো-কাণ্ডে সবই শেষ। ক্লাবটি দুঃসময়ের ঘেরাটোপে ঢুকে যায়। মমিনুল গা ঢাকা দেন। বর্তমানে তিনি কলকাতায় আছেন।
কাগজ-কলমে সাঈদ এখনো আরামবাগের সভাপতি। তবে ক্যাসিনো-কাণ্ডের সপ্তাহ দুয়েক পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি এজাজ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। মাস কয়েক আগে ক্লাবের নতুন কমিটি করে স্থানীয় থানায় জমা দিতে বলা হয়েছে। ক্লাব এখন কমিটি তৈরির প্রক্রিয়া করছে। ডিসেম্বরে শুরু নতুন ফুটবল মৌসুমের জন্য পৃষ্ঠপোষকেরও খোঁজ চলছে। একটি প্রতিষ্ঠানের আশ্বাসে নতুন মৌসুমের ফুটবল দল নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুটা কমেছে। পৃষ্ঠপোষক এলে নতুন সভাপতি পেতে পারে ক্লাবটি।
মমিনুল ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের অন্যতম সহযোগী। দেদার টাকা খরচ করে অল্পদিনেই পরিচিতি পান ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে। তবে গত জানুয়ারিতে সিটি নির্বাচনে ওই এলাকায় মোজাম্মেল হক স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হলে মুমিনুলের রাজত্বের ইতি ঘটে। মোজাম্মেল জুয়া-ক্যাসিনোবিরোধী বলে জানান এলাকার লোকজন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমি ক্রীড়া সংগঠক না হলেও ক্লাবকে ক্রীড়া কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে দেখতে চাই। এটাই আমার লক্ষ্য।’
‘ক্লাবে রাজনীতি ঢুকলে সব শেষ। কিছু ব্যক্তির লোভ-লালসা ক্লাবের জন্য ক্ষতিই ডেকে আনে। জুয়া, ক্যাসিনো ক্লাবের সর্বনাশ করেছে।’এস এ সুলতান, সাবেক সভাপতি আরামবাগ
জুয়া-ক্যাসিনোর কলঙ্ক মুছে নতুনভাবে শুরু করতে চায় আরামবাগ। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী গত এক বছরের অনেক দুঃখের কথা শুনিয়ে শেষে বললেন, ‘আমাদের একটাই কাজ এখন, ঘুরে দাঁড়ানো।’ টাকার অভাবে গত মৌসুমে প্রিমিয়ারের ফুটবল দল গড়াই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে আরামবাগের। ক্লাবের নিজস্ব সম্পদ ৩০টি দোকান থেকে ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে পাওয়া দেড় লাখ টাকায় কিছুই হয় না। শেষমেশ ‘বন্ধু’ ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের দেওয়া ৬০-৭০ লাখ টাকা সহায়তায় দল গড়ে আরামবাগ। দলবদলের শেষ দিনে হয়েছিল খেলোয়াড় নিবন্ধন। ক্লাব বন্ধ থাকায় এক কর্মকর্তার বাসায় হয় দলবদলের কাজ।
ক্লাবে ক্লাবে চুরির অভিযোগ: ক্যাসিনো-কাণ্ডে তালাবদ্ধ ক্লাবগুলোয় চুরির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আরামবাগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দাবি, ‘ক্লাব বন্ধ থাকায় ক্লাবের এসি, সোফা, টেবিলসহ অনেক কিছু চুরি হয়ে গেছে। আমরা বিষয়টি থানায় জানিয়েছি।’ ভিক্টোরিয়ার যুগ্ম সম্পাদক (ক্রীড়া) নুরুজ্জামানের কথা, ‘চোর আমাদের ক্লাবে ঢুকে ভালো শিল্ড, কাপ, ট্রফি এমনকি দরজা-টরজাও খুলে নিয়ে গেছে। ক্লাবের কিছুই নাকি নাই।’ ওয়ান্ডারার্সের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবাদুল ইসলামও ক্লাবে চোর ঢুকে এসিসহ এটা-ওটা খুলে নিয়ে গেছে বলে মতিঝিল থানায় অভিযোগ করার কথা জানান। ইয়ংমেনস ক্লাবের ফুটবল দলের সহকারী ম্যানেজার এম এইচ পিপুল বলেন, ‘আমাদের ক্লাবে তো কিছুই নেই। করোনার সময় চোর সব নিয়ে গেছে ভেতরে ঢুকে। থানায় জিডি করা হয়েছে।’ তবে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসির আরাফাত এমন কোনো অভিযোগ পাননি বলে প্রথম আলোকে জানান।
নয়াপল্টনে তিনটি ভাড়া ফ্ল্যাটে রাখা হয় খেলোয়াড়দের। তার আগে কমলাপুর স্টেডিয়ামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কিছুদিন ক্যাম্প চলে। ক্লাবের নিচতলা তালাবদ্ধ থাকলেও দোতলায় অফিস বা খেলোয়াড়দের থাকার জায়গায় চাইলে যাওয়া যেত। গত মে মামে বিদেশি ফুটবলারদের নিয়ে দোতলার অফিসে বসেন কর্মকর্তারা। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এজাজ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের, ‘ওপরে বসার সঙ্গে সঙ্গে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি এসে বলেন, আপনারা অফিস খুলেছেন। এটা ঠিক নয়। তাই আমরা আর সেখানে বসি না।’
ক্লাব খুলতে থানায় আবেদন করলেও সাড়া নেই বলে জানালেন আরামবাগের কর্মকর্তারা। হতাশ ভারপ্রাপ্ত সভাপতির কথা, ‘থানায় গেলে ওপরে যোগাযোগের কথা বলে। ওপরে গেলে বলে “দেখছি”। এটা যে কোথায় আটকানো, কেউ জানে না।’ নিজেদের বাসাবাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসে ক্লাব চালানো আর কত দিন, প্রশ্ন তোলেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করলে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘এটা তো অনেক বড় ব্যাপার। থানা সিদ্ধান্ত দেবে না। এ ব্যাপারে কেউ আমার কাছে আসেনি।’ শেষ ভরসা এখন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের আশ্বাস। ৩ অক্টোবর বাফুফের নির্বাচনের পর তিনি বন্ধ ক্লাবগুলোকে খোলানোর চেষ্টা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আমান আহমেদ চৌধুরী। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান বেবীর বাসায় অনেক বছর কার্যক্রম চলে ক্লাবের। ক্লাবের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্লাবে জুয়া-হাউজি থাকা উচিত নয়। এটা যেমন ঠিক, তেমনি এখন ক্লাবগুলো খুলে দেওয়া দরকার।’ ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্লাবটির সভাপতি বাফুফের সাবেক সভাপতি এস এ সুলতানও এ পরিস্থিতিতে ব্যথিত, ‘ক্লাবে রাজনীতি ঢুকলে সব শেষ। কিছু ব্যক্তির লোভ-লালসা ক্লাবের জন্য ক্ষতিই ডেকে আনে। জুয়া, ক্যাসিনো ক্লাবের সর্বনাশ করেছে।’