রিয়াল মাদ্রিদ ‘অধিপতি’ ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ ও চেলসি ‘বাদশা’ রোমান আব্রাহামোভিচের বদৌলতে নিকট অতীতে বেশ কিছু কোচকে চাকরি হারাতে দেখেছে ফুটবল-বিশ্ব। তবে দলের খেলোয়াড়দের অনাস্থায় পড়ে চাকরি হারানো সর্বশেষ কোচ হলেন কার্লো আনচেলত্তি। সদ্য সাবেক বায়ার্ন মিউনিখ কোচের ঘটনা ধরে দেখে নেওয়া যাক আলোড়ন তোলা কিছু কোচ-খেলোয়াড় দ্বন্দ্ব।
রেমন্ড ডমেনেখ
খেলোয়াড় বিদ্রোহের প্রথম বড় ঘটনা ছিল এটাই। ২০১০ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের ভরাডুবির নেপথ্যে ডমেনেখের একগুঁয়েমিকে দায়ী করেন অনেকেই। চূড়ান্ত পর্বে উরুগুয়ের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ের পর মেক্সিকোর বিপক্ষে ২-০ গোলে হেরে বসে ফরাসিরা। পরদিন অনুশীলনে অধিনায়ক প্যাট্রিস এভরা ও ট্রেনার রবার্ট ডুভার্নের ঝগড়া বাঁধে। ডমেনেখ নিজ হাতে আটকান ডুভার্নকে। প্রতিবাদে অনুশীলন ত্যাগ করেন খেলোয়াড়েরা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২-১ গোলে হার দিয়ে ফ্রান্সের দায়িত্ব শেষ করেন এই কোচ। নিজেই দায়িত্ব ছাড়লেও তাঁর ওপর দলের অনাস্থার খবর প্রকাশ্যে এনেছিলেন খেলোয়াড়েরাই।
হোসে মরিনহো
পোর্তোকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে চেলসিতে এসে নিজেকে ‘স্পেশাল ওয়ান’ হিসেবে দাবি করেছিলেন হোসে মরিনহো। শিরোপা জিতলেও আব্রাহামোভিচের খামখেয়ালিতে প্রথমবার চাকরি হারান। রিয়ালের হয়ে লা লিগা জিতলেও ২০১৩-১৪-তে দ্বিতীয়বার স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের দায়িত্ব নিয়ে নিজেকে সুখী (হ্যাপি ওয়ান) দাবি করেছিলেন এই পর্তুগিজ। সময়টাও ভালোই কাটছিল, এক মৌসুম পরই ইংল্যান্ড-সেরা হয় চেলসি। কিন্তু লেস্টার রূপকথার ১৫/১৬ মৌসুমে দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান। শুরুটা মরিনহোর হাত ধরেই, প্রথম দুই ম্যাচ জয়হীন থাকার দোষ চাপান হ্যাজার্ড, টেরি, কাহিল, ইভানোভিচের মতো সিনিয়র খেলোয়াড়দের ঘাড়ে। লেস্টারের হাত ধরে মৌসুমের ১১তম পরাজয়ের পর পুরো দলের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ডিসেম্বরেই তাঁকে পুনরায় বরখাস্ত করা হয়। ‘পারস্পরিক সমঝোতা’র কথা বললেও পরের ম্যাচেই সান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে চেলসির ৩-১ গোলের জয় দেখলেই বোঝা যায় দলের আস্থা হারিয়েছিলেন মরিনহো।
ক্লদিও রানিয়েরি
২০১৫-১৬ মৌসুমে লেস্টার সিটি রূপকথার নেপথ্যের নায়ক পরের মৌসুমেই চাকরি হারিয়েছিলেন দলীয় কোন্দলে। প্রথমবার দায়িত্ব নিয়েই আগের মৌসুমে অবনমন থেকে বেঁচে আসা লেস্টারকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন। ইংলিশ ফুটবলের ‘টিংকার ম্যান’ মুগ্ধ করেছিলেন তাঁর সরলতা ও শিশুসুলভ সারল্যে। সংবাদ সম্মেলনে সদা হাস্যোজ্জ্বল ইতালিয়ান ‘বুড়ো’র খেলোয়াড় উজ্জীবিত করার ‘ডিলি ডিং’ ‘ডিলি ডং’ মন্ত্রটাও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ইপিএলে। ১৫-১৬ মৌসুমের সুখী পরিবার লেস্টার পরের মৌসুমেই লিগে মুখ থুবড়ে পড়ে। আগের মৌসুমের নায়ক জেমি ভার্ডি, রিয়াদ মাহরেজ ও ক্যাসপার স্মাইকেলের উসকানিতে পুরো দলই রানিয়েরির কৌশলে অনাস্থা প্রকাশ করে। খেলোয়াড়দের নতুন ফেবারিট ক্রেইগ শেক্সপিয়ারকে ম্যানেজার বানিয়ে রানিয়েরিকে বরখাস্ত করা হয়। ভার্ডি-স্মাইকেল অস্বীকার করলেও বেশির ভাগ ব্রিটিশ মিডিয়ার মতে তাঁদের ইন্ধনেই চাকরি হারিয়েছেন রানিয়েরি।
কার্লো আনচেলত্তি
সর্বোচ্চ ৪ বার ফাইনাল খেলে ৩ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা কোচকে দুদিন আগে বরখাস্ত করেছে বায়ার্ন মিউনিখ। এর আগে এসি মিলানকে ২ বার ইউসিএল জিতিয়েছিলেন, রিয়ালকে এনে দিয়েছিলেন বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘লা দেসিমা’। পেপ গার্দিওলার পর বায়ার্নের দায়িত্ব নিয়ে বুন্দেসলিগা জিতলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হয়নি তাঁর। চলতি মৌসুমে লিগে শীর্ষস্থান হারিয়েছে বাভারিয়ানরা, পিএসজির হাতে ধরাশায়ী হয়েছে ৩-০ গোলে। এরপর আরিয়েন রোবেন সরাসরি সমালোচনা করেছেন কোচের। স্প্যানিশ দৈনিক মার্কার মতে, রোবেনসহ ৫ খেলোয়াড়ের আস্থা হারিয়েছিলেন কার্লো। তাঁরা হলেন থমাস মুলার, জেরোমে বোয়াটেং, আরিয়েন রোবেন, ফ্রাঙ্ক রিবেরি ও অন্য একজন। পঞ্চম বিদ্রোহী খেলোয়াড় হতে পারেন রবার্ট লেভানডফস্কি, ম্যাট হামেলস কিংবা কিংসলে কোম্যান। জানুয়ারি দলবদলেই হয়তো নতুন কোনো দলের দায়িত্বে দেখা যাবে আনচেলত্তিকে।
দলে কোচদের একচ্ছত্র আধিপত্যের দিন শেষ। এখন শীর্ষ তারকাদের মন জুগিয়ে চলতে হয় ম্যানেজারদের। রাফা বেনিতেজ রিয়ালে এসেই রোনালদোর সমর্থন হারানোর মূল্য দিয়েছেন ৬ মাস পর। নেইমার-কাভানির শিশুসুলভ ঝগড়া সামলাতে কোচ উনাই এমেরির রক্ষণাত্মক কৌশলই প্রমাণ করে দলের সাফল্য কিংবা সমন্বয়ের পাশাপাশি নিজের চাকরির প্রতি ভালোই মনোযোগী হচ্ছেন কোচরা। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন কিংবা লুই আরাগোনেজের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কোচরা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। সূত্র: মার্কা, টেলিগ্রাফ, মিরর, ডেইলিস্টার ইউকে।