কী দুর্দান্ত এক ম্যাচ হলো গতকাল!
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ফার্গুসন-ওয়েঙ্গার, ফার্গুসন-মরিনিও, মরিনিও-ওয়েঙ্গার, গার্দিওলা-মরিনিওর কৌশলগত দ্বৈরথের কথা তো সবারই জানা। লিগ শিরোপা জয়ের পথে এ কয়েকজন কোচই ঘুরেফিরে প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলের মান উন্নত করেছেন, নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে নিজের দলকে এগিয়ে রেখেছেন বা রাখার চেষ্টা করেছেন। গত কয়েক মৌসুম ধরে যে কাজটা বেশ দায়িত্ব নিয়ে করে যাচ্ছেন লিভারপুলের ইয়ুর্গেন ক্লপ আর ম্যানচেস্টার সিটির পেপ গার্দিওলা। বলা বাহুল্য, প্রতিবারই দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে, নতুন কিছু উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এই দুই কোচের দ্বৈরথ ‘লেটার মার্কস’ পেয়েই পাশ করছে। এই দুই কোচের একেক ম্যাচ নিয়ে যেন চাইলে ‘থিসিস পেপার’ লেখা যায়!
গার্দিওলা-ক্লপ দ্বৈরথের সর্বশেষ অধ্যায় রচিত হয়েছে গতকাল। আর কী দুর্দান্তভাবেই না রচিত হলো তা! ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’— আসলেই ক্লপ আর গার্দিওলা কেউ কাউকে ছাড় দেননি। ২-২ গোলে ম্যাচ ড্র হয়েছে, হয়েছে পয়েন্ট ভাগাভাগি। দুই পয়েন্ট হারানোর দুঃখ দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে থাকলেও নিরপেক্ষ ফুটবলপ্রেমীদের কাছে ম্যাচটা আসলেই আনন্দদায়ী ছিল।
লিভারপুলের মাঠে খেলতে এলে সব কোচকেই বাড়তি চিন্তাভাবনা করে আসতে হয় — গার্দিওলাও ব্যতিক্রম নন। সেই বাড়তি চিন্তার প্রভাব দেখা গেল কালও। ৪-৩-৩ ছকে দলকে মাঠে নামানো গার্দিওলা সবচেয়ে বড় চমকটা দিয়েছেন আক্রমণভাগে। গত সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়া দলবদলের বাজারে হন্য হয়ে একজন স্ট্রাইকার খুঁজেছিলেন গার্দিওলা, পাননি। টটেনহাম থেকে হ্যারি কেইনকে আনার জন্য তাঁর মাথার ঘাম পায়ে ফেলা কার অজানা! কিন্তু অ্যাস্টন ভিলার মিডফিল্ডার জ্যাক গ্রিলিশের পেছনে ১০ কোটি পাউন্ড খরচ করা আর টটেনহামের সভাপতি ড্যানিয়েল লেভির কেইনকে বিক্রিতে অসম্মতি জানানো — সবকিছু মিলিয়ে নতুন স্ট্রাইকার আর আনা হয়নি ম্যানচেস্টার সিটির।
সে কারণেই কি না, সুযোগ পেলেই স্ট্রাইকার ছাড়াই সিটিকে নামিয়ে দিচ্ছেন গার্দিওলা। গত দুই ম্যাচে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছিলেন দুই ইংলিশ উইঙ্গার ফিল ফোডেন ও রহিম স্টার্লিং। গতকাল তো কখনো স্ট্রাইকার হিসেবে না খেলা দশ কোটির গ্রিলিশকেই নামিয়ে দিলেন স্ট্রাইকার হিসেবে! যদিও ম্যাচের শুরুতে খেলোয়াড়দের তালিকা দেখে মনে হচ্ছিল গ্রিলিশ যথারীতি লেফট উইংয়েই খেলবেন, আর গত সপ্তাহে চেলসির বিপক্ষে ম্যাচটার মতো ফোডেনকে দেখা যাবে স্ট্রাইকার হিসেবে।
কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে গার্দিওলা গ্রিলিশকে রাখলেন স্ট্রাইকার হিসেবে, ওদিকে ফোডেন খেললেন লেফট উইঙ্গার হিসেবে। ডানদিকের উইংয়ে ছিলেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার গাব্রিয়েল জেসুস। কেইনের না আসা ও সের্হিও আগুয়েরো চলে যাওয়ার কারণে জেসুসেরই মূলত একক স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার কথা। তবে গত এক বছর ধরেই জেসুস বোঝাচ্ছেন, স্ট্রাইকার হলেও উইংয়ে খেলতেই স্বচ্ছন্দ তিনি। বল যতক্ষণ তাঁর পায়ে থাকে, ভালো খেলেন।
বল পায়ে রাখতে পছন্দ করেন গ্রিলিশও, যেহেতু তিনি মূলত মিডফিল্ডার। বলতে গেলে তাঁর এই গুণটাই হিতে বিপরীত হয়েছে ম্যানচেস্টার সিটির জন্য। স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানোর জন্য এমন একজনকে দরকার, যাঁর গোল করার ক্ষুধাটা আছে, ছোট্ট একটা সুযোগেও গোল বরাবর শট নিয়ে গোল বের করে আনতে পারেন, প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পেছনে ফাঁকা জায়গাগুলোয় চাপ বিস্তার করতে পারেন, হুটহাট ঢুকতে পারেন বক্সে। গ্রিলিশ এই কাজগুলোর একটাও করতে পারেননি ঠিকঠাক। আবার এই কাজগুলোই গ্রিলিশের চেয়ে ভালোভাবে করতে পারেন ফিল ফোডেন।
স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার সময় উল্টো মিডফিল্ডারদের মতো বাড়তি পাসনির্ভর ফুটবল খেলছেন গ্রিলিশ, যে কারণে লিভারপুলের ডিফেন্ডাররা তাঁকে আটকাতে যথেষ্ট সময় পেয়েছেন বারবার। দ্বিতীয়ার্ধে গ্রিলিশকে উঠিয়ে শেষমেশ রাহিম স্টার্লিংকে খেলানো হয়। গ্রিলিশের চেয়ে স্টার্লিং দ্বিতীয়ার্ধে যথেষ্ট ভালো খেলেছেন, যদিও স্টার্লিং নিজেও স্ট্রাইকার নন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, স্ট্রাইকার যেহেতু খেলানো হচ্ছে না, সেহেতু কেন গ্রিলিশকে বাঁয়ে রেখে ফোডেনকে স্ট্রাইকারের ভূমিকা দেওয়া হলো না? এখানেই সুবিধাটা পেয়েছেন গার্দিওলা। স্ট্রাইকারের ভূমিকায় খেলা গ্রিলিশ ফলস নাইনের মতো নিচে নেমে যাচ্ছিলেন, ফলে লিভারপুলের রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ফাবিনিও তাঁকে মার্ক করছিলেন বেশিরভাগ সময়। গ্রিলিশ যেহেতু বক্সে সেভাবে ঢুকতে পারছিলেন না, এই অভাবটা পুরোপুরি মিটিয়েছেন সিটির দুই উইঙ্গার ফোডেন আর জেসুস — বিশেষ করে ফোডেন।
ফোডেনকে স্ট্রাইকার হিসেবে না খেলিয়ে লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলানোর একটাই কারণ, সে প্রান্তে তাঁকে আটকানোর কাজটা করছিলেন লিভারপুলের রাইটব্যাক জেমস মিলনার। চোটের কারণে লিভারপুলের নিয়মিত রাইটব্যাক ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ড খেলতে পারেননি এই ম্যাচে। তাঁর জায়গায় নামান হয় বয়সী মিলনারকে। অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ডের অনুপস্থিতিতে ওই উইং দিয়ে বেশি আক্রমণ করার কৌশল নিয়েছিলেন গার্দিওলা। সে কৌশলে সফলই হয়েছেন, বলা যায়।
বাজে ট্যাকলের জন্য একবার হলুদ কার্ড দেখেছেন মিলনার, লাল কার্ডও দেখতে পারতেন। ম্যাচের আগে ইয়ুর্গেন ক্লপ বলেছিলেন, মিলনারকে রাইটব্যাক হিসেবে খেলানো হলে তিনি এমন এক পথ বের করবেন, যেখানে সিটির লেফট উইঙ্গারকে আটকে রাখাতে মিলনার তিন মিডফিল্ডারের ডানদিকে থাকা মিডফিল্ডারের সাহায্য পান। যে ভূমিকায় এ ম্যাচে ছিলেন অধিনায়ক জর্ডান হেন্ডারসন। কিন্তু দুজনই রক্ষণকাজে ভালো করতে পারেননি। গোটা ম্যাচ জুড়ে মিলনারকে তটস্থ রেখেছিলেন ফোডেন। শেষমেশ মিলনার যাতে লাল কার্ড না দেখেন, সে কারণে তাঁর জায়গায় জো গোমেজকে নামান হয়। ম্যাচ শেষে দুজন অনেকক্ষণ একজন আরেকজনের কাঁধে হাত দিয়ে সুখ-দুঃখের আলাপ করেছেন। ওই দৃশ্য দেখে কে বলবে, মিলনারকে গোটা ম্যাচ কী যন্ত্রণাটাই না দিয়েছেন ফোডেন!
দুই দলই খেলেছে ৪-৩-৩ ছকে। প্রথমার্ধের শুরু দিকে সিটির আক্রমণভাগ গত সপ্তাহের মতো অতটা চাপ তৈরি করেনি। আক্রমণভাগের তিনজন অত বেশি ছড়িয়ে না থেকে মাঝে চলে আসছিলেন বারবার। গত সপ্তাহে চেলসির ডিফেন্ডারদের যেভাবে আলাদা আলাদা ভাবে ‘মার্ক’ করছিল সিটি, এ ম্যাচে অতটা দেখা যায়নি। যে কারণে রক্ষণ থেকে বল বের করে মাঝমাঠ পর্যন্ত চলে আসার কাজটা ভালোভাবে করতে পারছিলেন লিভারপুলের ক্যামেরুনিয়ান সেন্টারব্যাক জল মাতিপ। কিন্তু সেখানে এসেই সিটির মানসম্পন্ন মিডফিল্ডের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছিল লিভারপুল। কার্টিস জোন্স আর জর্ডান হেন্ডারসনের মাঝমাঠ ভেদ করে প্রায়ই বল নিয়ে যাচ্ছিল সিটির মাঝমাঠে থাকা খেলোয়াড়েরা।
ওদিকে সিটির আক্রমণভাগ যে প্রথমার্ধের শুরুর দিকে লিভারপুলের ওপর চাপ তৈরি করেনি, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন গার্দিওলা। যে কারণে কিছুক্ষণ পর ফোডেন, গ্রিলিশ আর জেসুসকে দেখা যায় আক্রমণভাগের তিন প্রান্তে আলাদা আলাদা ভাবে প্রেস করতে, লিভারপুলের ডিফেন্ডারদের পেছনে প্রেস করে সুযোগ সৃষ্টি করতে। আগেই বলা হয়েছে, যে কাজটা দুর্দান্তভাবে করতে পারেন ফোডেন, আর ঐ কৌশল থেকেই আরেকটু হলে গোল পেয়ে যাচ্ছিল সিটি।
মাঝমাঠে একজন বাড়তি খেলোয়াড়ের অভাব ভুগিয়েছে লিভারপুলকে প্রথমার্ধে। থিয়াগো আলকানতারার মতো মানসম্পন্ন খেলোয়াড় ছিলেন না, অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ড তো ছিলেনই না — যিনি রাইটব্যাক হলেও ক্লপের কৌশলে বল পায়ে থাকলে অধিকাংশ সময়ে মাঝমঠে চলে আসেন। সে সুবিধাটা এই ম্যাচে লিভারপুল পায়নি। হেন্ডারসন, জোন্সের কেউই ওই বাড়তি ‘প্রেস’ (চাপ তৈরি) করতে পারছিলেন না। ওদিকে এমনিতেই বের্নার্দো সিলভাকে প্রেস করে দমিয়ে রাখা যায় না, ড্রিবল করে বেরিয়ে চলে যান, তার ওপর হেন্ডারসনদের প্রেস নিয়ে সংশয়ের কারণে গোটা বলতে গেলে মাঝমাঠে ছড়ি ঘুরিয়েছেন বের্নার্দো। মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে লিভারপুলের আক্রমণভাগে থাকা সালাহ, মানে, জোতারা কেউই প্রথমার্ধে বলের নাগাল পাচ্ছিলেন না সেভাবে।
প্রথমার্ধে চাপ তৈরি করে খেলা নিয়ে জটিলতা দ্বিতীয়ার্ধে মিটিয়ে ফেলে লিভারপুল। আর তখনই একটু ভড়কে যায় সিটি। সামনে ফাঁকা জায়গাগুলোয় ‘প্রেস’ করার কাজটা প্রথমার্ধের চেয়ে আরও ভালো করে শুরু করে লিভারপুল।
তবে, ফোডেনদের আটকে রাখার কাজটা মিলনার-হেন্ডারসন সেভাবে না করতে পারলেও লিভারপুলের আক্রমণ কৌশলে বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছেন এই দুজন। মিলনার-হেন্ডারসন-সালাহ লিভারপুলের ডানদিকে একটা ত্রিভুজ গঠন করছিলেন বারবার, ত্রিভুজের তিনকোণায় একেকজনকে একেকবার দেখা যাচ্ছিল। কখনও সালাহ উইংয়ে দলে এসে হেন্ডারসন আর মিলনারকে মাঝমাঠে আসতে দিচ্ছিলেন, আবার কখনও সালাহকে ভেতরে ঢুকতে দিয়ে হেন্ডারসন আর মিলনার চলে যাচ্ছিলেন সাইডলাইন বরাবর।
হেন্ডারসন বারবার সিটির বাঁ দিকের সেন্টারব্যাক এমেরিক লাপোর্ত ও লেফটব্যাক জোয়াও ক্যানসেলোর মাঝখানের ‘হাফস্পেস’ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছিলেন, ফলে সিটির ডিফেন্ডারদের মনোযোগ বারবার ওদিকে সরে যাচ্ছিল, ওই প্রান্তে থাকা উইঙ্গার মোহাম্মদ সালাহ তখন কিছু কিছু সময়ে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিলেন। লিভারপুলের দুটি গোলই মোটামুটি সালাহ-হেন্ডারসনদের এমন গতিবিধির কারণেই এসেছে।
শেষমেশ ম্যাচটা ফুটবলের হলেও, ক্লপ-গার্দিওলার কৌশলের এই লড়াই মনে করিয়ে দেয় দাবা খেলাকে। যেখানে প্রত্যেকটা চালই বুঝেশুনে, মাপমতো খেলতে হয়। একটু ভুল হলেই ম্যাচ হাতছাড়া। ২-২ গোলের চূড়ান্ত ফলাফল এটাই প্রমাণ করেছে, নব্বই মিনিটের কৌশলযুদ্ধে দুজনের কেউই কাউকে ‘মাত’ করতে পারেননি। ওই যে — ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’!