ম্যাচ শেষে ব্রিটিশ ক্রীড়া ওয়েবসাইট দ্য অ্যাথলেটিকের ম্যানচেস্টার সিটিভিত্তিক সাংবাদিক স্যাম লি পেপ গার্দিওলাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সিটি কি আজ একটু লিভারপুলের মতো খেলল?’
উত্তরে গার্দিওলা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। আমি সেরা দলগুলোকে কিছু ক্ষেত্রে নকল করার চেষ্টা করি।’
হয়তো মজা করেই বলেছেন। তবে কথাটা একেবারে ভুলও নয়। অন্তত ইতিহাদে গতরাতে লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যানচেস্টার সিটির খেলার ধরন দেখে অনেকের সেটা মনে হতেই পারে। যেমন মনে হতে পারে, ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুলও কি এই ম্যাচে কিছুটা গার্দিওলার সিটির চিরাচরিত ধরণে খেলল? দুই কোচেরই লক্ষ্য একই ছিল আসলে।
গার্দিওলা চেয়েছেন তিন পয়েন্ট নিয়ে লিভারপুলের সঙ্গে ব্যবধান বাড়াতে। ক্লপ চেয়েছেন ম্যাচ জিতে ১ পয়েন্ট পিছিয়ে থাকা থেকে ২ পয়েন্টে এগিয়ে যেতে। ক্লপের মস্তিষ্ক যথারীতি সমানে সমান টেক্কা দিয়েছে গার্দিওলার মস্তিষ্কের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত কেউ জেতেননি, হারেনওনি। ২-২ ড্রয়ের পর ব্যবধান তাই যা ছিল, রয়ে গেছে তা-ই।
কিন্তু মহাগুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে নিজেদের বহুলচর্চিত দর্শন ছেড়ে কেন ক্লপ-গার্দিওলা দুজনই একটু ব্যতিক্রমী চিন্তা করলেন? উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
ম্যাচ শুরুর আগেই পেপ গার্দিওলার একাদশ দেখে কিছুটা বিস্ময় জেগেছে। নিয়মিত মিডফিল্ডার ইলকায় গুন্দোয়ান ছিলেন না, ছিলেন না রাইট উইঙ্গার রিয়াদ মাহরেজ কিংবা ১০ কোটি পাউন্ডের জ্যাক গ্রিলিশ।
ওদিকে একাদশে রাখা হয়েছিল ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড গাব্রিয়েল জেসুসকে, যিনি জানুয়ারির পর সিটির মূল একাদশেই সুযোগ পাননি, সেপ্টেম্বরের পর লিগে কোনো গোল নেই যাঁর! জেসুসকে ডানে রেখে বাঁ উইংয়ে গার্দিওলা নামিয়েছিলেন রাহিম স্টার্লিংকে, মাঝে ফিল ফোডেন। মাঝমাঠে রদ্রির দুই পাশে কেভিন ডি ব্রুইনা আর বের্নার্দো সিলভা।
আক্রমণভাগে ফোডেন, স্টার্লিং আর জেসুসকে একসঙ্গে নামানোর একটাই অর্থ—পাল্টা আক্রমণে উঠে যাতে লিভারপুলের ‘হাই লাইন ডিফেন্স’ বা অনেকটা ওপরে উঠে খেলা রক্ষণভাগের পেছনে পড়ে থাকা ফাঁকা জায়গাটাতে লিভারপুলকে ঘায়েল করা যায়! এই কাজের জন্য ফরোয়ার্ডদের দুটি গুণ অবশ্যই থাকতে হয়—প্রেস করার ক্ষমতা ও গতিশীলতা। সিটির অন্যান্য ফরোয়ার্ডের তুলনায় ফোডেন, স্টার্লিং ও জেসুসের যে দুই গুণ অপেক্ষাকৃত বেশিই আছে। তিনজনের ওই প্রেস আর গতির গুণকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন গার্দিওলা। সিটি প্রতি–আক্রমণের মাধ্যমে লিভারপুলের ‘উঁচু’ রক্ষণভাগ ভেদ করতে চাইছে, শুনে কেমন–কেমন লাগছে না?
লাগাই স্বাভাবিক। প্রতি–আক্রমণ, প্রেসিং এগুলো যে গার্দিওলার কোচিং স্টাইলের মূল নিয়ামক কখনোই ছিল না। বরং ইয়ুর্গেন ক্লপের ধরনের সঙ্গেই ওটা মানায় বেশি। অর্থাৎ গার্দিওলা লিভারপুলের অস্ত্র দিয়েই লিভারপুলকে ঘায়েল করতে চাইছিলেন শুরু থেকেই!
গার্দিওলা হয়তো বুঝেছিলেন, লিভারপুলের মাঝমাঠে থিয়াগো আলকানতারার মতো একজন মিডফিল্ডার থাকার কারণে হয়তো মাঝমাঠের প্রত্যাশিত দখল পাবে না তাঁর দল। আর দখল না পেলে গোল করার বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বিকল্প উপায়? প্রতি–আক্রমণ আর প্রেসিং!
লিভারপুলের একাদশটা অবশ্য ঠিক চমকে যাওয়ার মতো ছিল না, তবে কৌতুহলউদ্দীপক ছিল তো বটেই । আক্রমণভাগে মোহাম্মদ সালাহ আর সাদিও মানের সঙ্গে তৃতীয় ফরোয়ার্ড হিসেবে লাতিন রবার্তো ফিরমিনো বা লুইস দিয়াজ নন; সুযোগ পেয়েছিলেন ইউরোপীয় দিওগো জোতা। নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, রসায়নের দিক দিয়ে সালাহ ও মানের সঙ্গে ফিরমিনো বা দিয়াজের বোঝাপড়া যতটা ভালো; জোতার সঙ্গে অতটা নয়। জোতা আবার অন্য আরেক দিকে দিয়াজ কিংবা ফিরমিনোর চেয়ে ভালো—ডি–বক্সের মধ্যে চকিতেই প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের মধ্যে ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করে সঠিক সময়ে গোল করার মতো সঠিক জায়গায় চলে যাওয়া।
অর্থাৎ মূল একাদশে ফিরমিনো ও দিয়াজকে না নামিয়ে জোতাকে নামানোর একটাই অর্থ, আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সফল পাসের হার, বল পায়ে ধরে রেখে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা—এসব কিচ্ছু চান না ক্লপ। চান শুধু গোল। কোনোভাবে ডি–বক্সের মধ্যে সঠিক জায়গায় জোতা পৌঁছে গিয়ে গোল করতে পারলেই ব্যস, কেল্লাফতে! বল পায়ে ২-৪-৪, বল ছাড়া ৪-৪-২/৪-৩-৩ ; এমন কৌশলে খেলা শুরু করে ম্যানচেস্টার সিটি। দুই উইংয়ে নেমে আসেন ফোডেন আর জেসুস, ওপরে স্টার্লিংয়ের সঙ্গে গিয়ে প্রেস করা শুরু করেন কেভিন ডি ব্রুইনা।
সিটির এই কৌশল বিশেষ করে কেভিন ডি ব্রুইনার জন্য দুর্দান্ত ছিল। কারণ, সিটির মিডফিল্ডারদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে ডি ব্রুইনাকেই সফলভাবে প্রেস করলে পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া সম্ভব, যেটা সিটির অন্যান্য ফরোয়ার্ড বা মিডফিল্ডারের ক্ষেত্রে বলা যায় না। তাই গার্দিওলা কেভিন ডি ব্রুইনাকে এমন সব জায়গায় খেলাতে চেয়েছেন, যেখানে তাঁকে মাঝমাঠের প্রেসও সহ্য করতে হবে না, আবার ওপরে গিয়ে নিয়মিত প্রেস করতেও পারবেন। সুযোগমতো গোলে শটও মারতে পারবেন, গোল বানিয়েও দিতে পারবেন। প্রতি–আক্রমণে ফরোয়ার্ডদের সাহায্যও করতে পারবেন, যেটা তাঁর খেলার ধরনের অন্যতম শক্তিশালী দিক।
নিজের ফরোয়ার্ডের কাছ থেকে গতিশীলতা ও প্রেসিং তো বটেই, আরেকটা জিনিসও চেয়েছিলেন গার্দিওলা। প্রতিপক্ষের ডি–বক্সের আশপাশে বল পেয়ে নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট পাস দিয়ে আক্রমণ গড়তে গিয়ে সময় নষ্ট না করে দ্রুত শট নেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন সিটি কোচ। সিটির প্রথম গোলটা সেভাবেই এসেছে। মাঝমাঠে দ্রুত বল জোগাড় করে ডি-বক্সের কাছে যেতে না যেতেই শট নিয়েছেন ডি ব্রুইনা। গোল এসেছে তাতেই।
পুরো ম্যাচে সিটি এভাবে লিভারপুলের রক্ষণভাগের পেছনের জায়গাটা গতি দিয়ে দখলে নিতে চেয়েছে, তাতে সফলও হয়েছে বেশ। স্টার্লিং, মাহরেজরা গোল মিসের মহড়ায় মেতে না উঠলে হয়তো পুরো তিন পয়েন্ট নিয়েই মাঠ ছাড়ত সিটি।
বল যখন পায়ে থাকে, সিটি তখন সাধারণত লেফটব্যাক জোয়াও কানসেলোকে ওপরে ওঠার লাইসেন্স দিয়ে রাইটব্যাক কাইল ওয়াকারকে দুই সেন্টারব্যাকের পাশে তৃতীয় সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলায়। ফলে রক্ষণে তিনজন খেলোয়াড় থাকেন। লিভারপুলের বিপক্ষেও সিটি এভাবে খেলবে, ক্লপ হয়তো এমনটাই ভেবেছিলেন।
কিন্তু এখানেও চমক দেখিয়েছেন গার্দিওলা। কানসেলোকে ওপরে উঠার অনুমতি তো দিয়েছেনই, ওয়াকারকেও ওপরে উঠে খেলতে বলেছেন। ওদিকে রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার রদ্রিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন দুই সেন্টারব্যাককে রক্ষণে সাহায্য করার জন্য। রদ্রিকে সাহায্য করতে বের্নার্দো সিলভাও অনেকটা রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায় খেলছিলেন, দুই সেন্টারব্যাকের কাছ থেকে রদ্রির পাশাপাশি পাসের আদান-প্রদান করছিলেন তিনিও।
লিভারপুলের পায়ে যখন বল থাকে না, তখন সচরাচর তারা ৪-৩-৩ ছকেই প্রেস করে। তিন ফরোয়ার্ড প্রেস করেন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে, তিন মিডফিল্ডার মাঝমাঠে কাছাকাছি থেকে প্রতিপক্ষ যেন মাঝ করিডর থেকে বল না নিয়ে যেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করেন।
কানসেলো-ওয়াকার দুজনই উঠে যাওয়া এবং বের্নার্দোর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে মাঝমাঠে হেন্ডারসন আর থিয়াগোর যেন সমস্যা না হয়, এ জন্য চাইলেও লিভারপুল তিন ফরোয়ার্ড নিয়ে সিটির দুই সেন্টারব্যাক জন স্টোনস আর আয়মেরিক লাপোর্তকে প্রেস করতে পারছিল না, যেটা সালাহ-মানে-জোতাদের অন্যতম প্রধান কাজ।
ফলে লিভারপুলের ছকটা অনেকটা ৪-৫-১/৪-১-৪-১ হয়ে যাচ্ছিল। কানসেলো আর ওয়াকারকে দেখে রাখার জন্য ও মাঝমাঠে থিয়াগো-হেন্ডারসনকে সাহায্য করার জন্য সালাহ আর মানেকে দুই উইংয়েই থাকতে হচ্ছিল, ওপরে একা (বা কখনো কখনো হেন্ডারসনকে নিয়ে) প্রেস করে গেছেন জোতা।
স্টোনস আর লাপোর্ত যেহেতু প্রেসের মুখোমুখি হচ্ছিলেন না, সেহেতু সিটিও নিচ থেকে নির্ঝঞ্ঝাটে আক্রমণ গড়ে তুলতে পেরেছে; যেমনটা গার্দিওলা সব সময় চান। পায়ে বল না থাকলে লিভারপুল যে সচরাচর ৪-৩-৩ ছকে রক্ষণ করে, সে কৌশলও এই ম্যাচে একটু নকল করার চেষ্টা করেছেন গার্দিওলা। বলের দখল ছাড়া মাঝেমধ্যেই সিটিকে ৪-৩-৩ ছকে দেখা গেছে।
প্রথমার্ধে গার্দিওলার এমন কৌশলের মূল্য সবচেয়ে বেশি চুকিয়েছেন লিভারপুলের তিন খেলোয়াড় ফাবিনিও, হেন্ডারসন আর ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড। কখনো কখনো জোতার পাশাপাশি হেন্ডারসনকেও ওপরে উঠে প্রেস করার নির্দেশ দিচ্ছিলেন ক্লপ, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে রাইটব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ডকে রক্ষণে বাড়তি নিরাপত্তা দিতে পারেননি লিভারপুল অধিনায়ক।
হেন্ডারসন ওপরে উঠে যাওয়ার কারণে ছকটা অনেক সময় ৪-৪-২ হয়ে যাচ্ছিল লিভারপুলের। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বল পায়ে না থাকলে গার্দিওলা সাধারণত তাঁর দলকে ৪-৪-২ ছকে রক্ষণ করতে বলেন, এ ম্যাচে লিভারপুলের কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই যে জিনিসটা চাইছিলেন ক্লপ! অর্থাৎ গার্দিওলার কৌশলে থেকেও ক্লপ যে ‘নকল’ করেছেন এ ম্যাচে, সেটা বলাই যায়।
গার্দিওলার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, এক উইংয়ে বল নিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষের কয়েকজন খেলোয়াড়কে আকৃষ্ট করে বিপরীত উইং ফাঁকা করে দেওয়া, যাতে চকিতেই লম্বা পাসের মাধ্যমে বল বিপরীত উইংয়ের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা সিটি খেলোয়াড়ের কাছে পাঠানো যায়, গোলের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়।
নিজেদের প্রথম গোলটাও অনেকটা সেভাবেই এসেছে সিটির। লিভারপুলের ডান দিকটা যখন ফাঁকা ছিল, দ্রুতগতির ছোট ফ্রি-কিক নিয়ে সেদিক থেকেই আক্রমণ করে গোল করেছে সিটি। ক্লপই–বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? গার্দিওলার ‘নোটবুক’ থেকে এই কৌশলও ‘টুকে’ নিয়েছেন ক্লপ।
লিভারপুলের দুই গোলের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় সেটা। প্রথম গোলে শুরুতে থিয়াগো আলকানতারা, পরে অ্যান্ডি রবার্টসন, দুজনই বাঁ দিক থেকে ডানে থাকা ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ডকে লম্বা পাস দিয়ে গোলমুখ খোলার চেষ্টা করেছেন, আলেক্সান্ডার-আরনল্ড পরে জোতার গোলে সহায়তা করেন। দ্বিতীয় গোলে আলকানতারা-রবার্টসনের ভূমিকা পালন করেন সেন্টারব্যাক ভার্জিল ফন ডাইক। প্রেসিংয়ের দিক দিয়ে মৌসুমের অন্যতম বাজে ম্যাচ খেলেছে লিভারপুল, ওদিকে সিটি খেলেছে নিজেদের অন্যতম সেরা ম্যাচ।
শেষমেশ দুই দলকে পয়েন্ট ভাগাভাগি করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে যদিও। নিরপেক্ষা ফুটবলপ্রেমীদের তাতে আক্ষেপ থাকার কথা নয়। যত যা–ই হোক, দুর্দান্ত একটা ম্যাচ তো দেখা গেছে!