এখনো কাঁদে খেলা

কেউ ফেরেননি, কারও বুকে ১২ বুলেট

ইউব্যাংকের আঘাতে রিংয়ে লুটিয়ে পড়া ওয়াটসন। ছবি-সংগ্রহীত
ইউব্যাংকের আঘাতে রিংয়ে লুটিয়ে পড়া ওয়াটসন। ছবি-সংগ্রহীত
কোবে ব্রায়ান্টের মৃত্যুশোক এখনো পুরোনো হয়নি। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে, তবু শাপেকোয়েনস দলটার জন্য এখনো হয়তো কাঁদেন অনেক ফুটবলপ্রেমী। খেলা যুগে যুগে আনন্দ যেমন দিয়েছে, কষ্টও যে কম দেয়নি! কখনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন প্রিয় খেলোয়াড়, প্রিয় দল, কখনো ভক্তরা প্রাণ দিয়েছেন খেলার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে। কেউ বেঁচে ফিরেছেন অবিশ্বাস্যভাবে, কারও কারও মৃত্যু রয়ে গেছে চিরদিনের রহস্য হয়ে। খেলার জগতে ঘটে যাওয়া এমন স্মরণীয় কিছু ট্র্যাজেডি নিয়েই এবারের আয়োজন। ধারাবাহিকের আজ তৃতীয় পর্ব—


অমীমাংসিত ফাইনাল

মাইকেল ওয়াটসন কখনো বিশ্বসেরা বক্সার ছিলেন না। কিন্তু মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ৩০টি পেশাদার লড়াইয়ের ২৫টি জিতে সে সম্ভাবনাটা বেশ ভালোভাবেই জাগিয়েছিলেন। হয়তো হতেনও। কিন্তু সব হিসাব ওলট–পালট করে দিয়েছিল ১৯৯১ সালের বিশ্ব মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালটা।

প্রতিপক্ষ ছিলেন মাদক কেলেঙ্কারির জন্য তখন বেশ সমালোচিত ক্রিস ইউব্যাংক। সেই লড়াইয়ের ফলটা আজও বিতর্কিত। কেউ কেউ বলেন, ওয়াটসন পরিষ্কার ব্যবধানে জিতেছিলেন; কেউ বলেন, লড়াইটা আসলে শেষই হয়নি। কিন্তু বিচারকেরা তার পরও বিজয়ী হিসেবে ইউব্যাংকের নাম ঘোষণা করলেন। এবং যথারীতি এর ব্যাপক প্রতিবাদ হলো। অন্য উপায় না দেখে তিন মাস পর আবার ফাইনাল আয়োজনের ঘোষণা দিল কর্তৃপক্ষ।

এবার আর ইউব্যাংককে দাঁড়াতেই দিলেন না ওয়াটসন। ১১তম রাউন্ড যখন শেষ হলো, তখন তাঁর জয়টা যেন শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা ভেবেই বোধ হয় কিছুটা অসতর্ক হয়ে পড়েছিলেন তিনি। হঠাৎ আসা ইউব্যাংকের আপারকাটটা সামলাতে পারলেন না। চোয়াল ভেঙে গেল ওই ঘুষিতেই। কিন্তু ১১ রাউন্ডের বদলা যেন এক রাউন্ডেই নিয়ে ফেলতে চাইছিলেন ইউব্যাংক। ওয়াটসন কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটানা আঘাতের পর আঘাত। যখন থামলেন, ওয়াটসন ততক্ষণে লুটিয়ে পড়েছেন রিংয়ে। এভাবে পাক্কা আধঘণ্টা পড়ে ছিলেন ব্রিটিশ এ বক্সার।

অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লেগেছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরাও ভাবেননি ওয়াটসন বাঁচবেন। ৪০ দিন কোমায় ছিলেন। মাথায় ১২টি অস্ত্রোপচার করতে হলো। জ্ঞান ফেরার পর আরও ছয় মাস কাটল ইনটেনসিভ কেয়ারে। হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে সময় লেগেছিল পাক্কা এক বছর। একসময় হাঁটা-চলা থেকে শুরু করে স্বাভাবিক জীবন যাপনের মতো সুস্থও হলেন মাইকেল ওয়াটসন। সুস্থ হয়েছেন, এখনো বেঁচে আছেন দিব্যি। কিন্তু বক্সিং রিংয়ে আর ফিরতে পারেননি। কোনো দিন পারবেনও না।

সমুদ্রে হারিয়ে গেছেন ‘বেসবলের রাজা’ খ্যাত রবার্তো ক্লিমেন্তে। ছবি-সংগ্রহীত



হারিয়ে গেছেন ক্লিমেন্তে

‘বেসবলের রাজা’ বলা হতো তাঁকে। পিটসবার্গ পাইরেটসের হয়ে টানা ১৮ মৌসুমে রবার্তো ক্লিমেন্তের পরিসংখ্যান যেকোনো বেসবল খেলোয়াড়ের জন্য ঈর্ষা জাগানিয়া। ক্যারিয়ারের ১৮ মৌসুমের ১২টিতেই গোল্ডেন গ্লাভস (মেজর লিগ বেসবলের বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার) জিতেছিলেন তিনি। জুটেছিল প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল। সেই ক্লিমেন্তে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এত সব অর্জন নিয়ে তলিয়ে গিয়েছিলেন সমুদ্রে!

খেলার পাশাপাশি সেবামূলক কাজে দারুণ উৎসাহ ছিল। অবসরে কেউ ঘুরতে যায়, কেউ সময় কাটায় নিজের মতো করে। পিটসবার্গ পাইরেটসের এ রাইট ফিল্ডার সময় পেলেই ছুটে যেতেন মানুষকে সাহায্য করতে। সতীর্থরাও খেপাত তাঁকে ‘তেরেসার ছেলে’ বলে। এমন যে মানুষ, নিকারাগুয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর তিনি কি আর ঘরে বসে থাকতে পারেন?

১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে সেই ভূমিকম্পের পর তাই ক্লিমেন্তে নিকারাগুয়া গেলেন বেঁচে থাকা মানুষদের সাহায্য করতে। ফিরে এসে আরও কিছু অনুদান জোগাড় করে পাঠালেন নিজের উদ্যোগে। কিন্তু খবর এল তখনকার নিকারাগুয়ার স্বৈরশাসক সমোজার দুর্নীতির কারণে সব ত্রাণ দুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না ঠিকমতো। ক্লিমেন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নিজেই যাবেন এবার ত্রাণ নিয়ে।

এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন নিকারাগুয়ার রাজধানী মানাগুয়ায়। কখনো পৌঁছানো হয়নি তাঁর। ঠিক কী কারণে বিমানটা বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেটা জানা যায়নি এখনো। ধারণা করা হয়, ত্রাণসামগ্রী ভর্তি থাকায় মাত্রাতিরিক্ত ওজন হয়ে গিয়েছিল। টেক অফের কিছুক্ষণ পরই পোর্তোরিকোর সমুদ্রসৈকতে বিধ্বস্ত হলো বিমানটি। একজন পাইলট আর সেই বন্ধুর লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

ক্লিমেন্তে হারিয়ে গেলেন সমুদ্রে!

আত্মঘাতী এক গোলের জন্য মাফিয়ারা কেড়ে নিয়েছিল এসকোবারের জীবন। ছবি-সংগ্রহীত



আত্মঘাতী গোলের মাশুল

আত্মঘাতী গোলের ঋণটা আন্দ্রেস এসকোবার শোধ করেছিলেন নিজের জীবন দিয়ে।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ। স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেদিন ড্র করলেই দ্বিতীয় রাউন্ডে চলে যেত কলম্বিয়া। কিন্তু এসকোবারের এক আত্মঘাতী গোলে তারা ম্যাচটা হেরে গেল ১-২ ব্যবধানে। বিদায় নিতে হলো বিশ্বকাপ থেকে।

পরে জানা গেছে, এ ম্যাচ নিয়ে বাজি ধরেছিল কলম্বিয়ান মাফিয়ারা। ম্যাচ হেরে যাওয়ায় বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয়েছিল তাদের। কলম্বিয়া ফুটবল দলটা দেশে ফিরে আসার পর ওই মাফিয়াদেরই তিনজন ১৯৯৪ সালের ২ জুলাই রাতে একা পেয়ে যায় এসকোবারকে। বন্ধুদের নিয়ে একটা নাইট ক্লাবে গিয়েছিলেন। বাকি দুই সতীর্থকে বিদায় দিয়ে নিজে যখন বাসায় ফিরবেন, রাত তখন ৩টা। পার্কিংয়ে এসকোবার একা। পয়েন্ট-৩৮ ক্যালিবারের পিস্তল থেকে বের হওয়া ১২টি বুলেট ছিন্নভিন্ন করে দেয় কলম্বিয়ান এ ডিফেন্ডারের বুক। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ৪৫ মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু আলিঙ্গন করে তাঁকে।

হুমবার্তো কাস্ত্রো নামের সেই ঘাতককে পরে আটক করে পুলিশ। কলম্বিয়ার আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হুয়ান সান্তিয়াগোর ড্রাইভার হিসেবে কাজ করত সে। দোষ স্বীকার করার পর প্রথম রায়ে ৪৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। পরে সেটা কমিয়ে আনা হয় ২৬ বছরে। তবে কয়েদি হিসেবে ভালো আচরণ করার পুরস্কার হিসেবে ১১ বছর পর ২০০৫ সালে মুক্তি পেয়ে যায় কাস্ত্রো।

আর এসকোবার? নিজের জীবন দিয়ে শোধ করে গেছেন এক গোলের দায়।