>এএফসি কাপের আন্ত–আঞ্চলিক সেমিফাইনালের ফিরতি পর্বে উত্তর কোরিয়ার এপ্রিল টোয়েন্টি ফাইভের কাছে ২-০ গোলে হেরেছে হবে আবাহনী লিমিটেড। দুই ম্যাচে গোল গড়ে ৫-৪ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়। কিন্তু থামার আগ পর্যন্ত তরুণ কোচ মারিও লেমোসের হাত ধরে যা করে দেখিয়েছে, তা আবাহনীর কাছে ইতিহাস।
বদমেজাজি, খিটখিটে স্বভাব আর মনঃপূত না হলেই খেলোয়াড়দের সমালোচনা করা—বাংলাদেশে কাজ করে যাওয়া বেশির ভাগ বিদেশি কোচের সংজ্ঞাটা এমনই। তাঁকে দেখলে আর যা–ই হোক ফুটবল কোচ বলে মনে হয় না। অন্যান্য বিদেশি কোচের মতো দীর্ঘদেহী নন, উচ্চতা সাকল্যে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। বয়স মাত্র ৩৩। মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে। যত কড়া প্রশ্নই হোক না কেন, জবাবটা পাওয়া যায় হাসিমুখে। তিনি আবাহনী লিমিটেডের পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোস। ভাঙাচোরা আবাহনী দলকে নিয়ে ইতিহাস গড়া সেনাপতি।
এপ্রিল টোয়েন্টি ফাইভের কাছে অ্যাওয়ে ম্যাচে ২-০ গোলে হেরে এএফসি কাপে আবাহনীর স্বপ্নযাত্রা থেমে গিয়েছে। কিন্তু থামার আগ পর্যন্ত যা করে দেখিয়েছে, তা ক্লাবটির জন্য ইতিহাস। বাংলাদেশের ফুটবলের মরা গাঙে জোয়ার আসার মতো উপলক্ষ। যে আবাহনী এএফসি প্রেসিডেন্টস ও এএফসি কাপে সাতবার খেলে গ্রুপ পর্ব পেরোতে পারেনি, তাদের এবার এএফসি কাপের আন্ত–আঞ্চলিক ফাইনালের স্বপ্ন দেখার সাহস দেখিয়েছেন লেমোস। ২০১০ বিশ্বকাপ খেলা উত্তর কোরিয়ার ১৮ বার চ্যাম্পিয়ন এপ্রিল টোয়েন্টি ফাইভের মতো দাপুটে ক্লাবকেও সেমিফাইনালের প্রথম পর্বে হারিয়ে দিয়েছে লেমোসের আবাহনী।
এএফসি কাপ শুরুর আগে আবাহনীর কোনো পাঁড় সমর্থকও হয়তো স্বপ্ন দেখেনি গ্রুপ পর্বের বাধা পার হবে তাদের দল। অথচ ভারতকে এএফসি কাপের সাম্রাজ্য থেকে হটিয়ে এশিয়ান মঞ্চে আবাহনী উড়াল বাংলাদেশের পতাকা। এএফসি কাপের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে একক রাজত্ব ছিল ভারতীয় ক্লাব বেঙ্গালুরু এএফসির। ২০১৭ সাল থেকে এই অঞ্চলের ক্লাবগুলোকে এএফসি কাপের প্রথম পর্বে নিজেদের মধ্যে খেলার সুযোগ করে দেয় এশিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা। প্রথম দুবারই চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বেঙ্গালুরু। সেই বেঙ্গালুরু তো ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে (আইএসএল) চ্যাম্পিয়ন না হতে পারায় এবার খেলার সুযোগ পায়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্য রক্ষার দায় নিয়ে এসেছিল চেন্নাইয়িন এফসি ও মিনার্ভা পাঞ্জাব। কিন্তু তাদের ছিটকে দিয়ে ভারতের রাজত্ব দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহীরা। সেটি সম্ভব হয়েছে ভারতের গুয়াহাটিতে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন মিনার্ভা পাঞ্জাবকে হারিয়েই।
অথচ এএফসি কাপের শুরু থেকেই আবাহনী দলটা ছোটখাটো হাসপাতাল! শুরুর আগেই চোটে ছিটকে গিয়েছে দলের দুই স্তম্ভ ডিফেন্ডার তপু বর্মণও মিডফিল্ডার আতিকুর রহমান ফাহাদ। গ্রুপ পর্বের একটি ম্যাচেও পাওয়া যায়নি ফিটনেস নিয়ে সমস্যায় থাকা চার বিদেশি। দ্বিতীয় পর্বে পা রেখে আবাহনী যখন আরও বড় স্বপ্ন দেখছে, তখন হারাতে হয়েছে গ্রুপ পর্বে ৩ গোল করা নায়ক আফগানিস্তানের ডিফেন্ডার মাসি সাইগানিহকে। প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় আফগান অভাব পূরণের জন্য আনা হলো মিসরীয় ডিফেন্ডার আলে নাসেরকে। কিন্তু পূর্বে মালদ্বীপের ক্লাবের হয়ে এএফসি কাপের শেষ ম্যাচে কার্ড দেখায় আবাহনীর জার্সিতে মাঠে নামতে পারলেন না তিনি। তাঁর ম্যাচ খেলার খবরটাও এসেছিল ম্যাচের দুই দিন আগে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এল এএফসি কাপে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মামুনুল ইসলামের চোট।
সেমিফাইনালে এপ্রিল টোয়েন্টি ফাইভের মুখোমুখি হওয়ার আগে এমন ভাঙাচোরা দল নিয়ে আবাহনী সমর্থক থেকে শুরু করে ক্লাব কর্তারা যখন উদ্বিগ্ন, তখন মারিও লেমোস অভয় দিলেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, আমি তো আছি।’ এপ্রিলের বিপক্ষে কীভাবে জোড়াতালি দিয়ে দল সাজিয়েছিল জানেন? এএফসি কাপে প্রথমবারের মতো খেলালেন ৩ সেন্টারব্যাক। নাসেরের জায়গা পূরণ করার জন্য প্রথাগত দক্ষিণ কোরিয়ান হোল্ডিং মিডফিল্ডার তা মিন লিকে খেলানো হলো সেন্টারব্যাক। আবার হোল্ডিং মিডফিল্ডের জায়গা পূরণ করতে সেখান পাঠানো হলো প্রথাগত ডিফেন্ডার রায়হান হাসানকে। কী জুয়াটাই না খেলে সফল হলেন লেমোস।
ম্যাচ শেষে জোড়াতালি দিয়ে একাদশ গঠন করা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘প্রথমে নাসেরকে ও পরে মামুনুলকে হারালাম। ম্যাচের আগের দিন আমি তো খুবই বিপদে পড়ে গেলাম। দুবার পরিকল্পনা বদলে এটাই ছিল আমার হাতের শেষ কৌশল এবং যা কাজে লাগিয়েছে খেলোয়াড়েরা। আমি শুধু খেলোয়াড়দের বলেছিলাম, যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সফল করতে হবে।’
খেলোয়াড়দের পরিকল্পনা বলে দিলেই যদি সফল হওয়া যেত, তাহলে তো কোনো দলের ব্যর্থ হওয়ার কথা নয়। পরিকল্পনা কীভাবে সফল করতে হবে, তা দেখিয়ে দিতে পেরেছেন বলেই বাজিমাত করেছেন তরুণ পর্তুগিজ কোচ। খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা জোগানোর কাজটাই লেমোসকে অন্যদের চেয়ে আলাদা হিসেবে প্রমাণ করেছে বলে জানান এএফসি কাপে সপ্তাহ সেরা গোলের পুরস্কার জেতা মিডফিল্ডার সোহেল রানা, ‘কোচের সবচেয়ে বড় গুণ আমাদের সমস্যা বুঝতে পারে। আর কার কাছ থেকে কীভাবে সেরাটা আদায় করে নেওয়া যায়, তা খুব ভালো জানে।’
লেমোসের হাত ধরে ইতিহাস গড়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল আবাহনী। তবে অল্পের জন্য গড়া হলো না সেই ইতিহাস। তবে মন ঠিকই জিতে নিয়েছে লেমোসের দল। ৩৩ বছর বয়সী এই পর্তুগিজের ক্ষুরধার ফুটবল মস্তিষ্কের জোরে আকাশি-নীলদের নবোদয় দেখল দেশের ফুটবলপ্রেমীরা।