কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করার কাজটা খুব কঠিন ছিল ফরহাদ হোসেনের জন্য। অল্পবয়সী কিশোরী তত দিনে ভয়ংকর নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি যৌন নিপীড়নের শিকারও হয়েছে একাধিকবার।
মেয়েটির খবর পাওয়ার পর বেশ কয়েকবার কাউন্সেলিং করানো হয় তাকে। শুরুর দিকে ফরহাদ হোসেনের ওপর মোটেও আস্থা পাচ্ছিল না মেয়েটি। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেয়েটিকে তোলা হলো ঢাকার ওয়াশপুরে লিডো ‘পিস হোমে’।
মেয়েটির জন্মের সময় মোটেও ঘটা করে পরিবারে উদ্যাপন হয়নি। রাস্তায় বেড়ে ওঠা সেই কিশোরীটির স্বপ্ন ছিল কোনোরকমে বেঁচেবর্তে থাকা। ৯ মাস আগেও যে মেয়ে পুরুষ মানুষ দেখলে আতঙ্কে লুকিয়ে পড়ত, সেই মেয়ের দুনিয়া পুরোপুরিই বদলে গেছে এখন।
আগামী ৫-১৫ অক্টোবর কাতারে হবে পথশিশুদের ফুটবল বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপে অংশ নেবে ২১ দেশের ২৬টি দল। দোহায় এবারের পথশিশুদের বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। মেয়েটিও সুযোগ পেয়েছে পথশিশুদের ফুটবল দলের চূড়ান্ত একাদশে।
নিরাপত্তার প্রশ্নে সংগত কারণেই মেয়েটির নাম এড়িয়ে গেলেন লিডোর নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন। ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে কাল বিকেলে দোহাগামী এই পথশিশুদের আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো সবার সামনে। ঢাকা শহরের হাজার হাজার পথশিশুর মধ্য থেকে ১১ কিশোরীকে দোহায় বিশ্বকাপের জন্য বাছাই করেছে লিডো।
এর আগে ইংল্যান্ডে পথশিশুদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের কার্যালয়ে এই মেয়েদের বিভিন্ন রকমের তথ্য পাঠাতে হয়েছে। এরপর যাচাই–বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শেষে সুযোগ হয়েছে কাতারে যাওয়ার।
পথশিশুদের সহায়তা করার জন্য গঠিত বাংলাদেশের এই প্রতিষ্ঠানের পুরো নাম লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকনোমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লিডো)। পথশিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসের ব্যবস্থা করে দেয় লিডোর এই ‘পিস হোম’।
যে শিশুদের থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, চিকিৎসা সুবিধার তো প্রশ্নই আসে না—তাদের পিস হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ওই শিশুদের পরিবারকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলে। তা খুঁজে পেলে তো ভালোই, নইলে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের জন্য সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আগে কখনো ফুটবল খেলার সুযোগ পাইনি। পলিথিনের ভেতরে কাপড় দিয়ে বল বানিয়ে খেলতাম। তবে এখন ফুটবল দিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করছিবাংলাদেশ দলে সুযোগ পাওয়া স্বপ্না আক্তার
পথশিশুদের বিশ্বকাপে খেলার জন্য এরই মধ্যে ক্যাম্প শুরু করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। বাংলাদেশের এই দলে সুযোগ পেয়েছে আফরিন খাতুন, রিপা আক্তার, ফাইরুজ আবিদা, মোসাম্মত আলিয়া, ইতি আক্তার, জান্নাতুল ফেরদৌস, জেসমিন আক্তার, সাথী আক্তার, ফারজানা আক্তার, হামিদা আক্তার, মিম আক্তার ও স্বপ্না আক্তার। কোচ নাজমা আক্তারের অধীনে সকাল-বিকেল চলছে মেয়েদের অনুশীলন।
‘রোড টু দোহা’ অনুষ্ঠানে কাল বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ তুলতেই স্বপ্না বলছিলেন, ‘আমার বাবা-মায়ের চেহারা একটুও মনে নেই। দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক আগে। রাজধানীর সদরঘাট থেকে সাত বছর আগে আমাকে উদ্ধার করে আনে লিডোর উদ্ধারকারী দল।’
এর পর থেকে লিডোর ‘পিস হোম’ই স্বপ্নার বাড়িঘর। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ হয়েছিল। সে বছর ক্রিকেট দলের সঙ্গে স্বপ্না গিয়েছিল লন্ডনে। লর্ডসের মাঠে ক্রিকেট খেলেছিল। সেই স্বপ্না এবার দোহার আল বাইয়াত স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলবে।
কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধন হবে যে স্টেডিয়ামে, সেখানে খেলার অপেক্ষায় রোমাঞ্চিত স্বপ্না, ‘আমি লর্ডসে খেলেছি। এবার দোহার স্টেডিয়ামে খেলতে চাই।’
যদিও নিজের অতীত নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে আগ্রহী হলো না স্বপ্না। মেয়েদের উঠে আসার গল্পটা জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেনও তা এড়িয়ে যেতে চাইলেন, ‘আমরা এটা বলতে চাই না ওরা কোথা থেকে এসেছে। ওরা বিভিন্ন সময় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অনেকের বাবা-মায়ের খোঁজ নেই বলে জন্মসনদও পাওয়া যাচ্ছে না। ওদের সঠিক জন্মপরিচয় বের করাটাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ওরা খেলতে যাবে, কিন্তু জন্মসনদের জন্য পাসপোর্ট হচ্ছে না। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে কয়েকজনের পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এটার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নেওয়া উচিত।’
স্বপ্না অবশ্য এত সব লড়াই-সংগ্রাম পেছনে ফেলে ফুটবল মাঠে পুরো মনোযোগ দিতে চায়, ‘আমরা আগে কখনো ফুটবল খেলার সুযোগ পাইনি। পলিথিনের ভেতরে কাপড় দিয়ে বল বানিয়ে খেলতাম। তবে এখন ফুটবল দিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করছি। লন্ডনে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তুলেছিলাম বাংলাদেশকে। এবার ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছি।’
পথশিশুদের দলের কাতার যাওয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলেও আর্থিকভাবে সেভাবে সহযোগিতা পাচ্ছে না লিডো। ফরহাদ হোসেন তাই সবার সহযোগিতা চাইছেন, ‘আমরা এই মেয়েদের জন্য স্পনসর খুঁজছি। যদি প্রতিটা মেয়ের জন্য আলাদা আলাদা করেও স্পনসর পেতাম, তাহলেও অনেক উপকার হতো।’
বাংলাদেশের ছেলেদের জাতীয় দলের বর্তমান ফিফা র্যাঙ্কিং ১৮৬। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব উতরে চূড়ান্ত পর্বে কখনো যেতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু পথশিশুদের ফুটবল বিশ্বকাপে কাতারে এই মেয়েদের হাতে থাকবে লাল-সবুজের পতাকা। ফুটবলাররা যে কাজ করতে পারেননি, পথশিশুদের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেটাই করে দেখাতে চায় স্বপ্না-ফারজানারা।