কত বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশের এক চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক

বাংলাদেশ অধিনায়ক মারিয়া। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশ অধিনায়ক মারিয়া। ছবি: প্রথম আলো

বাবা মারা গেছেন...। বিষয়টি বোঝার বয়সও তখন হয়নি ছোট মেয়েটির। স্বামীকে হারিয়ে জীবনের উত্তাল সাগরে নাও ভাসিয়েছেন মা এনাতো মান্দ্রা। সহায়-সম্বল বলে কিছু নেই বলে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ নিলেন তিনি। আর যা-ই হোক, ছেলেমেয়েদের মুখে তো তুলে দিতে হবে দুমুঠো ভাত। টিকিয়ে রাখতে হবে তাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন।

সেই ছোট মেয়েটি আজকের বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্ডা। যার হাত ধরেই ভারতকে হারিয়ে আজ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। কত বাধা পাড়ি দিয়ে এসে নিজেকে একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তৈরি করা যায়, তা মারিয়ার জীবনগল্পের প্রতিটি প্যারাতে লেখা।

বাবা বীরেন্দ্র মারাকের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে হা করে তাকিয়ে থাকে মারিয়া। বাবার কোনো স্মৃতিই যে নেই তার। মা এনাতো মান্দ্রাই একসঙ্গে তার ‌‘বাবা ও মা’। মারিয়াদের তিন বোন ও একমাত্র ভাইকে মানুষ করতে কী অমানুষিক কষ্টই না করেছেন এনাতো। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন, তা দিয়েই মারিয়াদের চার ভাইবোনের জুটত দুমুঠো ভাত। অনেক দিন তো মা ও বড় বোনের সঙ্গে কাজে হাত লাগাতে হয়েছে মারিয়াকেও। না হলে যে বাড়ির চুলোয় আগুন জ্বলে না। বাফুফের এস্টো টার্ফে সেই গল্প শুনতে গিয়ে আবিষ্কৃত হলো এক অচেনা মারিয়া; যে মারিয়ার ফুটবলের বাইরের জীবনটা কষ্টের কালো ডায়েরি।

নিজ উঠানে চলছে অনুশীলন। সংগৃহীত ছবি

ফুটবলটাই মারিয়ার জীবনে ফুটিয়েছে হাসি। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট উপলক্ষে খালি পায়ে ফুটবলে হাতে খড়ি হয় ময়মনসিংহ জেলার মেয়েটির। ২০১৩ সালে ধোবাউড়ার বিখ্যাত কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের সদস্য। এর পরেই তার পায়ে ওঠে বুট। আর বদলাতে থাকে মারিয়া মান্ডার পৃথিবী। হ্যাঁ, তখনো কিন্তু মারিয়াকে পাশের বাড়িতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে গৃহপরিচারিকার কাজে হাত লাগাতে হতো।

২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলে ডাক পায় মারিয়া। তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে তার সহ-অধিনায়কত্বেই চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। গত বছর ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দলের সহ-অধিনায়কও ছিল মারিয়া। এরপরে জায়গা করে নেয় মূল জাতীয় দলে। শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত সাফে বাংলাদেশের রানার্সআপ হওয়ার পেছনে ছোট মারিয়ার অবদান কম নয়। যার ফল স্বরূপ অনূর্ধ্ব-১৫ সাফে তার বাহুতেই বেঁধে দেওয়া হয় বাংলাদেশের আর্মব্যান্ড। এরপরের গল্পটা তো পুরো বাংলাদেশ দেখল। মারিয়ার হাত ধরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে সাম্রাজ্য গেড়ে বসা ভারতকে একই টুর্নামেন্টে হারাল দুই-দুইবার।

মাঠে অধিনায়ক মারিয়ার খেলার ধরনটা পাক্কা রাঁধুনির মতো। তাকে কিছুটা মেলানো যায় স্পেন ও বার্সেলোনার মিডফিল্ডার সার্জিও বুসকেটসের সঙ্গে। পা থেকে বল কেড়ে নিতে হবে, সেখানে মারিয়া। আবার মাঝমাঠে বল দখলে রাখতে হবে, সেখানেও আছে খর্বাকৃতির মেয়েটি। বল পায়ে নাও, প্রয়োজন হলে হোল্ড কর, সুযোগ হলে দ্রুত উইংয়ে ভালো একটি পাস দাও। এক কথায় সাধারণ ফুটবল। কিন্তু কজনই-বা পারে এভাবে খেলতে? মারিয়া মান্ডা এত সহজভাবে দারুণ খেলতে পারে বলেই নাকি তাকে অধিনায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাংলাদেশ কোচ গোলাম রব্বানি, ‘মারিয়া সিনিয়র ও বয়সভিত্তিক সব দলেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। পায়ে বল রাখার ক্ষমতা ভালো। যেকোনো পরিস্থিতিতেই ভালো পাস দিতে পারে। মাঠের বাইরেও দারুণ ঠান্ডা মেজাজের, কোনো ঝামেলায় নেই।’

সতীর্থ সবাই মজে থাকে বাড়ির ছোট মেয়ে মারিয়ার গুণে। দরিদ্র ঘরে জন্ম, পরিবারের জন্য গৃহপরিচারিকার কাজে সহযোগিতা, তবুও সুশিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়নি মারিয়া। কত বাধা পেরিয়ে এখন বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক। চ্যাম্পিয়নদের গল্পটা বুঝি এভাবেই লেখা হয়...।